শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


অশুদ্ধ পুরুষ : র্পব ৭

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

monirমনির প্রধান

ফারহি তোমার কি হয়েছে? মনে হয় মন খারাপ? প্রশ্নটা করতে আরাফাতের ইচ্ছে করলেও কেন যেন করতে পারে না। একবার তার বলার ইচ্ছে হয়, শোনো মেয়ে, স্যারদের কাছে কিছু লুকোতে নেই। ভালো-মন্দ সবকিছু স্যারদের সাথে ফ্র্যাংক্লি শেয়ার করতে হয়। স্যার হলো সবচেয়ে বেস্ট ফ্রে-। কথাগুলো আরো একবার বলবো বলবো করেও ফারহিকে বলা হয়নি। বলতে চাইলেই একটা কৌতুকের কথা তার মনে পড়ে যায়। কৌতুকটা এমন....
ক্লাস নাইনের এক ছাত্রীকে তার টিউটর মন খারাপ দেখে বলল, এই, তোমার মন কি কোনো কারণে খারাপ? খবরদার মন খারাপ করে থাকবে না। ভালো-মন্দ যাই কিছু হোক আমাকে বলবে। ভয় পাবে না। টিচার কি ভয় পাবার জিনিস? টিচার হলো ফ্রে-ের মতো। ফ্রে-ের সাথে সবকিছু ফ্র্যাংক্লি শেয়ার করতে হয়। বুঝেছ? মেয়ে কথা বলে না?
জি।
তার পরদিন টিউটর যথারীতি পড়াতে বসে বললেন, দাও, হোমওয়ার্ক দাও।
ছাত্রী হেলে দুলে, ঠোঁট বাঁকা করে বললো, সরি দোস্ত, আইজকাও হোমওয়ার্ক করতে পারি নাই। ভুইলা গেছি।
টিউটর কতক্ষণ হা করে তাকিয়ে থাকার পর কেবল বলতে পারল, সর্বনাশ!
ফারহির বেলায় তেমন কিছু ঘটার আশঙ্কা আরাফাত করে না ঠিক, তবু সে একটা গাম্ভির্য সবসময় বজায় রাখার চেষ্টা করে। খুব বেশি বন্ধুসূলভ আচরণ স্টুডেন্টের সামনে টিচারকে হ্যাংলা বানিয়ে দেয়। ইমেজ নষ্ট হয়ে গেলে পড়া আদায় করা কঠিন। সামান্য দূরত্ব বজায় রাখা ভালো।
ফারহি, পড়াটা শোনাও দেখি। কি যেন পড়া দিয়েছিলাম?
পড়া শুনে আরাফাতের মন খুব খারাপ হয়। ছাব্বিশ দিন ধরে সে ফারহিকে পড়াচ্ছে। এতো ভূল আর কোনোদিনও তার পড়ায় হয়নি। একবার আরাফাতের ইচ্ছে হয় ভুলগুলো এড়িয়ে যেতে। বলতে, হ্যাঁ, মোটামুটি ভালো হয়েছে। এই নাও পুরস্কার।
জোতি তুমি পড়া শিখেছ? প্রশ্নটা করেই আরাফাতের মনে হলো, বেকার প্রশ্ন করা। এই মেয়ে প্রশ্নের উত্তর কখনো দেয় না। শুধু মাথা দুলিয়ে না সূচক উত্তর দেয়। কিন্তু জোতি আজ মাথা নাড়ায় না। মুখে জি বলে পড়া শোনায়। সেই পড়া একদম নির্ভুল না হলেও কোনো অংশে ফারহির চেয়ে খারাপ নয়। এখন? কলমটা কীভাবে দেবে সে ফারহিকে? দিলে জোতিকে দিতে হয়। কিন্তু কলম তো আরাফাত জোতির জন্য আনেনি। এনেছে ফারহির জন্য।
ফারহি গতকাল পড়তে বসনি?
বসেছি।
তবে পড়া হয়নি কেন? এতো ভুল।
স্যার, ইচ্ছে করেই ভুল করেছি।
কেন?
আজ কী বার বলেন তো?
বৃহস্পতিবার। কেন?
বৃহস্পতিবার দিন কিন্তু গল্পের দিন। পড়ার দিন নয়, ঠিক না?
আরাফাতের এক ধরনের রাগ লাগে। বোকা মেয়ে। পড়াটা ঠিকঠাক শুনিয়ে বলতে তো পারতো-স্যার, আজ পড়বো না। বৃহস্পতিবার না আপনার গল্প শোনাবার কথা? আরাফাতের বলতে ইচ্ছে হয়, আচ্ছা, ঠিক আছে, গল্প শোনাব। কিন্তু তার আগে পড়াটা একবার নির্ভুলে শুনিয়ে নাও। ভয়ে বলা হয় না। ফারহির মধ্যে সংকোচবোধ কম। যদি বলে ফেলে, না স্যার, পড়া শোনাবো না আর। গল্প বলেন। তখন ইজ্জত কিছু বাকি থাকবে না।
স্যার রাগ করলেন?
না করিনি। আজ তোমার স্কুল নেই ফারহি?
স্কুল নেই তবে কোচিং আছে।
কোচিং কতক্ষণ হয়?
এই এক ঘণ্টা কি পৌনে এক ঘণ্টা। কখনো সোয়া এক ঘণ্টা।
স্যাররা কী পড়ান কোচিংয়ে?
পড়ান কম। গল্প হাসি মজা হয় বেশি। যা পড়ানোর তা তো ক্লাসেই পড়িয়ে দেন। কোচিংটা শুধুমাত্র টাকা ইনকামের একটা সোর্স।
কতো দিতে হয় কোচিং ফি?
পাঁচশ টাকা।
সবাইকে পাঁচশ করে দিতে হয়? তোমাদের ব্যাচে স্টুডেন্ট কতোজন? চল্লিশ পঞ্চাশজন হবে না?
পঁচাশি জন।
সর্বনাশ, সবাই পাঁচশ টাকা করে দিলে তো অনেক টাকা।
স্যার, এগুলো আলাপ বাদ দেন না। গল্প কখন বলবেন?
গল্প শোনার জন্য ফারহির কণ্ঠে একটা অভিমানী সুর ঝরে পড়ে কি পড়ে না, কিন্তু আরাফাতের কানে তা অভিমানী কণ্ঠ বলেই মনে হয়। কলমটা কী করে দেয়া যায়, এই চিন্তা ছাপিয়ে একটা ভালো গল্প বলার তাড়না সে ভেতরে বোধ করতে থাকে। ভালো কোনো গল্প, মজাদার, যা ফারহির অভিমান দূর করে একচোট হাসাবে, তেমন কোনো গল্প মনে পড়ে না। এমন কিছু সময় আসে যখন চেনা অনেক কিছু অচেনা হয়ে ওঠে।
সে কি ভালোবেসে ফেলেছে ফারহিকে? মেয়েটা শ্যামলা বর্ণের হলেও দেখতে সুন্দর। বড় বড় চোখ। চওড়া কপাল। মায়ের মতো সুন্দর নাক। গোলাপি ঠোঁটের ওপর চমৎকার ছোট্ট একটা তিল। কথাবার্তায় ভালো এবং বিনয়ী। সব মিলিয়ে তেইশ বছরের একটি ছেলের চিন্তা চেতনা গ্রাস করে ফেলার জন্য যথেষ্ট।

লুবনা কি করছিস?
লুবনা চমকে ওঠে। কোন ফাঁকে বাবা দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে সে বলতে পারবে না। লুবনা আনমনা হয়ে ছিল। বাবাটারও কোনো কা-জ্ঞান নেই। বড় মেয়ে, তার ঘরে আসার পূর্বে গলাটলা যে খাকারি দিতে হয় সেটুকু বোধও তার নেই। যতই বাবা মেয়ে হোক, প্রাইভেসি বলে একটা ব্যাপার তো আছে। তার গায়ের কাপড় যদি এলোমেলো থাকতো, নিশ্চই সেটা বাবা এবং মেয়ে কারো জন্যই মনে রাখার মতো স্মৃতি হতো না। কিন্তু বাবা এইসব বিষয় বোঝে না। শুধু এইসব নয়, বাবা আরো অনেক কিছুই বোঝে না। একটা মানুষ খারাপ হলে তার ভেতর থেকে সূক্ষ্ম বিষয়গুলো বিবেচনা করার ক্ষমতা কি এমন করেই নষ্ট হয়ে যায়? হতে পারে।
লুবনা কি করছিস? বাবা আবার জিজ্ঞেস করেন।
কিছু করছি না বাবা। এমনি বসে আছি।
তোর কথার মাথামু-ু কিছু বুঝতে পারি না। এমনি এমনি কেউ বসে থাকে? এমনি এমনি বলে জগতে কোনো কিছু নেই। প্রত্যেক এমনি এমনির পেছনে কিছু না কিছু লুকিয়ে থাকে। হয়তো কোনো কিছু নিয়ে ভাবছিলি। কোনো রিজন তো থাকতেই হবে। রিজন ছাড়া কোনো এমনি এমনি হয় না। এখন বল তোর ব্যাপারটা কি? বলেই নাজমুল হুদা সাহেব হা হা করে কতক্ষণ হাসেন। ‘এমনি এমনি’ মানুষের বলা এই এড়িয়ে যাওয়া বাক্যটা নিয়ে তিনি অনেক ভেবেছেন। তার চিন্তা ভাবনা খুব গভীর নয় বলে কোনো কিছুরই খুব গভীরে যেতে পারেন না। তবু এই ব্যাপারে যতটুকু পেরেছেন তা ফেলে দেবার মতো নয়। নাজমুল হুদা আরেক চোট হাসেন।
কিরে মা, চুপ করে আছিস কেন? কিছু একটা বল।
আমার এমনি এমনির পেছনে কোনো রিজন নেই বাবা। তাছাড়া তোমার ব্যাখ্যাটাও খুব যৌক্তিক হয়নি।
নাজমুল হুদার মন খারাপ হয়, সঙ্গে কি রাগও খানিকটা হন না? গম্ভীর গলায় তার একবার বলতে ইচ্ছে করে, কোন কথাটা অযৌক্তিক বলেছি দেখিয়ে দে। কিন্তু বলেন না। এক ধরনের সংকোচে নিজেকে গুটিয়ে নেন। লুবনাকে তিনি ঠিক বুঝতে পারেন না। কোনো কিছু একটা বলে এর কাছ থেকে পার পাওয়া যায় না। সে একটা না একটা ফাঁক ফোকর বের করে ফেলেই। এই মেয়ের উপস্থিত বুদ্ধি যথেষ্ট ভালো।
মাঝে মাঝে নাজমুল হুদা সাহেব ভাবেন, মেয়েটা কি তাকে সহ্য করতে পারে না? কিন্তু তা কেমন করে হয়। বাবা মা যতো খারাপই হোক সন্তানের চোখে তারা সবসময় বাবা মা-ই। বাবা মা'র প্রতি অন্যরকম ভালোবাসায় তাদের মন সবসময় থাকবে আদ্র। এটাই জগতের শ্বাশ্বত নিয়ম। কিন্তু লুবনার আচরণে এই নিয়মের তেমন ছাপ নেই। তার ব্যাপারে লুবনা এমন কিছু কি জেনে ফেলেছে যা তার জানা উচিত নয়। সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। বাতাসও কথা বলে। কোনোকিছুই চিরকাল চেপে থাকে না।
এই অসীম প্রকৃতিও হয়তো প্রসব বেদনায় ভোগে। সবকিছু প্রসব করার মধ্য দিয়ে নির্ভার হয়। আবার লম্বা একটা ইতিহাসের সব ফিরিস্তি লুকিয়ে ফেলে সময়ের গর্ভে। তারপর সময়ের মাথায় সময়কে গেঁথে গেঁথে গর্ভ পরিপূর্ণ হলে প্রকৃতি আবারও ভুগতে থাকে প্রসব বেদনায়। অপেক্ষা করে মুক্তির।

নাজমুল হুদা পরিবেশটাকে কঠিন থেকে সহজের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। বলেন, একটা গল্প শুনবি মা? খুব মজার গল্প। ক’দিন আগে বইয়ে পড়েছি।
কতোক্ষণ লাগবে গল্প বলতে?
ছোট গল্প। দুই কি তিন মিনিট।
বলো।
এক লোক বুঝেছিস, সারাক্ষণ তাকে মশা কামড়ায়। রাতে কামড়ায়। দিনে কামড়ায়। মশার জ্বালায় মানুষটা অস্থির। রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারে না। মশারি টানালেও কেমন করে যেন মশারা ঢুকে পড়ে মশারির ভেতর। তারপর একদিন সে করলো কি জানিস, ভালো করে সর্বাঙ্গে কাঁথা মুড়ি দিয়ে রাতে শুয়েছে বিছানায়। তবু কাঁথার ভেতর কেমন করে যেন একটা জোনাকি পোকা ঢুকে পড়ল। তাই দেখে মানুষটার সেই কি চিৎকার। ওরে বাবারে বাবা, মশা তো আমাকে টর্চ লাইট দিয়ে খোঁজা শুরু করেছে।
লুবনা ফিক করে হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে বলে, বাবা, এটা তো গল্প নয়। এটা কৌতুক।
নাজমুল হুদা এক হাত জিহ্বা বের করে দুই পাটি দাঁত দিয়ে তা কামড়ে ধরে তারপর বলেন, ওমা, তাইতো, এটা তো গল্প নয়। কৌতুক।
বাবা এবং মেয়ে হাসেন কতোক্ষণ। নাজমুল হুদার চোখ না ভিজলেও ভেতরটা কি ভিজে ওঠে না? কতোদিন পর লুবনাটা তার সঙ্গে হেসে কথা বলল।
বাবা?
কিরে মা?
একটা কথা বলি?
বলতে কি নিষেধ আছে?
তুমি আমাদের সঙ্গে যেমন হেসে হেসে কথা বল, আমার সঙ্গে, ফারহির সঙ্গে, নিশাদের সঙ্গে। মার সঙ্গে কখনো তা বলো না। একটু ট্রাই করে দেখো, দেখবে এই সংসারে আর কোনো অশান্তি থাকবে না। আমাদের কোন জিনিসটার অভাব আছে বলো? গাড়ি, বাড়ি, টাকা পয়সা, আসবাবপত্র সব আছে। কেবল বড় একটা জিনিসের অভাব। তোমার এবং মার মনের মিল। একটা ফ্যামিলিতে সমস্যা তো থাকবেই। কিন্তু একটু কমপ্রোমাইজ কি করা যায় না?
নাজমুল হুদা কোনো উত্তর দেন না। অচেনা একরকম মুখভঙ্গি করে বসে থাকেন। শরতের আকাশে মেঘ জমলে শরৎকে যেমন শরৎ বলে মনে হয় না, বাবাকে দেখেও লুবনার এই অনুভূতি হয়। তারপরও সে সাহস করে বলে, বাবা আমরা কতো বড় হয়েছি। এটা তো লজ্জার হলেও বাস্তব কথা যে, ক’দিন বাদে আমাদের বিয়ে সাদির ব্যাপার আছে। এসব শুনলে মানুষ কি আত্মীয়তা করতে এগিয়ে আসবে? তাছাড়া এ পাড়ায় তুমি একমাত্র ব্যক্তি কলেজে পড়াও। তোমার কতো বড় সামাজিক একটা সম্মান আছে। মানুষ এসব শুনে কি হাসবে না?
ওপরে ওপরে গাম্ভীর্য ধরে রাখলেও ভেতরে ভেতরে নাজমুল হুদা আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। এই পাড়ায় তিনিই একমাত্র লোক, যিনি সতেরো বছর ধরে কলেজে অধ্যাপনা করেন। পাড়ায় প্রাইমারি টিচার, হাই স্কুল মাস্টার, হেড মাস্টার, অন্যান্য চাকুরের অভাব নেই। তাদের পাড়াটা গ্রামবাংলার মধ্যবিত্ত সচেতন শিক্ষিত পাড়ার আদর্শ উদাহরণ।
নাজমুল হুদা মুখে সামান্য হাসি টেনে বলেন, তুই দেখি আচ্ছা মেয়ে! বাবাকে নিজের বিয়ের কথা অনায়াসে বলে ফেলিস। এখনকার ছেলেমেয়েদের লজ্জা শরম নেই বললেই চলে। ছিঃ।
লুবনার এই ভয়টা হয়েছিল। বাবা এই জায়গাটা ধরে ফেলতে পারে ভাবনাটা ভেবেছিল সে। বাবাটার মধ্যে কিছুমাত্র গভীরতা নেই।
নাজমুল হুদা মেয়েকে লজ্জাবতিগাছের মতো লজ্জায় ডুবিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে যান। রওশন আরার ব্যাপারে তিনি আপোষহীন। রওশনের বাবা তার হাতে কেন তুলে দিয়েছিলেন তার মেয়েকে? তার কি ভাত কাপড়ের অভাব ছিল? তার হাতে রওশনকে তুলে দেয়া হয়েছিল শুধু কি ভাত কাপড়ের জন্য? স্ত্রীর চাহিদাই যদি তাকে দিয়ে না মেটে তবে আবার কমপ্রোমাইজ কিসের। বিছানায় প্রতি রাতে তার নারীসঙ্গ প্রয়োজন। অথচ রওশন বলে সপ্তাহে দু’এক রাতের কথা। এমন স্ত্রীর সঙ্গে নাজমুল হুদার কোনো কমপ্রোমাইজ নেই। অসম্ভব। ডাক্তার বলেছিল, কিছু দুর্বলতা রওশনের আছে। শারীরিক। একটা বয়সের পর অনেকেরই তা হয়। কিন্তু চিকিৎসার দিকে রওশনের আহামরি মনোযোগ আছে বলে তার মনে হয় না। ওষুধ পাতিগুলো সে যতেœর সাথে খায় কি না খেয়াল রাখা প্রয়োজন, ভাবেন নাজমুল।

এসএস


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ