শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


হৃদয়ে প্রিন্সিপাল

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সাইফ সিরাজ
কবি

সময়টা চুরানব্বইয়ের কোন একদিন। আমি তখন সুনামগঞ্জে। বিশ্বম্ভরপুরের চিনাকান্দি মাদরাসায় পড়ি। নতুন ভর্তি হয়েছি। সেখানকার কালচার নিয়ে তেমন কিছু জানি না। তবে সকল শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর কাছে সিলেটের কয়েকজন শায়খের নাম শুনি বেশ। তাদের সঙ্গে প্রিন্সিপাল সাহেব খুব প্রবলভাবে উচ্চারিত হন।

আমি ক্রমশঃ প্রভাবিত হতে থাকি। আমাদের অঞ্চলে আতাউর রহমান খান সাহেব। আনওয়ার শাহ সাহেব। খালেদ সাইফুল্লাহ সাদী সাহেবের নাম আমরা এভাবে বলতাম। কিন্তু সিলেটের এই প্রিন্সিপাল সাহেব আমাকে নতুনভাবে আচ্ছন্ন করতে শুরু করলেন।

দুই.
আব্বার হাতে একটি পত্রিকা। আব্বাকে ঘিরে আছেন স্থানীয় কয়েকজন মুসুল্লি। কেউ একজন বলছেন, "প্রিন্সিপাল সাহেবের এতটা সাহস দেখানো কি ঠিক হলো?" আব্বা বলছেন, "এইটাই ঈমান। ঈমানের দাবীতেই তিনি দুঃসাহসী।"

আমি কথার সূত্র ধরতে চেষ্টা করছি। এমন সময় আব্বা পড়তে শুরু করলেন। "প্রিন্সিপাল হাবিব তসলিমা নাসরীনের মাথার মূল্য নির্ধারণ করেছেন পঞ্চাশ হাজার টাকা।" (শব্দ এদিক সেদিক হতে পারে।)

আমি তখনই আমাকে জানালাম আগামী বছর এই বীর প্রিন্সিপালের মাদরাসার ভর্তি হবো। আমি এমন একজন হুজুরের ছাত্র হতে চাই। বাবা আস্বস্থ করলেন। তিনি নাহবেমীরে আমাকে কাজির বাজারে ভর্তি করবেন।

আফসোস, আমার আর সেখানে পড়া হলো না।

তিন.
এরপর বাড়ি ফিরলাম। তসলিমার বিচারের আন্দোলন তখন তুঙ্গে। আমি মিছিলে যাই। নান্দাইলে মিছিল শেষে খাইলেদ সাইফুল্লাহ সাদী সাহেবের বয়ান শুনি। হুংকার শুনি। আমার মনে পরে প্রিন্সিপালের কথা।

রিক্সা নিয়ে মাইকিং করতে যাই বড় ভাইদের সঙ্গে। মাইক্রোফোন হাতে পাই না। হঠাৎ যখনই মাইক্রোফোন হাতে পাই একবারের জন্য। আমি বলি প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান দিচ্ছে ডাক। তসলিমারা নিপাত যাক।

আমার বন্ধুরা আমাকে প্রিন্সিপাল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আমি তার কথা বলি। কিছুটা বাড়িয়েও বলি। তসলিমার মাথার মূল্য নির্ধারণের কথা বলি। বিশাল কাজির বাজার মাদরাসার কথা বলি। তার ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের কথা বলি। আরোও বলতে আব্বাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করি।

কিশোরগঞ্জে যাই মিছিলে। আরমান শহীদ হন। আমি একজন প্রিন্সিপালের প্রত্যাশা করি। আমি মনে মনে চাই প্রিন্সিপাল সাহেব যদি কিশোরগঞ্জে চলে আসতেন। শহীদ আরমান স্মরণে কিশোরগঞ্জে আলোচনা সভা হয়।

জাগপার নেতা শফিউল আলম প্রধান আসেন। আমি প্রিন্সিপালের অপেক্ষা করি। না তিনি এই স্মরণ সভায় আসবেন না। আমি আশাহত হই। মন খারাপ করে বাসে উঠি। বাড়ি চলে আসি। রাতের খাবারে বাবার সঙ্গে আবারও প্রিন্সিপালের প্রসঙ্গ। বাবা বলেন প্রিন্সিপাল হবি? আমি চমকে উঠি। প্রসন্ন হয় আমার মুখ!

চার.
নিরানব্বই সালে আমাদের অঞ্চলের ছাত্রদলের কয়েকজন কর্মীর নামে জননিরাপত্তা আইনে মামলা হলো। ওরা পালিয়ে থাকল কিছু দিন। মামলা নিষ্পত্তি হলে ওরা ফিরে এলো। কিন্তু সবাই অচেনা হয়ে গেলো।

সবার গায়ে পাজামা পাঞ্জাবি। মাথায় টুপি। মুখে লম্বা দাড়ি। সবার তেলাওয়াত সুন্দর। কিন্ত সময় মাত্র ছ'মাস কিংবা একটু কম বেশি হবে।

আমার সঙ্গে যখন ওদের প্রথম সাক্ষাত হলো আমি আশ্চর্য হয়ে ওদের অবস্থা জানতে চাইলাম। পুরো বিবরণ জানতে চাইলাম। ওরা জানালো, "এমপি সাহেবের চিঠি নিয়ে সিলেটের এক মাওলানার কাছে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এই মাওলানার এতই প্রভাব, আমগোরে বললেন থাকবা, খাইবা, কেউ তোমাদের ধরতে আসবে না।

তবে যেহেতু তোমাদের কোন কাজ নাই। তাই কুরআন পড়তে পারো এখানে। এরপর আমরা তার প্রতি মুগ্ধ হতে লাগলাম। একসময় নিজেরা বদলেই গেলাম।"

এই পাঁচজনের দুইজন পরবর্তীতে তাকমীল পর্যন্ত পড়েছিলেন। কলেজ ছেড়ে। বাকিদেরকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত আমলদার পেয়েছি। সিলেটের সেই মাওলানা হলেন প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান রহ.।

পাঁচ.
গত ষোল সালে সিলেটে গিয়েছিলাম আহমদ রশীদ ভাইয়ের আমন্ত্রণে। সেখানেই আমার স্বপ্নের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাত। তিনি আমাদের নসীহত করেছিলেন। বলেছিলেন, যেখানেই থাকো, ভুলবে না তুমি কওমী মাদরাসার সন্তান।

ছয়.
এই সাহসী পুরুষ আজ ইন্তেকাল করেছেন। আজকের জানাজার ছবি দেখে তার মাকবুলিয়্যাতের কিছুটা অনুভব করেছি। মাওলার নিকটে তিনি মাওলার প্রিয় হয়ে থাকুন।

দিদারে এলাহীতে তিনি থাকুন প্রাণবন্ত। হাউজে কাউসারের পূর্ণ হিস্যা পান করুণ পরম মর্যাদায়। আল্লাহুম্মা আমীন।

সিলেটের আলেম জনতা মেয়র সাংসদ, জলে ভেজা সবার চোখ

-আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ