সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


‘তোরা পরের ওপর ভরসা ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়া’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

জহির উদ্দিন বাবর
সাংবাদিক ও কলামিস্ট

জাতীয় নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। এই নির্বাচনকে সামনে রেখে জোট-মহাজোটের খেলা চলছে রাজনীতির অঙ্গনে। কে কোন জোটে যাচ্ছে, কে কত আসন পাচ্ছে এটাই এখন রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচনার মুখ্য বিষয়। অন্যান্য দল ও জোটের পাশাপাশি ইসলামি দলগুলোর কথাও আলোচিত হচ্ছে। বেশির ভাগ ইসলামি দলই বড় দুই দলের নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে আছে। বড় দলগুলো যখন আসন ভাগাভাগি করছে তখন ইসলামি দলগুলো তাদের ‘করুণার’ দিকে তাকিয়ে আছে। তারা দয়া করে দুই চারটি আসন দেবে কি না সেই হিসাব কষছে।

মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ.-এর ইসলামী ঐক্যজোট দীর্ঘ সময় বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে ছিল। সেই জোট থেকে আমিনী সাহেব এমপিও হয়েছিলেন। বর্তমানে এই দল বা জোট বিএনপির সঙ্গে নেই। বছর দুয়েক আগেই বিএনপির সঙ্গে তারা সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। অনেক দিন ধরে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল ইসলামী ঐক্যজোট আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটে যাচ্ছে।

আগামী নির্বাচনে এই দলের কয়েকজন নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচনও করবেন। দলীয় প্রধান এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, এখন তারা জোট করলে আওয়ামী লীগের সঙ্গেই করবেন। এটা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচুর সমালোচনা ও টিপ্পনি চোখে পড়েছে।

আজীবন সংগ্রামী মুফতি আমিনী রহ.-এর হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে এভাবে জোটবদ্ধ হবে এটা মেনে নিতে অনেকের কষ্ট হচ্ছিল। খোদ দলের একটি বড় অংশ এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বলে শোনা যায়। তবে সম্প্রতি ইসলামী ঐক্যজোট ঘোষণা দিয়েছে তারা আপাতত আওয়ামী লীগের জোটে যাচ্ছে না। দলীয় প্রতীক মিনার নিয়েই নির্বাচন করবে। এই খবরে শুধু তাদের দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে নয়, গোটা ইসলামি অঙ্গনে অনেকটা স্বস্তির আভাস দেখা দিয়েছে। তাদের এই সিদ্ধান্তকে সবাই স্বাগত জানিয়েছে।

শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-এর দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস কয়েক মাস আগে জোট করেছে এরশাদের দল জাতীয় জাতীয় পার্টির সঙ্গে। এই দলটি আবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের সঙ্গে আছে। সুতরাং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে মহাজোটের সঙ্গেই আছে। আগামী নির্বাচনে তারা মহাজোটের কাছে কয়েকটি আসনে ছাড় পাওয়ার আশা করছে। তবে আওয়ামী লীগের কাছে এরশাদের প্রত্যাশাই যেখানে পূরণ হচ্ছে না সেখানে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আশা কতটা পূরণ হবে সেটা বোঝা যাচ্ছে না।

অপরদিকে খেলাফত মজলিস ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম (দুই অংশ) আছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে। দুটি দলই আগামী নির্বাচনে কয়েকটি আসন চাচ্ছে বিএনপির কাছে। তবে সম্প্রতি গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আর আগের ২০ দলের মধ্যে আসন ভাগাভাগির মধ্যে এই দুটি ইসলামি দল শেষ পর্যন্ত তাদের প্রত্যাশিত আসন কতটুকু পাবে সেটা নিয়ে যথেষ্ট দুশ্চিন্তা আছে দুই দলে। ইতোমধ্যে দুই দলের পক্ষ থেকে বিএনপিকে আলটিমেটামও দেয়া হয়েছে।

ইসলামি দলগুলোর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম চরমোনাই পীর সাহেবের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দলটি সবার আগে তিনশ আসনে নিজস্ব প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এক হিসেবে তারা আওয়ামী লীগ-বিএনপি থেকেও এগিয়ে। কারণ দেশের আর কোনো দলই এবারের নির্বাচনে তিনশ আসনে নিজস্ব প্রার্থী দিতে পারবে না।

একটি ইসলামি দলের তিনশ আসনে প্রার্থী দেয়ার মতো সৎসাহস অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কোনো জোটের সমর্থন ছাড়া এককভাবে নির্বাচন করে সংসদে যাওয়া সম্ভব হবে না সেই বাস্তবতা দলটির সামনে রয়েছে। কিন্তু সংসদে যাওয়াকেই প্রধান লক্ষ্য না বানিয়ে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি জোরদার করা; দেশবাসীর সামনে নিজেদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের জানান দেয়া এটাও কম নয়। এভাবে একদিন শক্তিশালী ভিত্তি দাঁড়িয়ে গেলে জনগণ যে তাদেরকে সংসদে পাঠাবে না সেটা হলফ করে বলা যায় না।

গতকাল (শনিবার) কয়েকটি ইসলামি দলের মাঝারি স্তরের কয়েকজন নেতা একটেবিলে বসেছিলেন। প্রতি আসনে ইসলামি দলগুলোর পক্ষ থেকে একক প্রার্থী দেয়ার ব্যাপারে তারা আলোচনা করেছেন। তাদের এই আলোচনার ফলাফল কী হবে সেটা বলা যায় না।

তবে এই উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে মহৎ। ইসলামি দলগুলোর শীর্ষ নেতারা এভাবে বসলে জাতি আরও খুশি হতো। প্রথম সারির কোনো নেতা উদ্যোগী হয়ে এভাবে একটেবিলে বসার ব্যবস্থা করলে একটি সুন্দর পথ বেরিয়ে আসত। কিন্তু কে ডাকবে; সেই ব্যক্তিত্ব কোথায় এটা নিয়ে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আছে বিশাল আক্ষেপ।

কওমি মাদরাসাকেন্দ্রিক ইসলামি দলগুলো জোটের রাজনীতিতে জড়ায় ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে। তখন বেশির ভাগ দল বিএনপি জোটের সঙ্গে নির্বাচনে অংশ নেয়। আর চরমোনাইয়ের মরহুম পীর সাহেবের নেতৃত্বে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন ভোটে অংশ নেয় এরশাদের জাতীয় পার্টির সঙ্গে। সেই নির্বাচনে চারজন আলেম সংসদে যাওয়ার সুযোগ পান। এটা ইসলামি রাজনীতির জন্য নিঃসন্দেহে ইতিবাচক।

.কিন্তু সেই থেকে ইসলামি দলগুলো জোটে রাজনীতির আবর্তে এমনভাবে জড়িয়ে যায় যা থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারেনি। এখনও সেখানেই ঘুরপাক খাচ্ছে। ভাঙা-গড়ার খেলা অনেক হয়েছে কিন্তু ইসলামি দলগুলো স্বতন্ত্র বলয় গড়ে তুলতে পারেনি। বড় দুই দলের করুণার পাত্র হয়ে এখনও তাদের রাজনীতি করতে হচ্ছে। এটা থেকে বেরিয়ে আসার এখনই উপযুক্ত সময়। কোনো জোট-মহাজোটে না জড়িয়ে ইসলামি দলগুলো

ঐক্যবদ্ধভাবে নিজেরা নির্বাচন করলে সাময়িকভাবে কোনো আসন না পেলেও ভবিষ্যতের জন্য ভালো হবে। জনগণের কাছে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা প্রমাণ করতে পারলে জনগণই একদিন তাদের ক্ষমতায় বসাবে। এজন্য মুসলিম পুনর্জাগরণের কবি ফররুখের ভাষায় বলতে চাই:

‘তোরা চাসনে কিছু কারও কাছে খোদার মদদ ছাড়া
তোরা পরের ওপর ভরসা ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়া’

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ