মুহাম্মদ ছফিউল্লাহ হাশেমী : কুরবানি ইসলামি শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। এটি আদায় করা সামর্থবান সকল মুসলিমের ওপর ওয়াজিব। সামর্থ থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানি করে না, তার ব্যাপারে মহানবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘যে ব্যক্তি সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করবে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে।’ (মুসতাদরাকে হাকেম)।
উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- ‘কুরবানির দিনে মানব সন্তানের কোনো নেক আমলই আল্লাহ তাআলার কাছে ততো প্রিয় নয়, যতো প্রিয় কুরবানি করা। কুরবানির পশুর শিং, পশম ও ক্ষুর কিয়ামতের দিন (মানুষের আমলনামায়) এনে দেয়া হবে। কুরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহ তাআলার নিকট পৌঁছে যায়। সুতরাং তোমরা আনন্দচিত্তে কুরবানি করো।’ (তিরমিজি)।
মানুষের মনের সর্ব্বোচ্চ ত্যাগই হলো কুরবানির উদ্দেশ্য। কেননা কুরবানির পশুর রক্ত, মাংস, পশম, হাড় কোনো কিছুই মহান আল্লাহ তাআলার কাছে পৌঁছে না। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কেবল মানুষের মনের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে- ‘এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া।’ (সূরা হজ : ৩৭)
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রদত্ত সকল ইবাদতের মূল উদ্দেশ্যই হলো মানুষের হৃদয়ে পার্থিব এই জীবনের ক্ষণস্থায়িত্বকে দৃশ্যমান করে তাকে পার্থিব জীবনের মোহমুক্ত রাখা এবং মুহূর্তের নোটিশে এই জগত ছেড়ে যাওয়ার জন্য তৈরি করা। কুরবানিও এর ব্যতিক্রম নয়।
কুরবানির পশু নিজে জবাই হয়ে বস্তুত তার জবাইকারীদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় জীবনের অনিবার্য পরিণতি। বলে দিয়ে যায়, মৃত্যুর সেই অবশ্যম্ভাবী পরোয়ানা একইভাবে তাদের মাথার উপরও ঝুলছে। পার্থক্য শুধু সময়ের, কিছুদিন আগে আর পরে। কিন্তু নিয়তি এক, পরিণতিও এক। স্বজনদের ভাবাবেগ, প্রযুক্তির বেগ, ক্ষমতার দাপট কিংবা শক্তি-সামর্থ-সম্পদ কোনো কিছুই কাউকে রক্ষা করতে পারবে না মৃত্যুর হাত থেকে, এতোটুকু বদলাতে পারবে না কারো মৃত্যুকালীন অবস্থা।
চূড়ান্ত অসহায়ত্বের সাথে সবাইকে চেয়ে দেখতে হবে প্রিয়জনের মরণ যাত্রা। চরম সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে যেকোনো মুহূর্তে, চোখের পলকে এবং সম্পূর্ণ একাকি। অবশ্যম্ভাবী যাত্রার ওই মুহূর্ত ভালো কিছু হবে নাকি কুরবানির পশুর মতো হবে কিংবা তার চেয়েও ভয়াবহ হবে, তা শুধু তিনিই জানেন যিনি এই জীবন ও মরণের প্রকৃত মালিক। যার হাতে আছে সব জীবন আর মৃত্যুর লাগাম।
যে ব্যক্তি পরম এই মহাসত্যকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে, তার দ্বারা কখনো পার্থিব জীবনে পাপকর্ম করা সম্ভব হবে না। কুরবানি থেকে পাওয়া সত্য উপলব্ধির এই পরম শক্তিই নিজের মধ্যে বিরাজমান পশুত্বকে পরাভূত করে সেখানে স্নেহ-মমতা-ভালোবাসাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। এর মাধ্যমে আমাদের সমাজ থেকে অন্যায় অবিচার দূর করা সম্ভব হবে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে সেই তাওফিক দান করুন। আমিন!
প্রাবন্ধিক ও কলেজ শিক্ষক
hashemy1984@gmail.com