শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


অশুদ্ধ পুরুষ- র্পব ৬

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

monir

মনরি প্রধান; আওয়ার ইসলাম

চার
ডিসকভারি চ্যানেলে চমৎকার অনুষ্ঠান হচ্ছিল। গভীর জঙ্গলে হারিয়ে গেলে কীভাবে বেঁচে থাকতে হবে তাই অনুষ্ঠানের উপজিব্য বিষয়। মানুষটা পোকামাকড় ধরে, সাপ বিচ্ছু ধরে অনায়াসে খেয়ে ফেলে। দেখলে গা ঘিন ঘিন করে ওঠে। আশপাশের চোখে পড়ে না এমন জিনিসগুলোও চমৎকারভাবে কাজে লাগায় লোকটা। অন্য সময় রওশন আরা মনোযোগ দিয়ে অনুষ্ঠানগুলো দেখেন। ডিসকভারিতে এই লোকের মাঝে মাঝেই অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। লোকটার নাম রওশন একবার কার কাছে যেন শুনেছিলেন। বোধহয় কঠিন টাইপের নাম। মনে নেই। অনুষ্ঠান দেখার সময় লোকটার বিচক্ষণতা দেখে কেবলই নাম জানতে ইচ্ছে করে। অনুষ্ঠান শেষ হলে পরে আর মনে থাকে না।

সাইফুল সোফায় হেলান দিয়ে বসে ছিল। একটু দূরেই রওশন। রাত সাড়ে বারোটার কাছাকাছি। ঘরে অন্য কেউ নেই। সাইফুল কয়েকবার চেষ্টা করেছিল, নাজমুল হুদার সাথে শেষ পর্যন্ত আলাপ জমে ওঠেনি। তিনি ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছেন। রওশন কয়েকবার বলেন, সাইফুল, যা শুয়ে পড়। মাসুমা একা একা। মন খারাপ করবে। সাইফুল বলে, না আপা, ও আলাদা রকম। গিয়ে দেখো, নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে।
কী আশ্চর্য, মাসুমা নাক ডাকে নাকি?
আরে নাহ, কথার কথা বললাম।

তারপর অনেকক্ষণ দু’ভাইবোন কারো মুখে কথা নেই। যেন একটি শূন্য ঘর। কেউ নেই এখানে। কেবল একটা নীরবতা প্রকটভাবে তার অস্তিত্বের ডালপালা মেলে ধরে রাখে। কিংবা না বলতে পারা কথাগুলোকে নীরবতার তরজমায় রূপ দেয় দু’জন। হৃদয় থাকলে নীরবতার ভাষা বোঝা এমন কিছু কঠিন কাজ নয়।

সাইফুল বলে, আপা, দুলাভাই বোধহয় কোনো কারণে আনইজি ফিল করছে। আমাকে সহজভাবে নিতে পারছে না। এর আগে কিন্তু এমন দেখিনি কখনো।
না সাইফুল, এটা তোর মনের ধারণা কেবল। বাস্তব এমন কিছু নয়।
মনের ধারণা নয় আপা। সেটা আমি যেমন বুঝতে পারছি তুমিও তেমন বুঝতে পারছো। আপা, কিছু বিষয় আমরা অর্থহীনভাবে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করি। যেতে পারলেও লাভ কি হয়? অশান্তিটুকু মনের ভেতর ঠিকই দানা বেঁধে থাকে। বলো তো ব্যাপারটা কি?
চোখে একটা অসহায়ত্ব এনে রওশন চেয়ে থাকে সাইফুলের দিকে। সে কি করে বলবে- সাইফুল আজ রাত আমাদের বিছানায় জেগে কাটানোর রাত। সপ্তাহে নির্দিষ্ট দু’দিনই আমরা বিছানায় যাই। সোমবার, বৃহস্পতিবার।

সাইফুল রওশনের চোখের অসহায়ত্ব বুঝতে পারে না। সে প্রশ্নের উত্তর পেতে চায়। দুলাভাইয়ের আচরণে যে অপমানিত সে হয়েছে, তার কারণটুকু জানতে চাওয়ার ইচ্ছা বড় হয়ে ওঠে। অন্য কারো চোখের ভাষা বুঝতে পারা নয়।
তোরা তো জানিস সাইফুল, তোদের দুলাভাই খুব সেনসেটিভ। কী নিয়ে কখন কি মনে করে বসে আগ থেকে বলা যায় না। হয়তো আজ বিকেলে তোকে জড়িয়ে ধরাটা সে মেনে নিতে পারেনি। রওশন এইটুকু বলেই থেমে যান। বলেন না, সন্ধ্যার পর এ নিয়ে কি দারুণ জঘন্য কয়েকটা কথা তাকে শুনিয়েছেন নাজমুল।

আপা, এই কুৎসিত মনের মানুষটার সঙ্গে তুমি যে সংসার করছো এটা বিশাল ব্যাপার। আমি এমন হলে মাসুমা আমাকে একটা লাথি মেরে চলে যেতো। সৃষ্টিকর্তা তোমার জন্য কি পুরষ্কার রেখে দিয়েছেন তিনিই জানেন।
তোর দুলাভাই বলে অন্য কথা। তার কাছে আমি দাইয়ুজ একজন নারী। স্বামীকে সন্তুষ্ট না করতে পারলে স্ত্রী কখনো স্বর্গে যেতে পারে না। এই কথাটা সবসময় সে শোনায়। এ নিয়ে আমার ভেতর কোনো দুঃখবোধ নেই। আমার সবচেয়ে বড় দুঃখটা কোন জায়গায় জানিস, বাবা বলেন, ও কেমন একটা মেয়ে, সামান্য স্বামীর মন জুগিয়ে চলতে পারে না। এই কথাটা মনে পড়লে সাইফুল মরে যেতে ইচ্ছে হয়। এই দুঃখটা আমি সমগ্র জীবনেও ভুলতে পারবো না। ঝড়ের মতো উঠে আসা কান্নাটাকে ঠোঁট কামড়ে আটকে রাখেন রওশন। কয়েকফোটা অশ্রু গড়িয়ে নামে গাল বেয়ে। এ এমন এক অশ্রু যা হাত উঠিয়ে মুছে ফেলতে ইচ্ছে করে না।

রওশন আরা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন। তার বড় মনে পড়তে থাকে সেই দিনগুলোর কথা। সেই ছেলেটার কথা। সাহস করে যার হাতে হাত রাখতে পারলে সত্যিই জীবনে হয়তো আলাদা কিছু ঘটতে পারতো।

তেইশ চব্বিশ বছরের যুবকরা ঘুমালেই দারুণ সব স্বপ্ন দেখে। বিচিত্র বর্ণের রূপবতী নারী এসে ভিড় জমায় বিছানায়। তারুণ্য পেরিয়ে কঠিন যৌবনের দিকে এগুতে থাকা এ বয়সটা একদম নির্ভার। পড়াশোনা ছাড়া আর কোনো টেনশান নেই। সংসারের ঝুট-ঝামেলা নিয়ে এদের ভাবতে হয় না। চোখে সারাদিন খেলা করে স্বপ্ন। তারুণ্যের দারুণ উচ্ছাসে সমস্ত পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় পেতে ইচ্ছে করে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি ছেলেও দেখে- তার ভবিষ্যৎ জীবন ভরে উঠছে গাড়িতে, বাড়িতে, অর্থ প্রাচুর্যে আর সুন্দরী নারীদের রমণীয় কোলাহলে।

আরাফাতের বয়স তেইশ বছর হলেও তাকে এই ক্যাটাগরিতে ফেলা যায় না। তার জীবন ভাবনাহীন জীবন নয়। আরাফাতের বাবা নেই। মা এবং তিন ভাইবোনের সংসার। বড় ভাই শাহাদাত টুকটাক ব্যবসাপাতি করে। তার রোজগারে কি ঠিকঠাক সংসার চলে? চলে না। ঠিকঠাক না চললেও দিন যায়। মাস যায়। বছর পেরিয়ে নতুন বছর আসে। এই তো দেখতে দেখতে চৌদ্দ পেরিয়ে পনের সাল চলে এলো। জগৎ সংসারের কিছুই থেমে থাকে না।

বোনটা আরাফাতের ছোট। বয়স ষোল’র কাছাকাছি। রূপে আহ্লাদে ফেটে পড়ার মতো বয়স।
সংসার নামক কঠিন বোঝা যদিও আরাফাতকে বইতে হয় না তবু সারাক্ষণ তার অস্থিরতায় কাটে। শাহাদাত তার পড়াশোনা চালিয়ে নেয়াটা পছন্দ করছে না। সংসার পরিচালনায় বড় ভাইকে সে সহযোগিতা করুক এই তার ইচ্ছা। এ নিয়ে ঝগড়া-ঝাটি না হলেও দু’ভাইয়ের ভেতর নীরব একটা মনোমালিন্য আছে। আরাফাত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। স্বচ্ছল জীবন যাপনের জন্য না হলেও গঠনমূলক একটা জীবন তৈরি করার জন্য পড়াশোনাটা খুব বেশি প্রয়োজন। শাহাদাতের হাব-ভাব খারাপ। আগে চুপচাপ থাকলেও ইদানিং দু’এক কথা দিয়ে মনের অসন্তোষ প্রকাশ করতে সে কার্পণ্য করছে না। সেদিন খাবার টেবিলে কথায় কথায় বলেই ফেলল, আমাদের গোটা বংশে কেউ সেভেন এইটের ওপর পড়েছিল? এসএসসি পাস করলি, ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছিস, এখন ক্ষ্যান্ত হ। আমাকে কাজে কর্মে সহযোগিতা কর। দুনিয়াটা যে কত কঠিন তা কাজে নামলেই বুঝতে পারবি। কী এক শিক্ষিত হওয়ার রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়াস!

এমন বৈরী বলয় ভেঙ্গে আরাফাত কতদিন চালিয়ে নিতে পারবে সে জানে না। এই নিয়ে সারাক্ষণ তার দুঃশ্চিন্তা হয়। এর প্রতিক্রিয়া হয় ঘুমের মধ্যেও। ভয়ঙ্কর সব স্বপ্ন দেখে ঘুমালে।

ভোরের দিকে আজও আরাফাতের ঘুম ভাঙে আতঙ্ক নিয়ে। বাজে স্বপ্নগুলোকে পরাজিত করার সুযোগ কি তার জীবনে কখনো আসবে না? হালকা শীতের সকালে কাঁথা মুড়ি দিয়ে এই ভাবনাটা ভাবতে থাকে আরাফাত ।

এখন আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি। বাঁশের বেড়ার ফাঁকফোকর গলে ঠা-া বাতাস এসে গায়ে লাগে। বাড়াবাড়ি রকমের আরামদায়ক স্পর্শ। গায়ের ওপর থেকে কাঁথা সরিয়ে দেবার ইচ্ছা হলেও সরিয়ে দেয়া হয় না। ঋতুচক্রের হিসেব অনুযায়ী পৌষ মাঘ এই দুইমাস হলো শীতকাল। কিন্তু উত্তরাঞ্চলে কার্ত্তিকের শুরুর দিকেই মোটামুটি তীব্র শীত শুরু হয়। নানান কারণে প্রকৃতিও এখন নিয়ম ভাঙা শুরু করেছে। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব যখন নিয়ম নীতির বালাই মানে না, তখন প্রকৃতির কাছেও ঠিকঠাক কিছু আশা করা যায় না।

লিসা এসে বলল, তুই এমন কেন ভাইয়া, সুযোগ পেলেই মাকে বকাঝকা করিস। মা খুব রাগ করেছে।
আরাফাত নিজেই গতকাল মাকে বলেছিল, মা সকাল সাড়ে ছটায় ডেকে দিয়ো তো। বেচারি ডেকেছেন এবং যথারীতি অন্যায়ভাবে বকা ঝকা খেয়েছেন। এইসবের কিছুই এখন তার মনে নেই। ঘুমের ভেতর কী বলে-না বলে পরে সেসবের কিছুই সে মনে করতে পারে না। মা কখন ডেকেছেন আর সে-ই বা কি বলেছে মাকে কে জানে।
লিসা তুই স্কুলে যাবি না আজ?
যাবো, কেন?
মা কি আমার ওপর খুব বেশি রাগ করেছে?
মনে হয় করেছে।
এখন কী করি বলতো?
মার কাছে ক্ষমা চাও।
না ক্ষমা চাবো না।
কেন চাইলে ক্ষতি কি?

মা যে আমাদের নানান সময় অন্যায়ভাবে নানান কথা বলে, মা কি কখনো বলেছে, ভুল ভাল বলেছি, দুঃখ নিস না। যে মা অন্যায় করে সরিটুকু বলতে পারে না, তার সন্তানরা সরি বাদ দিয়ে সরাসরি হাত পা ধরে মাফ চাবে। এমন আজগুবি ভাবনাটা তুই ভাবলি কেমন করে।
তোমার এইসব কাটখোট্টা যুক্তি আমার ভালো লাগে না ভাইয়া।

তোর মুখে আর একটা কথাও শুনতে চাই না লিসা। এই মুহূর্তে তুই আমার সামনে থেকে বিদেয় হবি। জাস্ট অর্ডার।
আর কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার প্রাণপণ ইচ্ছাকে প্রশ্রয় দিলে চলবে কেন। মানুষ হয়ে জন্ম নেবার অপরাধÑঅনেক যন্ত্রণা দেয় মানুষকে। মনের ইচ্ছাটাকে কখনো মন ভরে উপভোগ করা যায় না। যান্ত্রিক জীপন যাপন করতে গিয়ে অনেক কিছু পাশ কেটে চলতে হয়। এখানেই মানুষ আর রোবটের মাঝে পার্থক্য। রোবটের মাঝে যান্ত্রিকতা আছে কিন্তু অপ্রাপ্তির হাহাকার নেই। আর মানুষ নিজেকে যান্ত্রিকতায় বাঁধার পর সবসময় অপ্রাপ্তির হাহাকারে দগ্ধ হতে থাকে।

আজকের সূর্যটা কি প্রতিদিনের চেয়ে সামান্য বড়? একটু বেশি সুন্দর? আরাফাত বিছানায় বসে রক্তিম সূর্যের দিকে চেয়ে থাকে অনেক্ষণ। আচ্ছন্নের মতো। ষোড়শীর নুপুর পড়া পায়ের রিণিঝিণি শব্দ কানে এলে মন যেমন আচ্ছন্ন হয়, তেমন। প্রতিটি মানুষের ভেতর একজন কবি হয়তো বাস করে। মনের আবেগকে কলমে আঁকতে পারে না বলেই সবাই কবি হয়ে উঠতে পারে না। যেই সূর্যটি আজ আরাফাতের চোখে আলাদা মনে হচ্ছে তা প্রতিদিনই ওঠে। সারাদিন আলো ছড়িয়ে একসময় অস্ত যায় পশ্চিমের আকাশে। মানুষ কোনো কোনো দিন সাধারণ কিছু একটা দেখেও সীমাহীন মুগ্ধ হয়।
সূর্যের প্রতি মুগ্ধতা নিয়ে বসে থাকলে অন্য কাজ তো এগুবে না। এই সকালবেলা ফারহি এবং যোতিকে তার পড়াতে হয়। মেয়ে দুটোকে পড়াতে তার ভালো লাগে। তারচেয়েও বড় কথা পড়াতে যাবার আগে মার রাগ ভাঙ্গিয়ে যেতে হবে।

জামিলের মা গতকাল সাতশ টাকা দিয়েছিল। একমাস পড়ানোর টিউশন ফি। আজকাল এতো কমে কেউ কি টিউশনি করে? টাউনের আর দু’একটা ছেলের খবর আরাফাত রাখে। টিউশন ফি দিয়ে তাদের পাং পয়তারার শেষ নেই। দু’তিনমাসের টিউশন ফি জমিয়ে একেকজন মোবাইল ফোন কেনে। দামি এনড্রয়েড মোবাইল। হাজার পনেরোশ টাকার নিচে টিউশনি আছে নাকি আজকাল? যারা ব্যাচ করে প্রাইভেট পড়ায় তাদের ফি ও চার পাঁচশ টাকা। শুধু তার কপালটাই হয়তো মন্দ। সাতশ টাকা থেকে মাকে আরাফাত দিয়েছে পাঁচশ। নিজের কাছে রেখেছে দু’শ। সেই টাকা থেকে কিছু না ভেবেই ফারহিকে দেবে বলে সে একটা কলম কেনে। খুব দামি নয়। পয়ত্রিশ টাকা মাত্র। তবুও তো উপহার। আভিজাত্যের চেয়ে যেখানে ভালোবাসার স্পর্শ বেশি। ভালোবাসার সামনে মাথা উঁচু করে এমন কী আছে এই পৃথিবীতে?

কিন্তু এই সকালবেলা পড়াতে বসে আরাফাত কিছুতেই কলমটা দিতে পারে না ফারহিকে। কেমন যেন একটা দ্বিধা। একটা অসংকোচ। মনে হয় কলমটা দেয়ার জন্য কিছু একটা উপলক্ষ্য প্রয়োজন। কী হতে পারে সেই উপলক্ষ্য? ‘বাহ্, ফারহি আজকের পড়া তো খুব সুন্দর করে শিখেছ! আমি মুগ্ধ। এই নাও আমার এই কলমটা খুশি হয়ে তোমাকে দিলাম। গতকালই কিনেছি। একদম নতুন।’
আজও কি ফারহির মন সামান্য খারাপ? মুখ কি খানিকটা মলিন দেখাচ্ছে? একটা অস্বস্তি মনে জমাট বাঁধতে থাকে। কলমটা কোনো একটা ছুতো ধরে না দিতে পারলে হয়তো তার ভালো লাগবে না। চলবে...

এসএস


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ