শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


প্রবাসে ভাষার গল্প

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

 

languages copyইমরান আনোয়ার : আমাদের গ্রামে প্রবাসীদের সংখ্যা বিস্ময়করভাবে বেশি। গড়ে প্রায় দু'জন করে প্রতি ঘর থেকে বিদেশে রয়েছেন।এই বিদেশ-ফেরত মানুষগুলো যখন আরবিতে কথা বলতেন, শুনে আমার মনে ক্ষোভ জমা হত। এরা কী সব আরবি বলে! শুদ্ধ আরবি তো দূরের কথা, অশুদ্ধ আরবিরও ধারেকাছে নেই তাঁদের বলা শব্দগুলো। আরবি ভাষার এহেন 'অপদস্থ রূপ' দেখে আমাদের মত বিশুদ্ধ আরবি চর্চাকারীদের কুন্ঠিত হতে হত! ভাবতাম, যারা বিদেশে গিয়েছেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সবাই বুঝি সে দেশের পাড়া-মহল্লাগুলোতে অবস্থান করেছেন। ফলে স্থানীয়দের গাঁয়ের ভাষা শুনে তাদেরও এমন আরবি শিখতে হয়েছে। ব্যপারটি আদৌ তেমন নয়। মাদরাসা অথবা কোন আরবি প্রতিষ্ঠানে যাদের পড়াশোনা হয়নি, কিংবা আরবির সাথে যাদের সংস্পর্শ প্রায় শূন্যের কোঠায়, তারা এখানে এসে নিজেদের পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষার জন্য একটি অসম্পূর্ণ 'সাংকেতিক' ভাষা ব্যবহার করেন। হাত-পা নাড়িয়ে, কাজ চলে যায় এমন স্থানীয় শব্দ ব্যবহার করে সবাই নিজেদের জরুরত পূরণ করে নেন। ফলে এ ভাষাটিই হয়ে যায় প্রবাসীদের জন্য একটি সর্বজনীন যোগাযোগ-মাধ্যম । সবাই পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে ভাঙ্গা শব্দগুলো দিয়েই একটি পূর্ণ অর্থ অনুধাবন করে নিতে চেষ্টা করেন। ব্যাস, এই ছিল মূলত আমাদের গ্রামের প্রবাসীদের কথা, যা এক সময় বিরক্তিকর মনে হলেও এখানে এসে ব্যপারটি বরং অত্যাবশ্যকীয় মনে হয়।

কাতার ইউনিভার্সিটিতে অ্যাডমিশন নেওয়ার জন্য আমাকে বাধ্যতামূলক IELTS করতে হয়েছে। যদিও পরবর্তীতে ইসলামিক স্টাডিজ-এর জন্য এ রিকুয়াইরমেন্ট টি বাদ দেওয়া হয়, তবে ২০১২'তে আমার প্রথম আবেদনের সময় এটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। প্রথম যখন কাতারে আসি, আমার সম্বল ছিল বারো বছরের পুস্তকীয় আরবি এবং দু'বছরের কষ্টসাধ্য ইংলিশ! আগে ভালভাবে ইংরেজি পড়লেও হঠাৎ করে 'আইএলটিএস' দেওয়াটা অবশ্যই আমার জন্য শঙ্কার বিষয় ছিল। আল্লাহ'র অশেষ দয়ায় ফলাফল তবু প্রশংসাযোগ্য হয়েছে; আলহামদুলিল্লাহ্‌। মূল ঘটনাটি বলছি। স্থানীয় সময় বেলা এগারোটার দিকে আমাদের বহন করা বিমানটি যখন এখানে এসে পৌঁছুল, ইমিগ্রেশন পার হয়ে আমি লাগেজ সংগ্রহ করে বের হবার পথ খুঁজছিলাম। একজনকে 'বেরুবার পথটি কোথায়' ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করাতে লোকটি আমার দিকে এমনভাবে তাকাল, আমি তো সম্ভব হলে দৌড়ে পালিয়ে বাঁচি! দেখতে নিরীহ এবং সুন্নতি লেবাস পরা কেউ একজন তার কাছে এভাবে ইংরেজিতে কিছু জানতে চেয়েছে; ব্যপারটি নিশ্চয়ই তার কাছে অবিশ্বাস্য লেগেছে! আঞ্চলিক আরবি এবং ডান হাতের ইশারায় তিনি আমাকে বেরুবার পথ খুঁজে পেতে সাহায্য করলেন। হুম, প্রথম প্র্যাকটিক্যালি শিক্ষা হল, আরব দেশে ইংরেজি কিংবা ভিনদেশী ভাষা আমাদের চেয়েও বেশি ভীতিজনক!

কাতারে এসে এখানকার স্থানীয় ভাষা বুঝে নিতে আমার দু'বছরের মত সময় লেগেছে। ঠিক একই কারণে আমাদের শেখা বইয়ের ভাষা ব্যবহার করতে অনেক সময় সঙ্কোচ বোধ করেছি। আমাদের ভাষা শুনে তারা অবাক হয়; আর আমরা সেটা বলতে যেয়ে হয়ে পড়ি লজ্জিত, দ্বিধাগ্রস্ত! ভাবি, কিছু ভুল হয়ে যায়নি তো! অথচ আমাদের 'ফাসীহ' আরবি শুনে তাদের যারপরনাই আনন্দিত হতে দেখি। কখনো কখনো অবলীলায় তারা সেটি প্রকাশও করে থাকে। যতটুকু দেখেছি, সাধারণত সুদান, সিরিয়া, এবং আলজেরিয়ার মানুষগুলো শুদ্ধ আরবিতে কথা বলেন। কাতারি, ইয়েমেনি, সৌদিয়ান, ইরাকি, ফিলিস্তিনিরা তাঁদের আঞ্চলিক ভাষাতে কথা বললেও খুব একটা দুর্বোধ্য মনে হয়না তাঁদের সে ভাষা। প্রয়োজনে বিশুদ্ধ আরবি বলাতেও তাদের অনীহা নেই! বিপরীতে সবচেয়ে অসংলগ্ন-অস্পষ্ট ভাষার ব্যবহার দেখেছি মিসরিদের মধ্যে। এতটা আঞ্চলিক ও জটিল বচনভঙ্গি তাদের যে, সেটি কখনো কখনো কানের পীড়া সৃষ্টি করে। মিসরিরা তাঁদের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারে এমন গোঁড়ামির পরিচয় দেন, যে কারণে তাদের সাথে সাধারণ কুশল বিনিময়েরও আগ্রহ চলে যায়। ঠিক কী বলতে চাইছে সেটি বুঝতেই যে বেশ গলদগর্ম হতে হয় মানুষের! জর্দানের আঞ্চলিক ভাষাটিও কখনো কখনো বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়! মিসরিদের মত তাদেরও রয়েছে আঞ্চলিক ভাষা-প্রীতি। অবশ্য এগুলো একান্তই আমার পর্যবেক্ষণ। নিজে যা দেখেছি তাই তুলে ধরলাম। কেউ আমার সাথে একমত না হতে চাইলে তার মতামতের প্রতিও আমার শ্রদ্ধা থাকবে।

আরবি অথবা ইংরেজি হল কাতারের অফিশিয়াল ভাষা। এছাড়া ফরাসী ভাষারও বেশ কদর রয়েছে এ দেশে। কিন্তু আমাদের উপমহাদেশের সাধারণ শ্রমিক শ্রেণী, অথবা অন্যান্য কর্মজীবি মানুষ প্রথম দেখাতে নিজেদের মাঝে কোন ভাষাটি ব্যবহার করেন? উত্তরটি বিস্ময়ের হলেও সততার সঙ্গে বলতে হবে, সে ভাষাটি হল 'হিন্দি'। বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল কিংবা এশিয়ার আরো যেসব দেশের মানুষ এখানে কর্মরত আছেন, তারা আনঅফিশিয়ালি হিন্দি ভাষা-ই ব্যবহার করে থাকেন। প্রথম প্রথম আমার মনে হত, আমি একজন বাংলাদেশি। কেউ প্রয়োজনে আমার সাথে আরবিতে, ইংরেজিতে অথবা আমার ভাষায় কথা বলবে। আমি কেন তার সাথে হিন্দিতে কথা বলতে যাব? বাস্তবতা হল, এ অঞ্চলে ভারত উপমহাদেশের সুদীর্ঘ বাণিজ্য ইতিহাস এবং কাজ ও ব্যবসার জন্য আসা অগণিত মানুষের বিচরণে এখানে হিন্দি এবং উর্দু ভাষা খুব সহজে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে আপনি না চাইলেও বাধ্য হয়ে আপনাকে উর্দু বা হিন্দিতেই কথা বলতে হবে। প্রবাসে এলে নানামুখী অভিজ্ঞতায় মানুষের অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ হয়। সে সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতার অন্যতম অধ্যায় থাকে নতুন ভাষা শিক্ষা। কেউ আরবি শিখেন, কেউ শিখেন ইংরেজি। কারো কারো আবার 'মনপুত নয়' এমন ভাষাও শিখতে হয়। এভাবেই যে প্রবাস জীবনকে এগিয়ে নিতে হয় প্রয়োজনের সাথে তাল মিলিয়ে।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, কাতার বিশ্ববিদ্যালয়। এবং ইমাম, মসজিদে শাইখ হামাদ বিন খলীফা আল থানি, উম্মে কুরাইবাহ, যুবারা, কাতার।

এফএফ


সম্পর্কিত খবর