মুফতি মানসুর আহমাদ।।
দুপুরে মাদরাসা থেকে ফেরার পথে আরেকজনসহ একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদেরকে দেখে চেহারাপরিচিত একজন লোক এগিয়ে এলেন। দেখে মনে হয় লোকটি আমলদার পরহেজগার হবেন। এসেছেন নিজের একটি তাজা ঘটনা শুনাতে।
মুখে একটা বিজয়ের ভাব ফুটিয়ে তিনি বলতে শুরু করলেন- ঐ তো ওখানে পুলিশ আমাকে জিজ্ঞেস করলো, মুখে মাস্ক পরছি না কেন? আমি পুলিশকে পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম- আপনারা গ্যারান্টি দিতে পারবেন মাস্ক পরলে আমি করোনায় আক্রান্ত হবো না। আমার কথায় পুলিশ চুপ হয়ে গেল। বৃদ্ধ দোকানী লোকটির সাথে সুর মিলিয়ে বললো- বর্তমান সময়ে মানুষ অনেকরকম শিরক করছে।
আমি সাধারণত মাস্ক পরেই বের হই। কিন্তু সেবার মাদরাসা থেকে বেরোনোর সময় ভুলে পরা হয়নি। মুখে মাস্ক না দেখেই হয়তো তিনি আমাদেরকে নিজ দলের লোক মনে করে ঘটনাটি বলতে এসেছিলেন। আমি তাড়াতাড়ি করে পকেট থেকে মাস্কটি বের করে পরে নিলাম। আমার মাস্ক পরা দেখে তিনি দ্রুত পায়ে সামনে হাঁটা দিলেন।
দু'দিন আগে এলাকার প্রসিদ্ধ একজন মুফতি সাহেব ফোনে কাহিনী শুনালেন। বললেন- আমি মাস্ক পরে গ্রামের বাজারে গেলাম। লোকেরা কেমন করে যেন আমার দিকে তাকাচ্ছিলো। পরিচিত কয়েকজন বলেই ফেলল- হুজুর আপনিও মাস্ক পরে ফেললেন! মানে ঈমানের এত নিচু লেবেলে নেমে গেলেন!
নিচের হাদিসগুলো একটু লক্ষ্য করি- عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " مَنْ نَامَ وَفِي يَدِهِ غَمَرٌ وَلَمْ يَغْسِلْهُ فَأَصَابَهُ شَىْءٌ فَلاَ يَلُومَنَّ إِلاَّ نَفْسَهُ " .
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ: তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি ঘুমালো এ অবস্থায় যে, তার হাতে তৈলাক্ত কিছু লেগে আছে, সে তা ধুয়ে পরিষ্কার করে নি, এতে তার কোন ক্ষতি হলে সে যেন কেবল নিজেকেই তিরস্কার করে। ( সুনানে আবু দাউদ :৩৮৫২; জামে তিরমিযি: ১৮৬০; সুনানে ইবনে মাজাহ:৩২৯৬)
হাদিসটিতে উল্লেখিত "কোন ক্ষতি"র ব্যাখ্যায় আউনুল মা'বুদে বলা হয়েছে-
قوله: فأصابه شيء: أى وصله شيء من إيذاء الهوام أو من الجان
و قيل: من البرص و غيره
অর্থাৎ, কোন কীট বা সর্প এসে কামড় দিল। অথবা কোষ্ঠ বা অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত হলো।
বুঝা গেল- যেসব বিষয় কোনো বিপদের কারণ হতে পারে বা কোনো রোগ সৃষ্টির উপলক্ষ হতে পারে তা থেকে সতর্কতার সাথে দূরে থাকতে হবে।
অন্য একটি হাদিসে এসেছে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন এক বাড়িতে মেহমান হয়েছিলেন। মেজবান প্রথমে এক প্রকার খেজুর পেশ করলেন। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা থেকে নিজে খেলেন, কিন্তু আলী রাঃকে এই বলে বারণ করলেন- مه ! إنك ناقه - আলী! থামো, তুমি সদ্য রোগ মুক্ত হয়েছো।
এরপর মেজবান যখন রান্না করা এক প্রকার খাবার পরিবেশন করলেন তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলী রাঃকে তা খেতে উৎসাহিত করলেন। বললেন- يا علي! أصب من هذا فهو أنفع لك.
- হে আলী! এটি থেকে খাও। কেননা এটি তোমার জন্য অধিক উপকারী। (সুনানে আবু দাউদ: ৩৮৫৬; জামে তিরমিযি : ২০৩৭; সুনানে ইবনে মাজাহ: ৩৪৪২)
বুঝা গেল- কোনো খাবার বা অন্য কিছুকে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বা উপকারী বলে বিশ্বাস করা ঈমান পরিপন্থি কিছু নয়, বরং তা নবীজীর শিক্ষা।
রোগ হওয়ার পর ওষুধ সেবন যেমন, রোগ হওয়ার আগে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণও তেমন। কোনটিই ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। বরং নির্দেশিত। ইসলাম সব রকম প্রান্তিকতামুক্ত ভারসাম্যপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে মাস্ক ব্যবহার উপকারী কি না- এ বিতর্কের সম্পর্ক সংশ্লিষ্ট গবেষকদের সাথে, ইসলামের সাথে নয়। হাঁচিদাতার মাস্ক ব্যবহার করা তো সুন্নাহর নিকটবর্তী আমল। কারণ, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাঁচির সময় হাত বা কাপড় দিয়ে চেহারা ঢেকে নিতেন। (জামে তিরমিযি : ২৭৪৫; সুনানে আবু দাউদ : ৫০২৯)
সহীহ বুখারীর ৬২২১ নং হাদিসের ব্যাখ্যায় ফাতহুল বারীতে হাঁচির সময় চেহারা ঢাকার কারণ বর্ণনা করা হয়েছে-
لئلا يبدو من فيه أو أنفه ما يؤذي جليسه.
- যেন তার মুখ থেকে এমন কিছু বের না হয় যা তার সাথের লোককে কষ্ট দেবে।
সুতরাং ঈমান, ইয়াকিন ও তাওয়াক্কুলের নামে মাস্ক ব্যবহার নিয়ে বাড়াবাড়ির কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। ইচ্ছে হলে কেউ পরবে ইচ্ছে না হলে পরবে না। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন।
লেখক, শিক্ষা সচিব ও মুহাদ্দিস- বাইতুস সালাম মাদরাসা, উত্তরা-ঢাকা।
ওআই/আবদুল্লাহ তামিম