শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


কায়রো বইমেলা; সাহিত্য সংস্কৃতির অনন্য নজির

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মদ তাওহীদুল ইসলাম
মাদিতুন নাছর, কায়রো থেকে

মিসরের কায়রোতে গত ২২ জানুয়ারি শুরু হয়েছে ‘মারিদুল কাহেরা আদদুওয়ালি- ২০১৯’ (কায়রো আন্তর্জাতিক বইমেলা)। নিউ কায়রোর আততাজাম্মুউল খামিস সিটিতে আল-হাইয়াতুল আম্মাহ আলমিসরিয়্যাহ লিল কিতাব (জেনারেল মিসরীয় বুক অর্গনাইজেশন) কর্তৃকআয়োজিত এ বছরের মেলা চলবে ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

আরব বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও প্রাচীনতম এই বইমেলার এবার চলছে ৫০ পর্ব। এ উপলক্ষে পালিত হচ্ছে আল-ইউবিল আযযাহাবী (GOLDEN JIBILEE)। প্রেসিডেন্ট আব্দুল ফাত্তাহ আসসিসি এই মেলার উদ্বোধন করেন।

মেলার বেশ কয়েকটি স্টল পরিদর্শন করেন ৷ এ সময় উপস্থিত ছিলেন মিসরের ইমামুল আকবার শায়খুল আযহার আহমাদ তায়্যিব ও সাংস্কৃতিক মন্ত্রী ডা. ইনাস আব্দুদ দায়েমসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ ৷

মেলা প্রতিদিন সকাল ১০ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত খোলা থাকে ৷ এ বছর মেলায় প্রবেশ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ মিসরি পাউন্ড ৷ এছাড়াও বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য রয়েছে বিনামূল্যে প্রবেশের বিশেষ কার্ড ৷

আজ থেকে ৫০ বছর পূর্বে ১৯৬৯ সালে কায়রো শহরের সহস্রাব্দপূর্ত অনুষ্ঠানে তৎকালিন সাংস্কৃতিক মন্ত্রী ডা. ছারওয়াত ওকাশী (১৯২১-২০১২) কায়রোর এই বইমেলা প্রবর্তন করেন এবং বইমেলার সর্বপ্রথম পর্বের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বিখ্যাত লেখিকা ডা. সুহির আলকালমাভী (১৯১১-১৯৯৭)৷

এবারের বইমেলাটি এই মহান ব্যক্তিদ্বয়ের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে ৷ আর স্পন্সর হিসেবে রয়েছে জামিয়াতু দুয়ালিল আরাবিয়্যাহ (আরব রাষ্ট্র লীগ) ৷

মেলার স্থান: সূচনা পর প্রথম বছর এই মেলার প্রথম পর্ব অনুষ্ঠিত হয়েছিল গীজা শহরে ৷ তারপর ধারাবাহিকভাবে একাধারে ৪৮বছর এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে মাদীনাতুন নাসরের কায়রো ইন্টারন্যাশনাল ফেয়ার গ্রাউন্ডসে।

তবে এ বছর সেখান থেকে স্থানান্তরিত করা হয়েছে মারকাযু মিসর লিল মা‘আরিদিদ্দাওলিয়্যাহ
(Egypt International Exhibition Center) তে ৷

সদ্য নির্মিত মনোরম এই স্থায়ী স্থাপনাটি শহরের ব্যস্ততম এলাকার বাইরে নিরিবিলি পরিবেশে অবস্থিত ৷ চারটি বিশাল সুুউচ্চ হলরুম নিয়ে অবস্থিত এই সেন্টারটি ৷ এর প্রদর্শনী এলাকা আয়তন ৪৫০০০ বর্গমিটার ৷

হলের বাইরে বিশাল চত্তর ও দর্শনার্থীদের উভভোগ করার জন্য রয়েছে মুগ্ধকর ফুলের বাগান ৷ বাহারি রংঙ্গের ফুলগুলো যেন বইপ্রেমী মানুষদের স্বাগত জানাচ্ছে ৷ চত্তরের মাঝখানে পানির ফোয়ারা মেলার সৌন্দর্য কয়েকগুণ বৃদ্ধি করেছে ৷ দর্শনার্থীদের বিশ্রামের জন্য চত্তরের অস্থায়ী ছায়াদ্বার বিশাল বিশাল ছাতা ৷

এ ছাড়াও গাড়ি পাকিং এর জন্য বিশাল আয়তনের এরিয়া জুড়ে সুব্যবস্থা ৷

মেলার স্টল: চারটি বিশাল হলেরুমে আয়োজিত এ মেলায় মোট রয়েছে মোট ৭২৩ টি স্টল ৷ চোখ ধাঁধানো আলোয় আলোকিত এসব হলরুমের মেঝেতে বিছানো হয়েছে উন্নতমানের লাল গালিচা ৷ কাংখিত লাইব্রেরিকে সহজে খুঁজে পাওয়ার জন্য প্রতিটি হলরুমকে সূবিন্যাস্ত করা হয়েছে A B C D সিরিয়ালে ৷

প্রতিটি সিরিয়ালের অধিনে রয়েছে অর্ধশতকের অধিক স্টল ৷ রয়েছে প্রতিটি হলের সামনে রয়েছে গোটা হলের বিস্তারিত নকশা ৷ হলের মাঝে মাঝে রয়েছে তথ্যকেন্দ্র ৷

মেলা কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এ বছর আফ্রিকা থেকে ১০টি, এশিয়া থেকে ১৬ টি, ইউরোপ ৭ আমেরিকা থেকে ২ মোট থেকে ৩৫ টি রাষ্ট্রের সাতশতাধিক প্রকাশনী মেলায় অংশ গ্রহণ করেছে ৷ এর মাঝে ৫৭৯ টি মিশরীয় প্রকাশনার ও ১৭০ বিদেশী প্রকাশনী ৷

বিশেষ আকর্ষণ: দুই সাপ্তাহব্যাপী এই মেলায় বুকস্টলের পাশাপাশি রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের জন্য নির্দিষ্ট প্যাভিলিয়ন ৷ মেলায় আগত দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এসব প্যাভিলিয়নে থাকে বর্ণাঢ্য সাজ ৷ এসব প্যাভিলিয়নে পরিচালনারত ব্যক্তিরা নিজ দেশের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও পরিচিতি নিয়ে বিভিন্ন প্রতিদিন বিভিন্ন কর্মশালী পালন করে থাকে ৷

সৌদি আরবের প্যাভিলিয়ন প্রতিবছরের মতো এবারও ছিল জাঁকজমকপূর্ণ সুসজ্জিত ৷ বই ক্রয় ও বই পাঠ করার পাশাপাশি মেলায় আগত দর্শনার্থী এসব প্যাভিলিয়নগুলো পরিদর্শন করে অর্জন করে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ৷

এছাড়াও রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির ও সংস্থার প্রদর্শনী স্টল ৷ এ সব স্টলে বিভিন্ন প্রকাশনা ও ঐতিহাসিক জিনিসের প্রদর্শনী করা হয় ৷

হলরুমগুলের মাঝে মাঝে রয়েছে নারী-পুরুষের ভিন্ন ভিন্ন ওযু-ইস্তেনজাখানা এবং মনোরম নামাযের স্থান ৷ মেলা চলাকালীন প্রতি নামাযের জন্য সুমুধুর সুরে পরিবেশন করা হয় আযান ৷ আযানের পরপরই নামাযের স্থানগুলোতে শুরু হয়ে যায় নামাযীদের উপচে পড়া ভিড় ৷

মেলায় আগত দর্শনার্থীদের ক্ষুদা ও ক্লান্তি নিবারনের জন্য রয়েছে হলরুমের বাহিরেও ভেতরে রয়েছে অনেকগুলো অভিজাত রেস্টুরেন্ট ৷ সেখানে রয়েছে মানসম্মত খাবারের ব্যবস্থাপনা ৷

নিরাপত্তা ব্যবস্থা: গ্রন্থমেলায় মানুষ যাতে নিরাপদে আসতে পারেন সেজন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে জোরদার করা হয়। ভারি অস্ত্রধারী সেনা সদস্য, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যগন নিরাপত্তাসহ মেলা পর্যবেক্ষণ কাজে সার্বক্ষণিক তৎপর রয়েছেন৷

জ্ঞান-বিজ্ঞানের শহর কায়রোর ঐতিহ্যমন্ডিন এই বইমেলা যুগ যুগ ধরে মানুষের জ্ঞানচর্চা ও আহরণে যেমন অবদান রেখেছে, তেমনি সৃষ্টি করেছে কবি, সাহিত্যিক, লেখক গবেষক।

বই কেনা আর বই পড়ার অভ্যাস অগণিত মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে তা-ই নয়, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভূবনকে বিকশিত করতে বিশাল ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে এই গ্রন্থমেলা ৷

শিক্ষা সংস্কৃতিকে রক্ষার লক্ষে প্রবর্তিত এই মেলা ৫০ বছর ধরে মিসরের শিক্ষা সংস্কৃতি উন্নয়ন ও রক্ষায় অসামান্য ভূমিকা রেখে যাচ্ছে ৷ তাই ৫০তম এই বই মেলার বিশেষ স্লোগান রাখা হয়েছে ‘খমসূনা আ‘মান মিনাছ ছাকাফাহ’ সংস্কৃতিময় পঞ্চাশ বছর ৷

এই মেলা মিসরের ছোট বড়, নারী-পুরুষ সর্বস্তরের মানুষের প্রাণের স্পন্দন, মনের আকুতি এবং হৃদয়ের অভিব্যক্তি।

এই গ্রন্থমেলা শুধু বই বেচাকেনার মেলা নয়, এ হচ্ছে শিক্ষা-সংস্কৃতি,ঐতিহ্য খুঁজে পাওয়ার মেলা৷ তাই সব স্তরের এবং সব বয়সের মানুষের মিলন ঘটে বইমেলায়।

মিসরীদের সংস্কৃতি-বিকাশের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গ্রন্থমেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ মেলা মিসরের সকল মানুষের এক মিলনমেলা এবং জাতীয় সাংস্কৃতিক উৎসবও৷

এই মেলাকে কেন্দ্র করে মিসরে সৃজনশীল প্রকাশনা জগতে গড়ে উঠছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি বৃদ্ধি পাচ্ছে পাঠক সমাজ। সাহিত্য ও সৃজনশীল চিন্তা-চেতনার যারা নিরন্তর সাধক, তাদের সংখ্যাও বাড়ছে ক্রমশ। গ্রন্থমেলাকে উপলক্ষ করে দেশ-বিদেশের অসংখ্য বইপ্রেমী মানুষেরা আগমন করে এই মেলায়।

মেলায় রয়েছে শিশুদের জন্য রয়েছে আলাদা প্যাভিলিয়ন ৷ সেখানে রয়েছে শিশু শিক্ষার বইয়ের অনেকগুলো স্টল ৷ হরেকরকম এই প্যাভিলিয়নে শিশুদের জন্য রয়েছে চিত্ত-বিনোদন, চিত্রাঙ্কন ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন।

বড়দের পাশাপাশি মিসরী শিশুদের উপস্থিতি চেখে পড়ার মত ৷ অভিভাবকদের সঙ্গে প্রচুর মিসরী শিশু মেলায় আসে ৷ এসব শিশুরা উচ্ছ্বসিত চিত্তে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ, পুরস্কার গ্রহণ এবং ইচ্ছামতো বুকস্টলে ঘোরা-ফেরার মাধ্যমে আনন্দে মেতে উঠে ৷ তাদের আগমণে প্রতিদিন মেলা নতুন প্রাণে জেগে উঠে ।

কায়রো বইমেলাকে ঘিরে মিসরে প্রবাসী বাংলাদেশি ছাত্রদের মধ্যেও সৃষ্টি হয় ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা। সবাই বছর ব্যাপী গুণতে থাকে এই মেলা শুরুর অপেক্ষার প্রহর ৷ দুষ্প্রাপ্ত ও স্বল্পমূল্যে অধিক কিতাব সংগ্রহ করার অপূর্ব সুযোগ এই মেলা ৷

বইপ্রেমীরা নিজের সাধ্যের সবটুকু অর্থ ব্যয় করে ক্রয় করে থাকে নিজের পসন্দের হরেক রকম বই ৷ বছরের অর্ধ-অবকাশে আয়োজিত এ মেলার সময়কে মিসরীদের মত তারাও কিতাব কেনার মৌসুম বলে অভিহিত করে থাকে ৷

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ