শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


নামাজে মনযোগ ধরে রাখার সহজ উপায়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

Muslim-praying2

মাওলানা ইমরান আনোয়ার; আওয়ার ইসলাম

প্রতিটি মানুষের অবস্থান ও পদমর্যাদা অনুসারে আমরা তাদের সম্মান প্রদর্শন করে থাকি। কোন অফিসিয়াল কাজে অংশগ্রহণের জন্য আমাদের যেমন প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়, তারচেয়ে একেবারেই ভিন্ন হয় বন্ধুদের সাথে দেখা করার বেলায়। এ ব্যপারটি ভেবে নিয়ে বলা যায়, প্রতিদিন অন্তত পাঁচবার বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের রাজাধিরাজ মহান স্রষ্টার সাথে আমাদের মুলাকাত হয়। আমরা কি আমাদের শরীর ও আত্মাকে সেজন্য ভালভাবে প্রস্তুত করি? সত্যিই কি আমরা উপলব্ধি করতে পারি আসলে কার সাথে আমরা কথা বলতে যাচ্ছি? এবং কত মহান ও ক্ষমতাসম্পন্ন সেই স্রষ্টা- তা কি আমাদের ধারণা আছে?

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কুরআনে বলেছেন, "তারা আল্লাহকে যথার্থরূপে বোঝেনি। কেয়ামতের দিন গোটা পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মুঠোতে এবং আসমান সমূহ ভাঁজ করা অবস্থায় থাকবে তাঁর ডান হাতে। তিনি পবিত্র। আর এরা যাকে শরীক করে, তা থেকে তিনি অনেক উর্ধ্বে।"
একবার এক ইহুদি আলেম নবীজির কাছে আসলেন। এসে তাঁকে বললেন, "হে মুহাম্মাদ! নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা, যিনি আপন মহিমায় উজ্জ্বল এবং সুমহান মর্যাদার অধিকারী, কেয়ামতের দিন পুরো জান্নাতকে তাঁর আঙ্গুলের ডগায় নিয়ে আসবেন। অন্য আঙ্গুলে পুরো পৃথিবীকে, গাছপালা এবং পাহাড় পর্বতকে আরেকটি ভিন্ন আঙ্গুলে এবং সাগর-নদী ও বৃষ্টিকে তাঁর অপর আঙ্গুলে বহন করবেন। আসলে পুরো সৃষ্টিজগতকেই তিনি তাঁর এক আঙ্গুলে জড়ো করে ফেলবেন। তারপর সেগুলোকে তিনি ঝাঁকুনি দিবেন এবং বলবেন, "আমি তোমাদের প্রভু, আমি তোমাদের প্রভু"!

এ কথা শুনে আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হাসলেন। ইহুদি আলেমের কথাকে স্বীকৃতি দিলেন তিনি। তারপর উপরোল্লিখিত আয়াতটি পাঠ করলেন রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)।

প্রতিটি অজুর আগে আপনি গভীর মনোযোগে ভাবুন, আপনি কার দেখা পেতে যাচ্ছেন এবং কার সাথে আপনার কথা হবে! তিনি সাধারণ কেউ নন, তিনি আল্লাহ, মহা পরাক্রমশালী, সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী। এতে করে আমাদের নামাজে মনোযোগ ধরে রাখা সহজ হবে; নামাজ সুন্দরও হবে। আসলে কী, নামাজের জন্য মানসিক-আধ্যাত্মিক এবং শারীরিক প্রস্তুতিই হল অজু। নামাজ শুদ্ধ হওয়ার জন্য অজু হল অবশ্যকরণীয় আমল। রাসুল (সা) বলেছেন, "যে ব্যক্তি অজু ব্যতিত নামাজ পড়বে, তার নামাজ কবুল হবেনা"।

আচ্ছা, আমি যদি অজু না করি কেউ কি সেটা জানবে? নাকি কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করবে- কেন তুমি অজু করনি? তাহলে অযথা কষ্ট করে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে অজু করার কী প্রয়োজন? এ কথাগুলো কি কখনো আমাদের মাথায় এসেছে? এর সহজ উত্তর হল, "না"। বাস্তবতা হল, অজু আমাদের ঈমানকে সতেজ করে তোলে এবং আমাদেরকে খুব সুন্দর পবিত্রতা শিক্ষা দেয়। অজুর মাধ্যমে আমাদের মনে এ বিশ্বাস প্রোথিত হয় যে, আল্লাহ হলেন 'আল বাছীর' 'আল খাবীর'। কেউ না জানলে কী হবে, আল্লাহ তো জানেন। শেষ বিচারের দিনে একমাত্র তাঁর হাতেই থাকবে সার্বভৌম ক্ষমতা এবং আমাকে তাঁর সামনে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।

অজুর যথাযথ নিয়ম
এটা তো জানা কথা, আমরা যখন একাগ্রতার সাথে অজু করি, ফলশ্রুতিতে আমাদের নামাজও শ্রেষ্ঠতর হয়। আল্লাহর শুকরিয়া যে, অজু কিভাবে করতে হয় তা আমাদের সবারই জানা আছে। তারপরও, আরো সুন্দর অজু আদায়ে নিচে কিছু পরামর্শ দেওয়া হল। আশা করি আমরা সবাই এতে উপকৃত হব।

বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু করা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, "যে ব্যক্তি অজুতে আল্লাহর নাম স্মরণ করেনি (বিসমিল্লাহ পড়েনি) তার অজু অপরিপূর্ণ"! যদিও অজু সুন্নত নাকি ওয়াজিব তা নিয়ে ফুকাহায়ে কিরামের মাঝে ইখতিলাফ আছে, তবে মূল আলোচনা সেটি নয়। আসল কথা হল, অজু শুরু করার আগে আমাদের অবশ্যই 'বিসমিল্লাহ' পড়তে চেষ্টা করা উচিৎ।

প্রতিটি অঙ্গ ভালভাবে ধৌত করা
দ্রুত অজু করতে গিয়ে শরীরের প্রয়োজনীয় কোন অংশ যেন বাদ না পড়ে যায়- সেটি খেয়াল রাখা উচিৎ। প্রতিটি অঙ্গ ভালভাবে ধৌত করতে হবে। হযরত উমর বিন খাত্তাব (রা) বলেন, "একবার এক ব্যক্তি নামাজের জন্য অজু করে এল। কিন্তু নখের সমপরিমাণ অজুর যায়গা তাতে বাদ পড়ে যায়। আল্লাহর রাসুল সেটি দেখলেন এবং লোকটিকে বললেন, "ফিরে গিয়ে ভাল করে অজু করে এসো"। তখন লোকটি আবারো অজু করে এসে নামাজ আদায় করে"। পা এবং বাহুতে পানি ব্যবহারের সময় একটু বেশি জায়গা ধৌত করা বাঞ্ছনীয়। হযরত নুমান বিন আব্দুল্লাহ (রহ) বলেন, "আমি আবু হুরাইরাকে (রা) অজু করতে দেখেছি। তিনি তাঁর মুখ ধৌত করেছেন এবং সেটি খুব ভালভাবে ধৌত করেছেন। তারপর তিনি তাঁর ডান হাত ধুয়েছেন বাহুতে একটু অংশ বাড়িয়ে। তারপর তিনি তাঁর বাম হাত ধুয়েছেন বাহু্তে একটু অংশ বাড়িয়ে। অতঃপর তিনি তাঁর মাথা মাসেহ করেছেন। পরে তিনি তাঁর ডান পা ধুয়েছেন পায়ের নালি সহকারে। এমনিভাবে বাম পা ধুয়েছেন পায়ের নালি সহকারে। শেষে তিনি বলেছেন; "আমি এভাবেই আল্লাহর রাসুলকে (সা) অজু করতে দেখেছি"। আবু হুরাইরা (রা) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা) বলেছেন, "তোমাদের পরিপূর্ণ অজুর কারণে কেয়ামতের দিন তোমাদের হাত-পা এবং চেহারাকে দীপ্তিমান দেখাবে। তোমাদের মধ্যে যে সামর্থ্যবান, সে যেন তার হাত-পা এবং চেহারার উজ্জল্য বাড়িয়ে নেয়।"

আরো পড়ুন কিভাবে আল্লাহর প্রিয় পাত্র হবেন?

প্রতিটি নামাজের জন্য আলাদা অজু করা
যদিও 'অজু ভাঙ্গার কোন কারণ সংঘটিত না হলে' এক অজুতেই একাধিক নামাজ আদায় করা যায়, তবে নবীজির (সা) সুন্নত হল, প্রতিবেলা আলাদা অজু করা। এটি খুব সহজ একটি ব্যপার। প্রতিটি ওয়াক্তে আলাদা অজু করে নবীজির (সা) ঘোষিত পুরষ্কার অর্জন করে নিন। একবার হযরত আনাসকে (রা) অজু সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল; উত্তরে তিনি বলেন, "নবীজি (সা) প্রতিটি নামাজের জন্য আলাদা অজু করতেন আর আমরা একই অজু দিয়ে অনেক নামাজ আদায় করতাম।"

মেসওয়াক ব্যবহার করা
প্রতিটি অজুর সময় মেসওয়াক ব্যবহারে যত্নবান হোন। আল্লাহর রাসুল (সা) বলেছেন, "যদি না আমার উম্মতের জন্য এটি কষ্টকর মনে করতাম, তবে প্রতি নামাজের সময় তাদেরকে মেসওয়াক করার জন্য নির্দেশ দিতাম।"

অজুর পর দোয়া পাঠ
আপনি কি আকাঙ্ক্ষা করেন জান্নাতের আটটি দরজা দিয়েই আপনার নাম ঘোষণা করা হবে? সেটি চাইলে প্রাত্যহিক নিচের জিকিরগুলো চর্চা করুন। আল্লাহর রাসুল (সা) বলেছেন, "কেউ যদি পরিপূর্ণভাবে অজু করার পর নিচের দোয়াটি পাঠ করে, "আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু", "আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ব্যতিত আর কোন উপাস্য নেই। তিনি এক, তাঁর কোন শরিক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও রাসুল"; তাঁর জন্য (এ দোয়াটি যে পাঠ করবে তাঁর জন্য) জান্নাতের আটটি দরজাই খুলে দেওয়া হবে এবং তাঁর ইচ্ছেমত যে কোন দরজা দিয়েই সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।"

ভালভাবে অজু আদায়ের পুরষ্কার
মানুষ হিসেবে আমরা দুর্বল। আমরা গুনাহ করি এবং আমাদের দিয়ে অনেক অপরাধ সঙ্ঘটিত হয়। তারপরও, আল্লাহ তায়ালা অতীব দয়ালু এবং আমাদের প্রতি ক্ষমাশীল! তিনি 'আল গাফুর' গুণে গুণান্বিত। তিনি আমাদের জন্য তাঁর ক্ষমা লাভের অসংখ্য উপায় সাজিয়ে রেখেছেন। অজু হল তার একটি। আল্লাহর রাসুল (সা) বলেছেন, "যখন একজন মুমিন/মুসলমান অজু করে, তখন- সে তার চোখ দিয়ে যে গুনাহগুলো করেছে, পানি ঝরার সময় সেগুলো তার চেহারা থেকে ধুয়ে-মুছে যাবে। অথবা পানির শেষ বিন্দুটি ঝরে পড়ার সময় (সেগুলো ঝরে যাবে)। যখন সে তার হাত ধোয়, সেগুলো দিয়ে যে গুনাহ হয়েছে তা পানির সাথে সাথে হাত থেকে ঝরে পড়বে। অথবা পানির শেষ বিন্দুটি ঝরে পড়ার সময় (সেগুলো ঝরে যাবে)। যখন সে তার পা ধৌত করে, যে অপরাধগুলোয় সে তার পা বাড়িয়েছে, তা পানির সাথে সাথে ঝরে পড়বে। অথবা পানির শেষ বিন্দুটি ঝরে পড়ার সময় (সেগুলো ঝরে যাবে)। এভাবে সে তার সকল গুনাহ থেকে নিষ্কলুষ হয়ে ফিরবে।" আল্লাহ আমাদের সবাইকে নিয়মিত পবিত্রতা অর্জনের তৌফিক দান করুন এবং আমাদেরকে তার ক্ষমাপ্রাপ্ত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে নিন।

লেখক: শিক্ষার্থী, কাতার বিশ্ববিদ্যালয়। ইমাম, মসজিদে শাইখ হামাদ আল-থানি, উম্মে কুরাইবাহ, কাতার।

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ