আলী আবদুল মুনতাকিম
প্রকৌশলী ও কুরআন গবেষক
বিভিন্ন টেলিভিশন ও ইউটিউব চ্যানেলে ইদানিং মসজিদ ও মাদরাসার দান-অনুদান গ্রহণকে চাঁদাবাজি আখ্যায়িত করে খুব বাজে ভাষায় সমালোচনা করা হচ্ছে যা গ্রহণযোগ্য নয়।
ওয়াজ মাহফিলের বক্তব্যকে বিকৃত ব্যাখ্যাও করা হচ্ছে যা হলুদ সাংবাদিকতার পর্যায়ে পরে বলে অনেকে মনে করেন। নাটকে-সিনেমায় দাড়ি-টুপি পাঞ্জাবি পড়িয়ে চিটার-বাটপার চরিত্রে অভিনয় করানো হচ্ছে যা বাস্তবতার সাথে মিল নেই। বাস্তবতায় যেখানে মিলে না সেটা জীবনঘনিষ্ট নাটক বা সিনামা হয় কি করে?
পাঞ্জাবি-দাড়ি-টুপি, মসজিদ-মাদরাসা-মক্তব সম্পর্কিত সমালোচনার কোন উপাদান বা বিষয় নাই তা বলব না, কিন্তু যেভাবে চিত্রিত করা হচ্ছে তা অবশ্যই নিন্দনীয়। সব জায়গায় সবসময় সব কাজে কর্মে, সবকিছুর মধ্যেই দু’একটা ত্রুটি থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। না থাকাটাই বরং অস্বাভাবিক।
কিন্তু ছোটখাট ত্রুটিগুলো বড় করে মিডিয়ায় লক্ষ লক্ষ লোককে দেখানো সাংবাদিকতার কোন এথিকসে পরে? কাজটি অবশ্যই সঠিক নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে কিছু টিভি ও ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলো দেখে কষ্ট পেয়েছি। একটি ভিডিও দেখে খুবই মর্মাহত হলাম। সমানে লাইক ও শেয়ার পড়তে দেখে আরও আশাহত হলাম।
প্রতিবাদ নেই, খবরগুলো সবাই লুফে নেয়। দু'একটা ঘটনার প্রচারিত দৃশ্য বলছি।
সিলেট অঞ্চলে একটি বাজারে মাহফিলের অনুদানের টাকা আদায়রত অবস্থায় তাদের অবান্তর প্রশ্নে জর্জরিত করা হয় এবং নানা মন্তব্য জুড়ে দিয়ে কিছু মাদরাসা ছাত্রের অপমানের ছবি পোস্ট করা হয়।
মজার ব্যাপার হচ্ছে যারা অনুদান দিবেন বা দিয়ে যাচ্ছেন, তারা তো আপত্তি করছে না বা কোন অভিযোগও তাদের নাই, বরং দানকারীরা শান্তি অনুভব করছেন। আপনার এত মাথা ব্যথা কেন?
হাজার বছর ধরে মাদরাসা মক্তবগুলোতো এভাবেই চলে আসছে। কত টাকা দান করেন আপনি মসজিদ, মাদরাসা ও মাহফিল খরচে? আপনি আপনার এ ভিডিওটি কোন ভাল উদ্দেশ্যে নিয়ে তো প্রচার করছেন না।
আপনি নাইটক্লাবগুলোতে গিয়ে ছবি তুলে ভিডিও করে আপলোড করেন না কেন। ক্লাবগুলো নিয়ে তো প্রচুর আপত্তি মানুষের। আপনি কি নিরীহ মাদরাসা ছাত্রদের দুর্বল পেলেন? আর ক্লাবে যাওয়ার সাহস নেই।
ইটিভিতে মসজিদ মাদরাসার নামে চাঁদাবাজি নিয়ে একটি অনুষ্ঠান অনেক আগে প্রচারিত হয়, দেখানো হয়েছে মসজিদ মাদরাসার ভুয়া নামে কিভাবে চাঁদা তুলে কিছু মতলববাজ লাভবান হচ্ছে। তাদের ধরা উচিত এবং শাস্তি দেওয়া উচিত। এ বিষয়ে কারও দ্বিমত নেই।
কিন্তু উপস্থাপক যেভাবে একজন টুপি দাড়িওয়ালা দেখিয়ে বললেন, এই ভন্ডরা...’ এভাবে কেন বললেন? আপনি বলতে পারতেন, এই ভন্ড পাঞ্জাবি টুপি দাড়ি লাগিয়ে আলেমদের বদনাম করছে বা ভন্ডামির জন্য এই লোকগুলো মানুষের শ্রদ্ধার পোশাক পাঞ্জাবি টুপির বেশ ধরেছে। তাহলে কেউ আপত্তি করত না।
আরেকটি চ্যানেল বেশ কয়েকজন মাওলানার ওয়াজের কিছু বাক্য প্রচার করে বিকৃত ব্যাখ্যা দিলো। আপনি পুরো ওয়াজটি তো প্রচার করছেন না, সেটি সম্ভবও নয়। তাহলে কিয়দংশ প্রচার করে নিজস্ব ব্যাখ্যা জুড়ে দিচ্ছেন কেন? আপনি তো আলেম নন।
এভাবে বহু ঘটনার কথা বলা যাবে। অনুষ্ঠান রেকর্ডে/ধারণে প্রচারে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে।ইসলাম ধর্ম নিয়ে বিকৃত ও অপপ্রচারের জন্য ইহুদি বিশ্ব কোটি টাকার মিশনে নেমেছে। চোখেই তো দেখতে পাচ্ছেন, সৌদি ফাইটারজেট ইয়েমেনকে ধ্বংস করছে।
ঈসরাইল ফিলিস্তিনকে ধ্বংস করছে, সৌদি যুবরাজ ইবনে সালমান (বর্তমানে তাকে সবাই খুনি বলে ডাকছে) গোপনে ঈসরাইল সফর করছে। আরব বসন্ত সিরিয়ায় এসে থেমে যায়। বাশার তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে রাশিয়ার সাথে হাত মেলায়, সরকারি আর বিদ্রোহী দ্বন্দ্বে সিরিয়াও ধ্বংসের পথে।
বহু আগেই নিঃশেষ হয়েছে ইরাক ও আফগানিস্তান। চিনের উইঘুরে লক্ষ লক্ষ মুসলিম বন্দীখানায়। মায়ানমারের আরাকান এখন নিশ্চিহ্ন। মিশরে বিনা বিচারে কারাবন্দী হাজারো মানুষ।
মিন্দানাওয়ের মুসলিমরা নিপীড়িত। মালয়শিয়ায় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, বাংলাদেশেও কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। আফ্রিকার কোন মুসলিম দেশেই শান্তি নেই। সোমালিয়ার জাহাজ ডাকাতির কথা কে না জানে। লিবিয়া অনেক আগেই আমেরিকা ধ্বংস করে দিয়েছে।
আলজেরিয়ার গণতন্ত্রের কবরের কথা সবাই জানে। ইসলামের আলো যেখান থেকে ছড়িয়েছে সেই সৌদি আরবে সবচে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘন চলছে বর্তমান যুবরাজের নেতৃত্বে।
তার নেতৃত্ব গ্রহণের পর থেকে সৌদি আরব সারা বিশ্বের সমালোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে। রাজতন্ত্রের সমালোচনাকারী নাগরিক, প্রভাবশালী যুবরাজ, খোতবায় সতর্ককারী ঈমাম সবাইকে কারাবন্দী বা দেশান্তরি করেছেন।
শেষমেশ জামাল খাশোগিকে তুরস্কের দূতাবাসের ভেতর কিলারগ্রুপ পাঠিয়ে হত্যা করে ধরা খেয়েছেন। এই যুবরাজ আগামী দিনে ‘খাদেমাইনে হারামাইন এ শরীফাইন’ হবেন? কল্পনা করা যায়? তিনি কি তা পারবেন? সময় বলে দেবে।
তিনি সারা বিশ্বের প্রাণের স্পন্দন মক্কা মদিনার দেশ সৌদি আরবের মুসলিম নামীয় সর্বোচ্চ নেতা হয়ে মুসলমানদের কতটা সুনাম অর্জন করছেন? কতটা দূর্নাম রটাচ্ছেন, ভেবে দেখেছেন?
অবশ্য ইতোমধ্যে বাদশাহী শাসনের বিরুদ্ধে খোদ সৌদি পত্রিকায় এই প্রথম বিবৃতি এসেছে।
উপরের চিত্রটি তুলে ধরার উদ্দেশ্যে হল, এটা বলা যে, আসলে মুসলমানরাই প্রতিনিয়ত নিজের পায়ে কুড়াল মেরে যাচ্ছে। কি দেশে কি বিদেশে। আপনি যদি আপনার নির্দোষ ভাইকে অপরাধী প্রমাণের জন্য উঠে পড়ে নামেন, তার মৃত্যু কামনা করেন,হ ত্যা করেন, বিষোদগার করেন, তাহলে আপনার বিরোধীরা তো সুযোগ নেবেই।
ইয়েমেনে হামলার জন্য অস্ত্র, সিরিয়ায় হামলার জন্য অস্ত্র কি কোন মুসলিম দেশ দেয়? নিজেরা যুদ্ধ করে কার অস্ত্র ব্যবসা জমজমাট করছেন? গোটা মুসলিম জাতিকেই আজ ভাবতে হবে।
আর এই ভাবনাটা দেশ থেকেই শুরু করুন। আলেমদের অপবাদ-নিন্দা বন্ধ করুন। বিশ্ব এখন ডিজিটালাইজড। আপনি আলেমদের মর্যাদা দিতে শুরু করুন, প্রচারটা মিনিটের ব্যাপার।আপনার নিন্দাচর্চা ও মিনিটেই ছড়িয়ে যাচ্ছে।
অমুসলিম আর নাস্তিকদের কাছে প্রতিনিয়ত শুনতে হয়, তোমরাই তো তোমাদের মারছ, আমাদের কাছে সাহায্য চাচ্ছ, একটা তাচ্ছ্যিলের হাসি দিয়ে বলে-আমরা সাহায্য করছি, ব্যবসাও হয়, মন্দ কি? (কথাটি কল্পনায় বললাম, এটাই সত্যি)।
আমি আগেও লিখেছিলাম, টিভির পর্দায় যখন আর্টিস্টদের কেউ পাজামা-পাঞ্জাবি টুপি পড়ে আসবে, তখনই সামনে বসা দর্শকেরা হেসে ফেলে, এই ভেবে যে এখনই এই ভন্ড একটা ভন্ডামি করবে।
কোথায় পেয়েছেন এসব? সম্মানিত আলেমদের সুন্নতি পোশাককে যেসব ডিরেকটর, নাট্যকার ব্যঙ্গাত্মকভাবে চিত্রায়িত করছেন তাদের উদ্দেশ্যে কয়টি প্রশ্ন করতে চা-
১। কয়জন আলেম তথা মাদরাসা ছাত্র শিক্ষককে ধুমপান করতে দেখেছেন, আপনাদের মধ্যে আশিভাগের ওপর ধুমপায়ী। (গাজাখোরদের আনলাম না)।
২। কয়জন আলেম মদপান করেন। তারা তো মদের নামই জানেন না। আর আপনাদের মধ্যে? মুখ খুললাম না।
৩। কয়জন আলেম দুর্নীতি করেন? দুর্নীতির চেয়ারেই তো তারা নাই। আর আপনাদের দুর্নীতি? থাক!
৪। কয়জন আলেম ব্যাংকের ঋণ মেরে দিয়েছেন? কয়জন মাওলানা অর্থ আত্মসাৎএ দুদকের মামলা খেয়েছেন? আপনারা সুট-টাই ভদ্রলোকেরাই তো দুদকের বারান্দায় জুতা ক্ষয় করেন।
৫। কয়জন মাদরাসার ছাত্র চাঁদাবাজি করে জেল খাটছেন? আর ভার্সিটির ছাত্র? অবশ্যই সব ছাত্র নয়। কিন্তু কন্ট্রাক্টটর বলতে পারবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন তৈরিতে ছাত্র নেতাদের কত দিতে হয়।
কোন মাদরাসা ভবন তৈরিতে কোন ছাত্র চাঁদা চেয়েছে একটা উদাহরণ আছে? তারপরও তারা খারাপ?
৬। ঠকবাজ জোচ্চোরদের পারসেন্টেজ আলেমদের মধ্য কী পরিমাণ আছে তা পাগলেও জানে। জানেন না আপনারা, কারণ আপনারা জ্ঞানপাপী।
৭। পলিটিক্যাল ব্ল্যাকমিলার, সোস্যাল করাপটেড, স্মাগলার এগুলো আলেমদের মধ্যে কত পারসেন্ট তাও মানুষ জানে। অনেক লম্বা করা যাবে, আজ এতটুকুই বললাম।
বেইলি রোডের নাট্যপাড়া, সিনেমা নাটক শুটিংস্পট হোতাপাড়া, পুবাইল, কোক-স্টুডিওতে আপনারা খালি নাটকই বানান না আরও কিছু যে করেন তা তো বিনোদন পত্রিকার খোরাক। এগুলো কি আলেমরা করে? কেন ওখানে তাদের চরিত্র হানী করার চেষ্টা করেন?
অতএব আর আলেমদের ছোট করবেন না। এতে নিজেরাই ছোট হন। কারণ সে তো আপনার বাবার বিয়ে পরিয়েছেন। আপনারও বিয়ে পড়িয়েছেন বা পড়াবেন । তার পেছেই তো নামাজ পড়েন। আপনার জানাজাও তিনিই পড়াবেন, যেমন পড়িয়েছেন আপনার বাবার!
আর মাদরাসা ছাত্র-শিক্ষকদেরও আরও স্মার্ট এবং বিজ্ঞানমনষ্ক হতে বলব। এ বিষয়ে আর একদিন লেখব ইনশাআল্লাহু তায়লা।