শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


ভারতের দেওবন্দের নামকরণ করা হয়েছে যেভাবে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

নুরুল্লাহ্ আশরাফী
দেওবন্দ থেকে

ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলায় দেওবন্দ নামক একটি স্থান বিশ্ববাসীর কাছে খুবই পরিচিত।অনেকের মনে আল্লাহর ওলিদের কারণে এ জায়গাটি ভালোবাসার স্থান করে নিয়েছে। তবে দেওবন্দ এলাকার নামকরণের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই জানা নেই। আসুন !কীভাবে ঐতিহাসিক 'দেওবন্দ' এর নামকরণ হয়, জেনে নেওয়া যাক।

একদিন সুনানে আবু দাউদের দরসে আমাদের শিক্ষক আল্লামা আমিন পালনপুরী বলেন, কোন একদিন হজরত কারী তাইয়্যেব সাহেব রহিমাহুলাহ (সাবেক মুহতামিম, দারুল উলুম দেওবন্দ) আমাদের জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কি জানো এই এলাকার নাম দেওবন্দ কেন হল?

তারপর হজরত নিজেই ঘটনা বর্ণনা শুরু করেন, দেওবন্দে ‘দেবীকন্ড’ নামক একটি মন্দির ছিল। মন্দিরের দেয়াল ঘেষেই একটি দিঘী (বড় পুকুর) ছিল। যেখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তাদের বাৎসরিক উৎসব পালন করত। সেই মন্দির এখনো বিদ্যমান আছে, সে জায়গা বর্তমানে ‘চামর চৌদা’ নামে পরিচিত।

প্রায় শত বছর পূর্বে এই মন্দিরের এমন একটি রেওয়াজ ছিল যে, বাৎসরিক উৎসবের দিন একটি কুমারি মেয়েকে কনে সাজিয়ে ওই মন্দিরে রেখে আসত, আর সকালে সেই মেয়ে গায়েব/অদৃশ্য হয়ে যেতো!

হিন্দুদের মধ্যে কথিত ছিল যে, সেই মেয়েকে "দেবী" এসে নিয়ে যেতো। আর এই কারণে গ্রামবাসী সবাই চিন্তিতও ছিল, কিন্তু কিছুই করার ছিল না। পূর্বপুরুষদের চালু করা রেওয়াজ পালন করতে তারা বাধ্য ছিল।

প্রতিবছর উৎসবের সমাপ্তিকালে ঘোষণা হতো যে, আগামী বছর তোমার মেয়ে দিবে এবং তার পরের বছর তোমার মেয়ে দিবে।

একবার এখান থেকে (বর্তমানে যেখানে দারুল উলুম অবস্থিত) একজন লোক কোথাও সফরে যাচ্ছিলো।পথিমধ্যে রাত নেমে এলে ওই এলাকার কোন এক হিন্দুর বাড়িতে রাত্রীযাপন করলেন। আর তখন সেই এলাকায় হিন্দুদের বাৎসরিক উৎসবের আয়োজন চলছিল।

ঘটনাক্রমে ওই মুসলমান মুসাফির যে হিন্দুর ঘরে রাত্রীযাপন করছিলেন সে বছর উৎসবে ওই হিন্দু ব্যাক্তির মেয়েকে মন্দিরে বিসর্জন দেয়ার পালা ছিলো এবং যার কিনা ওই একটিমাত্রই মেয়ে ছিলো। আর সে কারণে স্বভাবতই পুরো ঘরজুড়ে সবাই বিমর্ষ ছিলেন।

তখন ওই মুসলমান ব্যাক্তি তাদেরকে তাদের বিমর্ষতার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা তাকে পুরো ঘটনা বর্ণনা করে শোনান। তখন ওই মুসলমান ব্যাক্তি তার হিন্দু মেযবানকে সান্তনা দিয়ে বললেন, তুমি চিন্তা করো না,এই কাজের জন্য আমি তৈরী। তখন হিন্দু মেযবান বললেন, তুমি তো পুরুষ, অথচ সেখানে মেয়ে দিতে হবে!
তখন মুসলমান ব্যাক্তি বললেন,তোমরা আমাকে ঘোমটা পরিয়ে মন্দিরে রেখে আসবে। ওই রাতে কে জানবে যে,  ঘোমটার ভেতরে ছেলে নাকি মেয়ে আছে!

অতপর,মন্দিরে মেয়ে দেয়ার সেই শুভক্ষণ এমনটাই করা হলো যে, ওই মুসলমান ব্যাক্তিকে ঘোমটা পরিয়ে মন্দিরে রেখে মন্দিরের দরজা বাহির থেকে লাগিয়ে দেয়া হলো।(এই বিষয়টি ওই হিন্দু মেযবানের পরিবার ব্যাতিত আর কেউই জানতো না। কেননা, রেওয়াজ ছিল যাদের মেয়ে তারাই গিয়ে মন্দিরে রেখে আসবে)।

অতপর সকাল হলো। তখন নিয়মানুযায়ী গ্রামবাসী সবাই যখন মন্দিরে প্রবেশ করলো তখন তারা দেখতে পেলো একজন পুরুষ মন্দিরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে! সবাই তাকে ঘুম থেকে জাগালো এবং সে কিভাবে এখানে এসেছে তা বিস্তারিত জানতে চাইলো যে, তুমি কিভাবে এখানে আসলে?

তখন সে রাতে তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা তাদেরকে এভাবে বর্ণনা করলো যে, যখন তাকে মন্দিরের ভেতরে রেখে বাহির থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিলো, তখন সে আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল, এখন কি হবে! তারপর সে জিকির-তেলাওয়াতে মাশগুল হয়ে পড়লো। যখন ধীরে ধীরে রাত অন্ধকার হয়ে গেলো, তখন সে দেখতে পেলো দিঘীর মধ্য থেকে একটি ছোট নৌকা মন্দিরের দিকে আসছে! আর নৌকাটি থেকে চতুর্দিকে আলোর বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে পড়ছে।

তখন ওই মুসলমান ব্যাক্তি ভয়ে অস্থির হয়ে কুরআন থেকে যা মনে আসছিলো(আয়াতুল কুরসী,ইত্যাদি) তা'ই পড়তে লাগলো! নৌকাটি যখন মন্দিরের একেবারে কাছাকাছি চলে আসলো, তখন নৌকাটি মন্দিরের দেয়ালে ধাক্কা লেগে অনেক দিঘীর মাঝখানে চলে গেলো! অতপর আবারো ধীরে ধীরে মন্দিরের দিকে এগুতে লাগলো এবং কাছাকাছি চলে আসলো। আবারও মন্দিরের দেয়ালে ধাক্কা লেগে বহুদূর চলে গেলো! এভাবে তিনবার একেবারে মন্দিরের কাছাকাছি এসে আবার দুরে চলে গেলো!

এদিকে ওই মুসলমান মুসাফির অনবরত কুরআন তিলাওয়াত করেই যাচ্ছিলো। চতুর্থবার যখন নৌকাটি মন্দিরের দেয়ালে ধাক্কা খেল, তখন নৌকাটি ভেঙ্গেচুরে দিঘী'তে তলিয়ে গেলো। আর মুসলমান ব্যক্তিও আরামে ঘুমিয়ে পড়লেন। এমনকি ভোরে গ্রামবাসী এসে তাকে জাগানোর পূর্ব পর্যন্ত তিনি ঘুমিয়েই ছিলেন।

সেদিন থেকেই এই পবিত্র ভূমির নাম দেওবন্দ হয়ে গেল।  "দেও" যে নাকি প্রতিবছর এসে আমাদের মেয়েদেরকে নিয়ে যেতো, তার দাফন হয়ে গেলো।

এই ঘটনা হযরত ক্বারী তাইয়্যেব সাহেব (রহিমাহুল্লাহ্) উসতাযে মুহতারাম আল্লামা আমিন পালনপুরী দামাত বারাকাতুহুমকে শুনিয়েছেন এবং তিনি আমাদেরকে শুনিয়েছেন। আর আমি নুরুল্লাহ্ আশরাফী "পূণ্যভুমী দেওবন্দে"র নামকরণের ইতিহাস আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম।

আরএম/


সম্পর্কিত খবর