বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১০ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫


ধারাবাহিক উপন্যাস : অশুদ্ধ পুরুষ ৫

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

monirমনির প্রধান: জীবন যুদ্ধের আট থেকে বার ঘণ্টা পরিশ্রমের ক্লান্তি যেমন মাঝেমধ্যে জীবনকে বিষিয়ে তোলে, অফুরন্ত অবসরও কখনো তেমন মনে হয়। মানুষের সৃষ্টিই হয়েছে কিছু না কিছু করার জন্য। রাশেদের ভালো লাগে না। কিছু একটা করতে হবে ভাবলেও সে কিছুতেই হাত দেয় না। অধিক অবসর মানুষকে ধীরে ধীরে অকর্মণ্য বানিয়ে দেয়। রাশেদ এখন অপেক্ষা করে একটি পরম সান্নিধ্য। একটি নতুন অভিজ্ঞতার।

তুমি আরাফাত?
জি।
ফারহিকে পড়াও?
জি।
কী পড়াও?
এই তো, ইংরেজি, বাংলা, অংক সব।
কেমন পড়াও?

প্রশ্নটা অবিবেচকের মতো হয়ে গেছে বুঝতে পেরে নাজমুল হুদা সাহেব প্রশ্নটা এড়িয়ে আবার নতুন প্রশ্ন করেন। ফারহি পড়াশোনায় ভালো তো? কেমন বোঝো?
ফারহি পড়াশোনায় খুব ভালো।

মেয়ের প্রশংসা শুনে নাজমুল হুদা হয়তো মনে মনে গর্ববোধ করেন। অস্পষ্ট এক চিলতে হাসি খেলে যায় তার দু’চোখের কোণ বেয়ে।

আমার সবগুলো ছেলেমেয়ের বুদ্ধিশুদ্ধি ভালো। এদেরকে নিয়ে আমার উচ্চাশা আছে। ইচ্ছে আছে ফারহিকে ডাক্তার বানাবো। ফাইভে ও বৃত্তি পেয়েছিল। খুব ব্রিলিয়ান্ট। বড় মেয়ে লুবনাও ফাইভে বৃত্তি পেয়েছে। এসএসসি’র রেজাল্টও ছিল ভালো। গোল্ডেন এ-প্লাস। ফারহিকে ভালোভাবে গাইড কোরো। অবশ্য তুমি নাকি খুব ভালোই পড়াও শুনেছি। ভালোর মধ্যেও যেন সেরা ভালোটা হয়। ঠিক আছে?
জি ভাইয়া।
হোয়াট! তুমি কি আমাকে ভাইয়া বললে?
জি।

তোমার সাথে আমার বয়সের ডিফারেন্স কতো জানো? কম হলেও ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর। তোমার বয়সী আমার একটা মেয়ে আছে। আমাকে ভাইয়া সম্বোধন তোমার জন্য কোনোভাবেই যায় না।
আরাফাত চুপচাপ বসে থাকে। বর্তমান সমাজে দাদার বয়সী মানুষকেও ভাইয়া বললে আনন্দিত হয়। না, সবাই আনন্দিত হয় না। যারা নিজেকে খানিকটা উগ্র আধুনিক ভাবতে ভালোবাসে তারা আনন্দিত হয়। ফারহির বাবা ভদ্রলোক বুঝি ওই টাইপের মানুষ নন। এর পরেও তিনি এতোটা রিএ্যাক্ট করবেন আরাফাত ভাবতে পারেনি।

আরাফাতের দোষ কি। সে নিরুপায়। প্রথম যেদিন সে পড়াতে আসে সেদিনই ফারহির মা তাকে বললেন, তুমি আমার ছোট ভাইয়ের মতো। ফারহিকে নিজের ভাগ্নি মনে করে পড়াবে। এ কথা এই জন্য বললাম, শুনেছি তুমি খুব ভালো স্টুডেন্ট। একটু বেশি যতœ করে পড়ালে ফারহি নিশ্চয়ই ভালো পারবে। ফাইভে ওর বৃত্তি আছে। আমি চাই জেএসসিতেও খুব ভালো রেজাল্ট যেন সে করে। ফাউন্ডেশন যার যতো মজবুত তার ওপরটাও ততো ভালো।

ব্যাখ্যাটাই আরাফাতের কানে চট করে বেজে উঠেছিল। ভদ্র মহিলার মনে নিশ্চই কিন্তু আছে। নইলে ফারহিকে তার ভাগ্নি বানিয়ে দিয়ে ব্যাখ্যায় যেতেন না। মানুষ তখনই ব্যাখ্যায় যায়, যখন তার মাঝে খুব সূক্ষ্ম হলেও অপরাধবোধ তৈরি হয়। ভদ্র মহিলা কি ভেবে রেখেছেন আরাফাত পড়াতে যেয়ে ফারহির সাথে প্রেম করবে? ভাবলেও তা খুব অমূলক হবে না। টিউটর ছাত্রীর প্রেমে পড়ে, কিংবা ছাত্রী নিজেই টিউটরের প্রেমে হাবুডুবু খায় এটা স্বভাবসিদ্ধ ব্যাপার। এমন অহরহ ঘটে। সেই ভাবনা থেকেই হয়তো ফারহির মা তাদেরকে মামা-ভাগ্নি বানিয়ে দিয়েছেন। রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে বাসের হেলপার, মুদি দোকানের মালিক, অপরিচিত যে কেউ এখন সবাই সবার মামা। এই সমাজে ‘মামা’ এখন সবচেয়ে নিরাপদ সম্বোধনের নাম।

ফারহির গায়ের রং শ্যামলা বর্ণের। বড় বোন এবং মা’র চেয়ে আলাদা হয়েছে মেয়েটা। লুবনা অবশ্য খুবই সুন্দরী। দুধে আলতা বলে যে একটা ব্যাপার আছে লুবনার গায়ের রং তাই। সব মিলিয়ে লুবনা ওই পর্যায়ের মেয়ে, যাকে দেখে যে কোনো পুরুষই বাছবিচার ছাড়া চট করে প্রেমে পড়ে যায়। আর আরাফাত? লুবনাকে প্রথম দেখার দৃশ্যটা কি এখনো সে লালন করে না? ভুলে যাওয়ার মতো হলেও কিছু কিছু বিষয় মানুষ ভুলতে চায় না। স্ব-যতেœ জমা করে রাখে। রাখলে আনন্দ হয়।

ফারহির মা রওশন আরাও এককালে দারুণ রূপবতী ছিলেন বোঝা যায়। কতো হবে ভদ্র মহিলার বয়স? আরাফাতের পক্ষে আন্দাজ করা কঠিন। ভদ্র মহিলার শরীরের গাঁথুনি ভালো। শরীরের কোনো স্থানে এখনো বাড়তি মেদ জমেনি। সম্ভবত চল্লিশ পেরুনো বয়সেও ভদ্র মহিলা দারুণ আকর্ষণীয়।
ফারহির মা’র যে জিনিসটা আরাফাতের সবচেয়ে সুন্দর মনে হয়, তা হলো ভদ্র মহিলার চোখ। চোখ দুটো সারাক্ষণ যেন কথা বলে। একদিন ফারহিকে পড়িয়ে শেষ করার পর রওশন আরা ঘরে এলেন। তিনি হয়তো কোথাও যাবেন। হালকা সাজগোজ করেছেন। চোখে দিয়েছেন কাজল। কাজলটা ঠিক মানায়নি। দেখে আরাফাতের মনে হলো চোখ দুটোর সৌন্দর্য অনেকটাই কমে গেছে যেন। সামনে বসে থাকা নারীটি যদি ফারহির মা না হয়ে তার গার্লফ্রে- হতো তাহলে আরাফাত অবশ্যই বলতো- তোমার ওই খালি চোখ দুটোই আমাকে বেঁধে রাখার জন্য যথেষ্ট। বাড়তি কাজলের প্রয়োজন নেই।

আরাফাত?
জি ভাইয়া।
তোমার মুখে ভাইয়া শুনে নিজেকে কম দামি কম দামি মনে হচ্ছে। ভাইয়া বলবে না, বুঝেছো?
জি।
স্যার বলবে। আচ্ছা থাক, বাড়িতেও স্যার স্যার ভালো লাগবে না। তুমি আমাকে আঙ্কেল ডেকো।
কিন্তু ফারহির আম্মুকে আমি আপা বলি।
তাই নাকি?
জি।
তাহলে ফারহি, লুবনা, নিশাদ সবার তুমি মামা?
জি।
লুবনাও তোমাকে মামা বলে?
তার সাথে কথা হয়েছে দু’একদিন। মামা টামা কিছুই বলেনি।
আমার বয়সী একটা মেয়ে আমাকে মামা বলে ডাকলে এমন বাড়িতে আমি পড়াতেই আসতাম না। কথাটা বলেই নাজমুল হুদা সাহেব প্রাণ খুলে একচোট হাসেন।

পঞ্চাশের পর মানুষের বয়স যতো বেশি বাড়তে থাকে মন ততো বেশি তরল হয়। অল্পের ভেতর থেকেই তখন দারুণ সব হাসির উপকরণ বেরিয়ে আসে। নয়তো এই মামা বিষয়ক সামান্য কথার মাঝে দীর্ঘ সময় হাসার কী হলো আরাফাত বুঝতে পারে না। এটা ঠিক যে, লুবনা এবং ফারহি দু’জনের কেউ-ই তাকে এই পর্যন্ত মামা বলেনি। ফারহি সবসময়ই স্যার। জোতির অবস্থা খিচুড়ির মতো। কখনো মামা, কখনো স্যার। আরাফাত ইচ্ছে করেই কখনো এমন করেছে যে কোনো একটা পড়া বুঝিয়ে দিয়ে ‘ফারহি বুঝেছো’ না বলে, বলেছে ‘মামা বুঝতে পেরেছো’? মামা ডাকে ফারহি কখনো খুশি হয়েছে এমনটা তার চোখে পড়েনি। বরঞ্চ তার মুখ খানিকটা শক্ত হয়ে উঠেছিল। কঠিন স্বরে সে উত্তর দিয়েছে, জি স্যার।

আরাফাত বোঝে মেয়েটা ধীরে ধীরে তার দিকে ঝুকে পড়ছে। বয়স বাইশ তেইশ বছর হলে তাতে কি? এই বয়সেও আরাফাত অনেক বেশি ম্যাচিউড। সে ফারহির এই ঝুঁকে পড়াকে প্রশ্রয় দেয় না। আবার শক্ত কিছুও বলতে পারে না। তেরো- চৌদ্দ বছর বয়সের মেয়েগুলো বড় অভিমানী হয়। এদের সাথে কথা বলতে হয় হিসেব করে। কষ্ট অনুভবের প্রক্রিয়াটা এদের অনেক বিশাল।

প্রশ্রয় না দিলেও ফারহির এই দুর্বলতায় আরাফাত কি মনে মনে আনন্দ পায় না? সম্পর্ক যা-ই হোক, একটি কিশোরী মেয়ে যখন কোনো ছেলের প্রতি দুর্বল হয়, তার এই দুর্বলতা ছেলেটির চিত্তের গভীরে নৃত্য হয়ে ঠিকই ঝুমুর ঝুমুর বাজতে থাকে। এটা মানুষের এক আদিম চরিত্র। এই আদিমতা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। যেদিন মুক্তি ঘটবে সেদিন মানুষ আর মানুষ থাকবে না। পৃথিবী ভরে উঠবে কতগুলো যন্ত্র মানবে। যন্ত্র মানবকে সবাই বোধহয় রোবটই বলে।

বাস থেকে নেমে রওশন আরা উদ্দেশ্যহীনভাবে এদিক সেদিক কতক্ষণ হাঁটেন। তার মোবাইল ফোনে ব্যালেন্স ছিল ত্রিশ পঁয়ত্রিশ টাকার মতো। তার পরেও ফ্ল্যাক্সির দোকানে গিয়ে পঞ্চাশটা টাকা ফ্ল্যাক্সি করে আরো কিছু সময় কাটান। বাড়ির দিকে যেতে তার ভালো লাগে না। ইচ্ছে হয় এমন করে হেঁটে হেঁটেই যদি জীবন পার করে দেয়া যেতো। আগে তেমন নামাজ কালামের ধার ধারতেন না। ইদানিং রওশন আরা নামাজ কালাম ধরেছেন। সবগুলো সূরা ঠিক শুদ্ধ মতো পড়তে পারেন না। একজন ছোট মোট হুজুর রেখে সূরাগুলো শুদ্ধ করে নেয়ার পরিকল্পনা তার আছে। সময় বের করতে পারলেই হুজুর রাখা হবে। মানুষ যখন বিপদে পড়ে তখনই কেবল সৃষ্টিকর্তার কথা মনে হয়। তার আদেশ নিষেধের কথা মনে হয়।
বাড়িতে এসে রওশন আরার মন একদম ভালো হয়ে গেল। তার ছোট ভাই এসেছে বেড়াতে। সাথে তার নতুন বউ। আনন্দের অতিশয্যে রওশন আরা ছোট ভাইকে জড়িয়ে ধরেন। তার চোখ বেয়ে ক’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে নেমে হারিয়ে যায় নতুন জামদানি শাড়িটার বেগুনি রঙের গায়ে। ছোট ভাইয়ের বউকে বুকে টেনে রওশন আরা জিজ্ঞেস করেন, তারপর, তোমরা ভালো তো?
জি আপা।
বিয়ের পর দেখছি শুকিয়ে গেছ অনেক। এতো বেশি ডাইট কন্ট্রোল করো না। ওতে ক্ষতি হয়। আর সাইফুল তুই, নতুন বউকে নিয়ে সট সট করে চলে এলি, ফোন করে জানালি না পর্যন্ত। মাথায় কি তোর কোনো বুদ্ধিশুদ্ধি নেই! এসেছিস কখন?
এই তো এলাম। বিশ মিনিটও পেরোয়নি। এসে চাইলাম ফোন দিতে। দুলাভাই বললো, তুমি এখনই চলে আসবে।
রওশন আরা স্বামীর দিকে তাকান। নাজমুল হুদাকে দেখে তার মনে হয় কোনো কারণে সে সাইফুলের ওপর রেগে আছে। কিন্তু কেন? আজ সোমবার, সপ্তাহের তৃতীয় দিন বলে? নাকি খানিক আগে সাইফুলকে জড়িয়ে ধরাটা তার পছন্দ হয়নি। রওশন ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করার চষ্টো করেন। সন্দেহ প্রবণ মানুষের মাঝে অপারাধ প্রবণতা বেশি থাকে। এদের একমাত্র কাজ হলো কোনোকিছু দেখলে একটা দোষ খুঁজে বের করা। ফুলবাগানের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে ফুলের সৌন্দর্য এদের চোখে পড়ে না। গাছ ভর্তি কাঁটা দেখে কপাল কুঁচকে যায়। রওশনের কাছে নাজমুল এই ক্যাটাগড়ির মানুষ । রওশনের মনে হয় না, সাইফুলকে জড়িয়ে ধরা নিয়ে নাজমুল কিছু না বলে থাকতে পারবে। কোনো এক ফাঁকে সম্ভবত সে নিচু এবং চাপা কণ্ঠে বলবে, এভাবে যাকে তাকে জড়িয়ে ধরা আমার মোটেও পছন্দ নয়।
সাইফুল তার ভাই, নিশ্চই যাকে তাকের মধ্যে সে অন্তর্ভুক্ত নয়। এই বিষয়টুকু নিয়ে যৌক্তিকভাবে একটা নাতি দীর্ঘ বক্তৃতা দেয়া রওশনের পক্ষে সহজ। কিন্তু কী লাভ! নাজমুল হুদা বলে কথা। সে ‘বিচার কী হবে হোক, তালগাছ আমার’ টাইপের মানুষ।

বাজার সদাই করার ব্যাপারে নাজমুল হুদা যথেষ্ট হিসেবি হলেও আজ ভালো বাজার করেন। যতো খারাপই হোক প্রত্যেকটা মানুষের ভেতর কিছু না কিছু ভালো দিক থাকে। রওশন আরার বাপের দিকের আত্মীয় স্বজনকে নাজমুল হুদা যথেষ্ট সম্মান করেন। কথা বার্তায়, আদরে আপ্পায়নে তার ছাপ দেখা যায়। পোলাও চাল তিন কেজি, খাসির মাংস, ইলিশমাছ, কিছু তরু-তরকারি এবং ভালো দই মিষ্টি হাতে বাড়ি ফেরেন নাজমুল। ফ্রিজে ডিম ছিল। গরুর মাংস ছিল। ছোট মাছ ছিল। কাজেই ছোট ভাইকে মন ভরে খাওয়াতে রওশনের সমস্যা হয় না। চোখের পানি, ঘামের পারি একাকার করা কষ্টের রান্না খাওয়ানোতে নারী জাতি যে আনন্দ খুঁজে পান, তা না পেলে মানব জাতির কপালে ভালো দুর্ভোগ ছিল। নারীদের এমন কিছু অসামান্য গুণের কারণেই হয়তো টিকে থাকে ভালোবাসা। স্থায়ী হয় পরিবার। আমাদের যাপিত জীবনের বেঁচে থাকার অবলম্বন।

নতুন মামির সাথে লুবনার টুকটাক কথা হয়। কেমন আছেন, ভালো আছি জাতীয় কথা। এর বাইরে নতুন মামির সঙ্গে ভাব জমানোর জন্য কতো রকম কথা থাকে। কিন্তু লুবনা বলার তেমন আগ্রহ বোধ করে না। তার এই নতুন মামিটা খুব সুবিধার নয়। এমন কথা লুবনার কানে এসেছে। বিয়ের পর থেকেই নাকি মামার সঙ্গে তার বনিবনা হয় না।
লুবনার চাইতে ফারহি আরো একধাপ এগিয়ে। একবার নতুন মামির সামনে পড়তে পড়তে কীভাবে যে সে পার পেল আল্লাহ মাবুদ জানেন। বড় লাজুক হয়ে জন্মেছে মেয়েটা। এতো বেশি যে, কখনো কখনো তা অসহ্য বোধ হয়।
নাজমুল হুদাও কেমন ঝিম মেরে রইলেন। গাল গল্পে, রস কৌতুকে তার আগ্রহ দেখা গেল কম। অথচ শ্যালক শ্যালকের নতুন বউ, প্রচুর রস কৌতুকের সুযোগ ছিল।
মামা-মামির জন্য ফারহিকে তার রুম ছেড়ে দিতে হয়। সে ঘুমাতে যায় লুবনার রুমে। বড় আপার রুমটা ফারহির সীমাহীন পছন্দ। এই পছন্দের কারণ চমৎকার দুটো পেইন্টিং। দুটো পেইন্টিংই প্রকা-। দেয়ালের প্রায় পুরোটা জায়গা জুড়ে। একটা খোলা সমুদ্রের। সমুদ্রের শেষ প্রান্তে সকালের প্রথম সূর্যোদয়ের হলুদ আভা চিকমিক করছে। একঝাক পাখি লাইন ধরে উড়ে যাচ্ছে বিন্দু বিন্দু কালো রঙের মতো। দেখলেই মনে হয় একদম সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সমুদ্রের স্বচ্ছ বাতাস এসে পরশ দিয়ে যাচ্ছে গায়ে।
অন্য পেইন্টিংটি জলরঙে আঁকা পাহাড়ের দৃশ্য। সম্পূর্ণটা পাহাড় নয়। মরুভূমির মতো বিশাল খালি জায়গা। একপাশে বড় বড় টিলা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। পাথুরে ভূমির কোথাও বিভিন্ন আকারের লতাগুল্ম জন্মেছে। পেইন্টিংটা অনেকটাই ওয়েস্টার্ন জীবন যাত্রার কথা মনে করিয়ে দেয়।
একই ঘরে সাগর এবং মরুভূমি দুই প্রান্তের দুটি দৃশ্য যদিও খাপছাড়া লাগে, কিন্তু আলাদা আলাদা দেখলে দুটো পেইন্টিংই অসাধারণ। ফারহি অসংখ্যবার লুবনাকে বলেছে, আপা, যে কোনো একটা ছবি আমাকে দাও প্লিজ। যেটা তোমার কম পছন্দের সেটাই দাও। তবুও চলবে। লুবনা রাজি হয়নি। বলেছে বাবাকে নিয়ে মার্কেট থেকে কিনে নে। না করেছে কে। ফারহি বাবাকে নিয়ে তন্ন তন্ন করে মার্কেটের কোন দোকানটাতে খোঁজেনি? এখন ফারহির ঘরে কোনো পেইন্টিং নেই। অভিমানের স্বাক্ষী হয়ে দেয়ালে ঝুলছে দুই হাজার এগারো সালের মলিন একটা ক্যালে-ার।
বিছানায় শুয়ে ফারহি তাকিয়ে থাকে দেয়ালের দিকে। বলে, আপা, তুমি এমন কৃপণ। ছোট বোনকে সামান্য একটা পেইন্টিং দিতে তোমার কলিজা চিমসে যায়। লুবনা উত্তর দেয় না। বেশ কয়েকদিন ধরে ফারহিকে বলবো বলবো করে যে কথা কয়টা বলা হয়নি, সেগুলো একের পর এক মনের ভেতর ভাজ করতে থাকে গুছিয়ে বলার জন্য।
ফারহি তোর পড়াশোনা কেমন চলছে?
ভালো না।
লুবনা সামান্য চমকে ওঠে। ছোট বোনের সাথে তার সম্পর্ক ভারি না হলেও খুব বেশি তরল নয়। ‘পড়াশোনা কেমন চলছে’র উত্তরে পড়াশোনা ভালো চলুক আর না চলুক ‘হ্যাঁ’ বলাই সঙ্গত ছিল। সে স্থানে ‘না’টা চট করে কানে বাজে।
কেন ভালো না?
যেই হারে পড়েছি, ভেবেছিলাম পরীক্ষায় ঠিকই এক দুই হবো। কিন্তু হয়েছি ছয়। কাজেই বুঝতে পারছো অবস্থা সুবিধের নয়।
নতুন মামিকে তোর কেমন লাগল ফারহি?
কেমন লাগবে! ভালো। শুনেই কি একজন মানুষ সম্পর্কে খারাপ কিছু বলা যায়? কাছ থেকে না দেখলে মানুষ চেনা যায় না। ভালোই বলা উচিত।
লুবনার মনে হলো, মনের কথাগুলি গুছিয়ে ধীরে ধীরে সামনে এগুনোর জন্য যে লাগাম হাতে রাখা প্রয়োজন তা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত বলা কথাগুলোয় খুব সূক্ষ্ম হলেও ফারহি একটা আধিপত্য বিস্তার করে ফেলেছে। লুবনা সরাসরি লাইনে আসার চেষ্টা করে। বলে, মামির কথা না হয় বাদ দিলাম। মামা কিন্তু অপরিচিত কেউ না। তার সঙ্গেও তুই মন খুলে দু’একটা কথা বলিস না। এটা কি ঠিক? কিসের এতো লজ্জা তোর?
আপা আমি এমনই।
এমনই মানে কি? তোর লজ্জা বেশি? কারো সাথে সহজ হতে পারিস না?
হ্যাঁ।
সকালে যে তোকে পড়াতে আসে, কী যেন নাম? হ্যাঁ, আরাফাত। তার সঙ্গে দেখি খুব হেসে হেসে কথা বলিস। মাস না যেতেই এতো ফ্রি হয়ে গেলি!
শুধু আরাফাত স্যারের সাথেই না, আমি সব স্যারের সাথেই হেসে হেসে কথা বলি। গোমড়া মুখ করে থাকলে স্যারদের পড়া ভালো বুঝে আসে না। এটা আমাদের ধর্ম স্যারের উপদেশ। কেন, তুমি জানো না? মোশাররফ স্যার। তুমিও তো তার কাছে পড়েছো। পড়নি? স্যার দীর্ঘদিন ধরে এই স্কুলে ধর্ম ক্লাস নেন।
মোশাররফ স্যারের কথা লুবনার মনে পড়ে যায়। সেও মোশাররফ স্যারের কাছে পড়েছে। স্যার তার সব ক্লাসেই এই উপদেশটা দেন। তবুও লুবনার বলতে ইচ্ছে করে, ফ্রেস মনে হাসি হাসি মুখে মনোযোগ দিয়ে স্যারের পড়া শোনা এবং হেসে হেসে স্যারের সঙ্গে কথা বলা দুটো এক জিনিস নয়। কিন্তু বলে না। বলতে ইচ্ছে হয় না। মনে হয়, এই মুহূর্তে সে যতোই কথা চালিয়ে যেতে থাকবে ফারহি তার কথার মারপ্যাচে তাকে ততোই পরাস্ত করতে থাকবে। ফারহিটা এতো কথা জানে, এটা তার কল্পনাতেও ছিল না। সবাই কতো কাছে থেকেও কতো দূরে। কতো পরিচিত হয়েও কতো অপরিচিত। জগৎ সংসার যেমন বিচিত্র, মানুষও কি তার চেয়ে কিছুমাত্র কম বিচিত্র? চলবে...

আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন...

আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম /আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ