শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


আমার জলশৈশব । ৩য় পর্ব । আমার প্রেমপত্ররা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

salahuddin3

সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর অতিথি লেখক, আওয়ার ইসলাম

‘পুকুরেতে পানি নাই পাতা তবু ভাসে
যার সাথে দেখা নাই সে কেন হাসে’

আমার কৈশোরকালের একটা সময় কেটেছে বিখ্যাত ‘পত্রলেখক’ হিসেবে। নানাধর্মী পত্র- বাবাপত্র, মাপত্র, প্রবাসী ভাইপত্র, দূরে থাকা বন্ধুপত্র এবং অতি আবশ্যিক প্রেমপত্র। প্রেমপত্রের লেখক হিসেবে আমার আলাদা সুনাম ছিলো বন্ধু এবং ভাই বেরাদরমহলে।

ছড়া-কবিতার হাতসাফাইটা তখন কেবল মশক করছি, প্রেমপত্রের স্পর্শকাতর জায়গাগুলোতে সাঁৎ করে নিজের দু-চার লাইন রবি, নজরুল, দাশ ঢুকিয়ে দিচ্ছি। বেশ লাগতো। যারা ঘাগু প্রেমিক তারা তো এমন কলজেছেঁচা পদগুচ্ছ দেখে দাঁত কেলিয়ে দিতো- এবার লিপি আক্তার বগলদাবা না হয়েই যায় না! শালার কবিতার ছন্দের মাজেজা দেখছোস!!

তবে সমস্যা হতো আনকোরা নয়া প্রেমিকদের নিয়ে। প্রেমে কেবল নতুন বা প্রথম প্রেমপত্র অথবা প্রেমিকা নতুন; এরা প্রেমপত্রের ব্যাপারে কোনো রিস্ক নিতে চাইতো না। তাদের জন্য প্রয়োজন পড়তো ট্র্যাডিশনাল গীত ছন্দের। যেগুলো আমাদের গ্রামীণ প্রেমসমাজে প্রচলিত ছিলো।
যেমন-
‘আকাশেতে লক্ষ তারা চাঁদ কিন্তু একা
এই জীবনে কবে বন্ধু পাবো তোমার দেখা’

আপনারা জানেন কি-না জানি না, এসব ছন্দের জন্য ছোট ছোট পুস্তিকা পাওয়া যেতো। চটি সাইজের। প্রেমিক সাহেবানরা নিজ গরজে এসব ছন্দের বই পত্র লেখার প্রাক্কালে লেখক সমীপে প্রেরণ করতো। সেসব ছন্দের মধ্যেও শ্রেণিবিন্যাস ছিলো। প্রথম প্রেম, প্রেমবিরহ, বিচ্ছেদ, দুষ্টু প্রেম, হঠাৎ বৃষ্টি টাইপের প্রেম...। অনেক সময় প্রেমিক বা প্রেমিকা নিজেরাই ছন্দ নির্বাচন করে দিতো। আমার কাজ ছিলো পত্রের গতিবেগ ঠিক রেখে যুৎসই জায়গায় মায়াবী স্পিনের মতো দু লাইন ছন্দ সেঁধিয়ে দেয়া।

অন্যের প্রেমপত্র লেখার মধ্যে এক ধরনের গোপন এ্যাডভেঞ্চার থাকে।

একদিনের কথা বলি। ‘বিশ্বপ্রেমিক’ বলে খ্যাত আমার এক চাচাতো ভাইকে একটা প্রেমপত্র লিখে দিচ্ছি। চিঠির সম্ভাব্য প্রাপক আমাদেরই এক আত্মীয়, সম্পর্কে মামাতো বোন। বড় বড় চোখের কৃষ্ণকলি চেহারার বালিকা।

চিঠি লিখছি। পত্রের সম্ভাব্য প্রেরক চাচাতো ভাই পাশে বসে আছে। আরও দু-তিন চাচাতো ভাই ঘরের জানালা ফোঁকড় দিয়ে এদিক সেদিক ইতিউতি করে মুরব্বিদের আনাগোনা পরখ করছে। আমার প্রেমপত্র তখন চরম ক্লাইমেক্সে চলে এসেছে, একেবারে গদগদ টাইপের ছড়া ছন্দ ঢেলে দিচ্ছি। চাচাতো ভাই পাশে বসে হাত কচলাচ্ছে- আজ দফারফা কিছু একটা হয়ে যাবে!

এমন সময় দড়াম করে ঘরের দরোজা খুলে গেলো। মূর্তিমান আব্বা দণ্ডায়মান! ...এ্যাই, কী করোস তোরা?

আমরা যার যার জায়গায় স্লো মোশনের মতো স্থিরচিত্র হয়ে গেলাম। আব্বা আর্মির সদ্য অবসরপ্রাপ্ত চরম বদরাগী সার্জেন্ট। থাবড়িয়ে গ্রামের দু-তিনজনকে পেশাব করানোর রেকর্ড তার একক দখলে। আমি নিজের লুঙ্গির উপর পূর্ণ আস্থা রাখতে চেষ্টা করলাম। বারবার খাবি খাচ্ছি!

prempotro

এমন সঙ্গীন মুহূর্তে ঘরে উপস্থিত সবচে ভীতু চাচাতো ভাইটা একটা কাজের কাজ করলো। ঘরের অন্যপাশের দরজা দিয়ে ঝেড়ে একটা দৌড় দিলো। জানি না লুঙ্গি ভেজার ভয়েই কি-না! তবে লুঙ্গি ভেজানোর ভয় সবারই আছে। আমারও! আব্বা আমাদের কাছে আসতে আসতেই উসাইন বোল্টকে নিজের গুরু মেনে লুঙ্গিসমেত দে দৌড়। ধুর! কোথায় রইলো তোর প্রেমপত্র। জান বাঁচানো ফরজ। প্রেমপত্র সরাসরি তালুবন্দি হলো আব্বার হাতে।

সারাদিন আব্বা বাড়ির যে অঞ্চলে থাকেন, আমরা তার থেকে শত হাত দূর দিয়ে ঘোরাঘুরি করলাম। কিন্তু অবাক হয়ে সারাদিন লক্ষ করলাম, আব্বা আমাদের ব্যাপারে কোনো এ্যাকশনে যাচ্ছেন না। দিন গিয়ে রাত, তবুও না! আমাদের সময় কাটতো লাগলো চরম আতঙ্কে। শেষমেশ কোনো এক রহস্যময় কারণে প্রেমপত্র বিষয়ক অপরাধে আমাদের নামে কোনো মামলা পারিবারিক আদালতে উত্থাপিত হলো না। আমরাও অনাকাঙ্ক্ষিত লুঙ্গিবিষয়ক লজ্জাষ্কর বিষয় থেকে রেহাই পেলাম।

তবে মামলা না হওয়ার সেই অমীমাংসিত রহস্য বুঝেছিলাম বহুদিন পর।

আব্বা হয়তো সেদিনই বুঝতে পেরেছিলেন, প্রেমপত্র লেখুক আর যাই লেখুক, ছেলে কিন্তু লেখে খারাপ না! এরপর থেকে আমার একদিক থেকে লাভই হয়েছিলো, লেখালেখির ব্যাপারে আব্বা আমাকে কখনো অনুৎসাহিত করেননি। বরং উৎসাহই দিয়েছেন। এখনও আমার লেখার অন্যতম ভক্ত আমার আব্বা! যেকোনো পত্রিকা আব্বার কাছে নিয়ে গেলে প্রথমেই আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, তোর লেখা আছে নাকি? আমার কোনো বই বের হলে এর প্রথম পাঠক আব্বা। আব্বা যদিও আমার বইযের কোনো খুঁৎ-চুক ধরে না, তবে পাঠক হিসেবে আব্বা বরাবরই মনোযোগী।

আব্বা হয়তো কোনোদিন জানতেও পারবেন না, আমার লেখালেখির ব্যাপারে তার এই উদার মানসিকতা আমাকে কতোটা মানবিক করেছে, কতোটা মহামানব করেছে। আপনাকে সালাম!

সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর : কবি, ঔপন্যাসিক

আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম / আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ