শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


কোরবানির প্রস্তুতি, কিছু ভাবনা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

Indian Muslim boys take a goat for sacrifice after offering prayers on Eid al-Adha in Hyderabad, India, Wednesday, Nov. 17, 2010.

আমিনুল ইসলাম হুসাইনী : দেখতে দেখতে বছর ঘুরে আবারো সামনে চলে এলো মহান রবের সন্তুষ্টি অর্জনের মহা ক্ষণ, তথা ঈদ-উল-আযহা বা কোরবানির ঈদ। কোরবানি হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের এক অনন্য মাধ্যম। কেননা  কোরবান শব্দটির অর্থই হচ্ছে নিকটবর্তী হওয়া, সান্নিধ্য লাভ করা। তাই কোরবানির মাধ্যমে বান্দাহ যেমন আল্লাহর নিকটবর্তী বা প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেন, তেমনি পরিত্রাণ পায় তার অাভ্যন্তরীণ পশুত্বশুলভ অাচরণ থেকে ।

তাই এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত প্রস্তুতির। কেননা যে কোন ইভেন্ট বা কর্মযজ্ঞকে সফল করে তুলতে হলে সঠিক প্রস্তুতির বিকল্প নেই।
আর কোরবানির মতো এমন গুরুত্বপূর্ন পূণ্যময় ইবাদতের জন্য তো পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণ এবং সঠিক পরিকল্পনা অবশ্যকরণীয়। নতুবা সামান্য ভুলের জন্য যদি কোরবানির মূল উদ্দেশ্যই বিনষ্ট হয়ে যায় তখন কি আর এই কোরবানির কোনো মানে থাকে?

কোরবানির জন্য  প্রথমেই চাই নিয়তের পরিশুদ্ধতা। কোরবানির মূল উদ্দেশ্যই হতে হবে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি। কোরবানির প্রথম  কাজটি হলো পশু কেনা বা নির্বাচিত করা। এক্ষেত্রে শরয়ী মাসআলা হলো, এমন পশু দ্বারা কোরবানি দিতে হবে যা শরিয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে। যেমন- উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা। এগুলোকে কোরআনের ভাষায় বলা হয় 'বাহীমাতুল আন‘আম।'

শরিয়তের দৃষ্টিতে কোরবানির পশুর বয়সের দিকটাও খেয়াল রাখা জরুরী। উট পাঁচ বছরের হতে হবে। গরু বা মহিষ দু বছরের হতে হবে এবং ছাগল, ভেড়া, দুম্বা হতে হবে এক বছর বয়সের। হাদিসে এসেছে, জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা.বলেছেন, "তোমরা অবশ্যই মুসিন্না (নির্দিষ্ট বয়সের পশু) কোরবানি করবে। তবে তা তোমাদের জন্য দুষ্কর হলে ছয় মাসের মেষ-শাবক কোরবানি করতে পার।" (মুসলিম,১৯৬৩)

গুণগত দিক দিয়ে উত্তম হল কোরবানির পশু হৃষ্টপুষ্ট, অধিক গোশত সম্পন্ন, নিখুঁত ও দেখতে সুন্দর হওয়া।  কোরবানির পশু হতে হবে যাবতীয় দোষ-ত্রুটি মুক্ত। যেমন হাদিসে এসেছে, বারা রা. ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, "রাসূল সা.আমাদের মাঝে দাঁড়ালেন আর আমার হাত তাঁর হাতের চেয়েও ছোট,তারপর বললেন, চার ধরনের পশু, যা দিয়ে কোরবানি জায়েয হবে না। (অন্য বর্ণনায় বলা হয়েছে পরিপূর্ণ হবে না) ১. অন্ধ,যারঅন্ধত্ব স্পষ্ট।  ২. রোগাক্রান্ত, যার রোগ স্পষ্ট। ৩. পঙ্গু, যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট এবং ৪. আহত, যার কোনো অংগ ভেংগে গেছে। নাসায়ির বর্ণনায় ‘আহত’ শব্দের স্থলে
'পাগল' উল্লেখ রয়েছে। (তিরমিযি-১৫৪৬, নাসায়ি- ৪৩৭১,) তাই পশু ক্রয় করার আগে এই বিষয়গুলো অবশ্যয় লক্ষ্য রাখা জরুরী।

মহিমান্বিত এই কোরবানি একদিকে যেমন প্রভুর সন্তুষ্টির মাধ্যম, অপরদিকে তা সামাজিক স্থিতিশীলতা ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের এক অনন্য সহযোগী। কেন না সমাজে যারা দারিদ্রতার কারণে নিয়মিত গোশত ক্ষেতে পারে না তারা কোরবানি উপলক্ষ্যে সে চাহিদা ভোগ করতে পরছেন। আবার কোরবানির গোশত প্রতিবেশী ও আত্মিয়দেরকে বিতরণের মাধ্যমে সামাজিক দায়িত্ব রক্ষার পাশাপাশি  ভ্রাতৃত্ববন্ধন আরো সুদৃঢ় হচ্ছে।  তবে কখনো কখনো কিছু ভুল আর প্রস্তুতির অভাবে কোরবানির মতো পূণ্যময় এই ইবাদতে যেমন বিগ্ন ঘটে, তেমনি আবার কিছু অসাবধানতার জন্য তা হয়ে উঠে আমাদের পরকালের শাস্তির কারণ। যেমন- কোরবানিকে কেন্দ্র করে যত্রতত্র পশুর হাট বসিয়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা।

কুরবানি উপলক্ষ্যে স্থানীয় জনগন ও প্রশাসনের সহায়তায় নির্দিষ্ট  জায়গায় পশুর হাটের আয়োজন করা হলেও  কোথাও কোথাও প্রশাসনের নির্দেশকে অমান্য করে সড়ক-মহাসড়কে কোরবানির পশুরহাট বসানো হয়ে থাকে। এতে করে ঈদে ঘরমুখো মানুষজন পড়েন ভীষণ যানজটের কবলে । শহরেতো এর চিত্র আরো ভয়ঙ্কর। যারা এই নিয়ম  না মেনে যত্রতত্র হাট বসাচ্ছে তারা কি বুঝতে পারে এতে পথচারী বা আশপাশের কত মানুষ সীমাহীন কষ্টে ভোগছেন? অথচ ইসলামে কাউকে কষ্ট না দেয়ার জন্য বারবার তাগিদ দেয়া হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে কোনো প্রকারের কষ্ট না দেয়। (সহীহ বুখারী:২/৮৮৯)

আবার অনেকেই কোরবানির পশুর সাথে ভালো ব্যবহার করে না। দূরদূরান্ত থেকে কুরবানির পশুকে পায়ে হাটিয়ে আনা হয় অথবা নিয়ে যাওয়া হয়। যেটা মোটেই ঠিক নয়। মনে রাখবেন, কোরবানির মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে ভালবাসার বস্তুকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরবানি করা। তো যে পশুটাকে আপনি কোরবানি করবেন ভাবছেন তার প্রতি যদি আপনার এতটুকু ভালবাসা না জন্মায় তো আপনি কী কোরবানি দিচ্ছেন? ইসলামতো সেই পশুটিকেই কোরবানি করতে বলে, যে পশুটি আপনার সবচেয়ে আদরের।

যে পশুর প্রতি আপনার কোনো মমত্ববোধ নেই, নেই কিঞ্চিত পরিমাণ ভালবাসা, তাহলে সেই পশুর রক্ত প্রবাহিত করে আপনি কিভাবে দয়াময় আল্লাহর সন্তুষ্টির আশা করতে পারেন?  যেখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন স্পষ্ট বলে দিয়েছেন,"আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তাদের গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তাদের তাকওয়াা"...(সূরা আল-হাজ্জ: ৩৭) সুতরাং একজন মানুষের সঙ্গে মানুষের আচরণ যেমন হওয়া উচিত, একটি পশুর প্রতি মানুষের আচরণও ঠিক সেই রকমই হওয়া উচিত।

আবার কিছু অসাধু মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা কোরবানি ঘনিয়ে আসলে ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য, মূল্য বেশি পাওয়ার আশায়, পশুকে ইনজেকশন,পাউডার ও নিষিদ্ধ পাম সেবন করিয়ে মোটাতাজাকরণের প্রক্রিয়া চালায়। যা নিশ্চিত প্রতারণা। আর ইসলামে প্রতারণাকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। রাসূল সা.বলেছেন,"যে ধোকা দেয়, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।"  ( সহীহ মুসলিম, ১০৬)

এই অসাধুভাবে মোটাতাজাকরণপ্রক্রিয়ার ফলে শুধু যে পশুই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়,বরং এর গোশত খেয়ে মানুষের ক্যান্সার,কিডনিসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে। যা মানুষ হত্যার ন্যায় এক জগণ্য অপরাধ। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনুল কারিমে অন্যায়ভাবে হত্যা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপরাধ সম্পর্কে ইরশাদ করেন,"যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করল সে যেন দুনিয়ার সব মানুষকেই হত্যা করল, আর যে কারো প্রাণ রক্ষা করল সে যেন সব মানুষের প্রাণ রক্ষা করল।"(সূরা মায়েদা : ৩২)।

অন্যায়ভাবে হত্যার শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, "কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম, সেখানে সে চিরস্থায়ী হবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন, তাকে লানত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন।" (সূরা নিসা, ৯৩)। সুতরাং যারা এমন হীন কাজে জড়িত তাদের বুঝা উচিৎ এটা কত বড় অন্যায়। আর এর শাস্তি কত ভয়ঙ্কর।

অাবার অামরা যারা কোরবানি দিচ্ছি অনেক সময় তাদেরও অনেক গাফলতি থেকে যায়। যেমন যেখানে সেখানে পশুকে জবাই করা, জবাইকৃত পশুর রক্ত, বর্জ ফেলে রাখা। যার ফলে প্রকৃতি ও পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়ে। আমাদের স্মরণ থাকা থাখা প্রয়োজন যে, অামরা আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। সে হিসেবে অামাদের চলাফেরা, আচার-ব্যবহার, আখলাক- চরিত্র, রুচিবোধ, মননশীলতা সবকিছুই শ্রেষ্ঠ হতে হবে। একই সাথে অামরা সামাজিক জীব হওয়ায়, সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে নিজেদের সুরক্ষার জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সামাজিক পরিবেশকেও রক্ষা করতে হবে। পাশাপাশি জীবনকে আরও সুন্দর ও উপভোগ্য করার জন্য পরিবেশের উন্নতি সাধন করতে হবে। আর সে জন্যই মানবতার ধর্ম ইসলামে পরিষ্কারপরিচ্ছন্নতাকে অনেক গুরুত্ব দেয়াহয়েছে।  আবূ মালেক আশআরী রা.হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, "পবিত্রতা (বাহ্যিক পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা) অর্জন করা হল অর্ধেক ঈমান।" (মুসলিম ২২৩, তিরমিযি ৩৫১৭, ইবন মাজাহ ২৮০, আহমদ ২২৩৯৫, ২২৪০১, দারেমি ৬৫৩)

রাসূল সা.আরও ইরশাদ করেন,"তোমরা পরিবেশকে দূষিত করবে না।" পুকুরের পানি, নদীর পানি, আবদ্ধ জলাশয়ের পানি যেন দূষিত না হয়, সে জন্য প্রিয় রাসূল (সা.) বলেছেন, "আবদ্ধ পানি ও জলাশয়ের পানিতে তোমরা প্রস্রাব করবে না। প্রস্রাব করে তোমরা পানিকে দূষিত করে সেখানে আবার গোসল করবে না।"(মুসলিম শরিফ, হাদিস,৪২৪)।  তাই কোরবানির রক্ত এবং বর্জ আমরা যেখানে সেখানে না ফেলে রেখে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় মাটিচাপা দিয়ে দিতে পারি এবং কোরবানির কাজ শেষ হলে রাস্তায় যেন কোনো রক্ত বা ময়লা আবর্জনা পড়ে না থাকে সে জন্য জবাইকৃত জায়গা পানি দিয়ে ভালো করে ধুয়ে দেয়াও প্র‍য়োজন। এত করে আমরা, আমাদের প্রতিবেশী এবং পথচারীরা বিভিন্ন রোগ সংক্রমনের হাত থেকে রক্ষা পাবো। সম্ভব হলে ব্লিচিং
পাউডারও ছিটিয়ে দিতে পারি।

ভাবুনতো! মহামহিম আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই বিশ্বচরাচরকে কতই না নিখুঁতভাবে গড়েছেন। সাজিয়েছেন আলো ছায়া,ফুল-ফল আর সবুঝ তরুলতার মনোমুগ্ধকর  সৌন্দর্যে। কারণ তিনি চান, তিনি নিজে যেমন  সুন্দর, তেমনি তাঁর আদরের বান্দাররাও সৌন্দর্যের ধারণকারী হয়ে পৃথিবীকে অারো সৌন্দর্যময় করে রাখুক। তাই আসুন! এই মহিমান্বিত কোরবানিতে বনের পশুর সাথে সাথে নিজেদের মনের অপবিত্রতা ও পশুত্বকে কোরবানি করে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সচেষ্ট হয় এবং নিজেদের ভুলগুলো যেন অন্যদের কষ্টের কারণ না হয়ে দাঁড়ায় সেদিকে সতর্কতা অবলম্বন করি।

লেখক : ইমাম ও খতিব, আদ্রা জামে মসজিদ, কসবা, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ