শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


দাওরায়ে হাদীসের স্বীকৃতি; অজ্ঞদের সমালোচনা ও বাস্তবতা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা মাহমূদ হাসান কুতুব জা‘ফরী

জাতীয় সংসদের ২২তম অধিবেশনে আল-হাইআতুল উলয়া লিল জামিআ‘তিল কাওমীয়া বাংলাদেশ-এর অধীন বাংলাদেশের কওমী মাদরাসাসমূহের সর্বোচ্চস্তর দাওরায়ে হাদীসকে ‘মাস্টার্স (ইসলামিক স্টাডিজ/আরবী) সমমান’ দিয়ে যে স্বীকৃতির আইন পাস হয়েছে, এটা কওমী অঙ্গণের জন্য সময়ের প্রেক্ষাপটে ঐতিহাসিক মাইল ফলক।

জাতীয় সংসদে এই স্বীকৃতি আইন পাসের জন্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ও শিক্ষামন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যবৃন্দ এবং সামরিক সচিবসহ সংশ্লিষ্ট যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন সবার প্রতি মুবারক অভিনন্দন।

এ আইন পাসের মাধ্যমে কওমি শিক্ষা সমাপনকারীদের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উপকার হলো:

১. এর মাধ্যমে কওমি শিক্ষা বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে একটি স্বীকৃত শিক্ষা বলে বিবেচিত হলো।

২. যে সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে স্বীকৃতির অভাবে যোগ দেওয়া যেত না, সে সকল প্রতিষ্ঠানে কওমি শিক্ষার্থীদের সুযোগ তৈরি হবে।

৩. শিক্ষা ও কর্মের জগতে সার্বিক প্রতিযোগিতার দরজা সম্প্রসারিত হলো, এতে আশা করা যায় কওমি শিক্ষার মানের আশানুরূপ উন্নয়ন হবে।

এসে গেল যাদুকরী মাদরাসা ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার

যতটুকু জানি, কওমি শিক্ষার স্বীকৃতি আদায়ে প্রথম পটিয়া মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা হারুন ইলামাবাদী রহ. তৎকালীন সরকারের সাথে আলোচনা করেন।

তারও পূর্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ রহ. স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে কথা বলেন।

পরবর্তী সময়ে আমরা মরহুম শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হকের নেতৃত্বে এই স্বীকৃতি আদায়ে রাজপথে আন্দোলন দেখি। যদিও সে আন্দোলনের সাফল্য কার নেতৃত্বে উঁকি দিচ্ছিল সেটা নিয়ে মতনৈক্য শুনা যায়। এবং এ কথাও কওমি অঙ্গনে বহুল প্রচারিত, তখন জামায়াতে ইসলামীর কারণে আন্দোলন পূর্ণ সফলতা পায়নি।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর মাওলানা ফরীদ উদ্দিন মাসউদের প্রচেষ্টায় কওমি সনদের স্বীকৃতির ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তিনি যেহেতু কওমি অঙ্গনের বিরাট অংশের কাছে বিতর্কিত, তাই তার চেষ্টা মাঠে মারা পড়ে।

এরপর সরকার নিজ উদ্যোগে কওমি মাদরসার প্রতিনিধিত্বশীল বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ-এর সভাপতি আল্লামা শাহ আহমাদ শফীর দ্বারস্ত হলে তিনি সবার পরামর্শক্রমে স্বীকৃতি গ্রহণে সম্মত হন এবং স্বীকৃতির কার্যক্রম দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায়।

তবে স্বীকৃতির পূর্ণতা হতো ইউনিভার্সিটি সংশ্লিষ্ট হলে, এটাও বেফাক ছাড়া অন্য বোর্ডগুলোর বিরোধিতা ও অদূরদর্শিতায় হয়নি বলেই মনে করি। এখন শুনা যাচ্ছে তারাই এর জন্য আফসোস করছে।

আলহামদুলিল্লাহ, শফী সাহেব হুজুরের নির্দেশনায় বেফাকের সিনিয়র সহ-সভাপতি আল্লামা আশরাফ আলী, মহাসচিব মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস, মাওলানা নুরুল আমীনসহ অন্যান্যরা সরকারের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কওমী মাদরাসার সকল দাবি-দাওয়া অক্ষুণ্ন রেখে স্বীকৃতি আদায়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।

কওমি মাদরাসা ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার – বিস্তারিত জানুন

তবে তাদের এ কাজ একেবারে সহজও হয়নি, কারণ বোর্ড সংশ্লিষ্ট যেসব উলামায়ে কেরাম বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতির সাথে জড়িত। তারা পদে পদে বাধার সৃষ্টি করেছেন। তারা তাদের রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করতে সব সময় সচেষ্ট ছিলেন এবং মরহুম মহাসচিবকে তারা বহুক্ষেত্রে ব্যবহারের চেষ্টাও করেন। কিন্তু আল্লামা শাহ আহমাদ শফীর দৃঢ়তায় তারা ব্যর্থ হন।

একটা বিষয় লক্ষণীয়, এই স্বীকৃতির পূর্বে দেশের বর্তমান উচ্চপদস্থ কোন পদাধীকারী কওমি মাদরসার ব্যাপারে বাস্তবসম্মত কোনো কথা কখনো বলেনি।

কিন্তু যখন স্বীকৃতি ঘোষণার অনুষ্ঠানে আল্লামা শাহ আহমাদ শফী, আল্লামা অশরাফ আলীসহ উপস্থিত উলামায়ে কেরামের সামনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তব্যে বাস্তবতা-সফলতা তুলে ধরে বললেন, এই স্বীকৃতির কারণ হলো, এ দেশে শিক্ষার সূচনাই হয় কওমি মাদরাসা থেকে, এজন্য এ শিক্ষা স্বীকৃতির বাইরে থাকতে পারে না। তারপরই রাষ্ট্রের সকল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এ শিক্ষার বাস্তবতা অবলীলায় স্বীকার করা শুরু করলেন।

সর্বশেষ সংসদ অধিবেশনে এমপিগণ কওমি মাদরাসার বাস্তব সুন্দর দিকগুলো ও বৃটিশ খেদাও আন্দোলনে কওমি মাদরাসার অবদান যেভাবে স্পষ্ট করে তুলে ধরলেন, এতে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেল যে, কওমি মাদরাসার শিক্ষা এবং এর অস্তিত্ব এদেশের জন্য অনস্বীকার্য।

কিন্তু এই বাস্তবতা স্বীকারে কোথাও একটা জড়তা ছিল। এটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাধ্যমে কেটে যায়। এ জন্যও তিনি মুবারকবাদ পাওয়ার যোগ্য। কারণ তার পিতা স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেওবন্দ পড়ুয়া মাওলানা ভাসানী ও মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ এর সংশ্রবপ্রাপ্ত। এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দলটি তাদের হাতে গঠিত। এ জন্য কওমী মাদরাসা ও শিক্ষার বাস্তবতা রাজনৈতিকভাবে ও পারিবারিক ঐতিহ্যগতভাবে তার পক্ষেই স্বীকার করা সম্ভবপর হয়েছে।

আমি মনে করি, আলেমদের হাতে গড়া দলটিই আলেমদের চাহিদা বুঝবে। এজন্য আলেমদেরও সচেতন ও সজাগ হতে হবে।

কওমি সনদের স্বীকৃতি: তসলিমারা কেন ভীত?

এখন কথা হলো, স্বীকৃতি নিয়ে সকল অনিশ্চয়তা দূর করে চূড়ান্ত অনুমোদন হয়ে গেলো। তারপরও একদল ভাসমান বিজ্ঞমহল শুধু শুধু বকওয়াসে লিপ্ত।

মজার ব্যাপার হলো, এ বিষয়ে তাদের ইতোপূর্বে কোনো সমাধানমূলক কিছুই বলতে দেখিনি। তাদের কাজই মনে হয়, হতাশা তৈরি করা। কারণ, তারাই জনবিচ্ছিন্নি ও হতাশাগ্রস্ত। তাদের চিন্তা-চেতনাই বিকারগ্রস্থ।

কওমি মাদরাসার এ স্বীকৃতির পেছনে এদেশের সকল শীর্ষস্থানীয় আকাবির উলামায়ে কেরাম সম্পর্কিত। সেখানে যারা এখনো অভিজ্ঞতার দৌড়ে শিশু তারাই কিনা বলে, আমার প্রতিক্রিয়া মিশ্র।

ভবিষ্যতে তারা রাহবারের আসনে আসলে আমরা এক দিগভ্রান্ত জাতি উপহার পাবো। তাই বলবো, সকল কওমি শিক্ষার্থীদের উচিত হবে, বড়দের দেখানো পথে অবিচল থাকা, এবং কওমি শিক্ষার মূল লক্ষ-উদ্দেশ্য ভালো করে রপ্ত করা।

এ স্বীকৃতির মূল স্পিরিট রাখা হয়েছে উছুলে হাশতেগানাকে। সুতরাং এখন পর্যন্ত যতটুকু দেখা যাচ্ছে, উলামায়ে কেরাম কওমি শিক্ষার মূল লক্ষ-উদ্দেশ্যে অটল থাকলে কওমি শিক্ষা কখনোই স্বকীয়তা হারাবে না।

ইদানিং বিচ্ছিন্ন যে সকল স্বকীয়তা বিবর্জিত কার্যক্রম দেখা গেছে। এগুলো স্থানীয় কিছু আলেমদের অতি উদারতা। কোন কিছুতেই অতি উদারতা ভালো নয়। পাশাপাশি কওমি শিক্ষার্থীদের কওমি শিক্ষার মূল লক্ষ-উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত না হওয়ার ব্যাপারেও আলেমদের চৌকষ থাকতে হবে।

সর্বশেষ কয়েকটি বিষয়ে আল-হাইআতুল উলয়া লিল জামিআ‘তিল কাওমীয়া বাংলাদেশ-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করবো-

এক. কওমি শিক্ষার প্রাপ্ত মাস্টার্স সমমান রক্ষার সার্বিক ব্যবস্থা নিতে হবে।

দুই. দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীর সতের বছর শিক্ষার বিষয়ে আল-হাইআতুল উলয়া লিল জামিআ‘তিল কাওমীয়া বাংলাদেশ-এর পক্ষ থেকে উপযোগী সিলেবাস সকল প্রতিষ্ঠানে বাস্তবায়নে আইন করতে হবে।

তিন. শর্টকোর্স নামক দাওরা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

চার. দাওরায়ে হাদীস সমাপনকারীর জন্য আন্তর্জাতিক মানের উচ্চ শিক্ষাগ্রণে নিশ্চয়তা দানে পরিকল্পনা নিতে হবে।

পাঁচ. শিক্ষারগন্ডি পেরিয়ে কর্মজীবনে দাওরায়ে হাদীস সমাপনকারী যে সব বাধার সম্মুখীন হতে পারে, সে সব বাধা উত্তরণে আল-হাইআতুল উলয়া লিল জামিআ‘তিল কাওমীয়া বাংলাদেশ-এর মনোযোগী হতে পারে।

লেখক: সমাজ সেবক, রাজনীতিবিদ
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান: অধিকার বাস্তবায়ন কমিটি

 বিসফটি – বিস্তারিত জানুন


সম্পর্কিত খবর