জহির উদ্দিন বাবর
আলেম, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্ভবত ২০০০ সাল। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা চারদলীয় জোটের তখন যৌবনকাল। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সেই জোটের বাকি তিন শীর্ষ নেতা হলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, অধ্যাপক গোলাম আযম ও শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক।
ময়মনসিংহে তখন একটি মহাসমাবেশ হয়েছিল। সেই সমাবেশের মঞ্চটি ছিল দোতলা। উপর তলায় চার শীর্ষ নেতা, নিচে অন্য নেতারা। সেই সমাবেশের বিশাল ছবি তখন সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। লাখো জনতার সেই মহাসমাবেশে এরশাদের বক্তব্যটি ছিল খুবই হৃদয়গ্রাহী।
তার বক্তব্যটি ছিল মোটামুটি এরকম- স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগকে হঠাতে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছি, চারদলীয় জোট করেছি। যারা এই জোট থেকে বের হবে তারা ‘জাতীয় গাদ্দার’ হিসেবে পরিচিত হবে।
মজার ব্যাপার হলো, এর মাত্র কয়েক দিন পর সর্বপ্রথম জোট থেকে বেরিয়ে যান সেই এরশাদ। পরে অবশ্য নাজিউর রহমান মঞ্জুর অংশটি জোটে থেকে যায় এবং চারদলীয় জোট অক্ষুণ্ন থাকে।
সেই জোট ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে।
প্রায় দেড় যুগ আগের সেই ঘটনাটি এখানে উল্লেখের কারণ হলো সাবেক সেনাশাসক এরশাদের চরিত্রটি সম্পর্কে একটু ধারণা দেয়া। আশির দশকের শুরু থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির প্রতিটি বাঁকে তার অংশগ্রহণ রয়েছে। তিনি নয় বছর দেশ শাসন করেছেন।
তার আমলে দেশে যে অনেক উন্নয়ন হয়েছিল সেটা অবশ্য কেউই অস্বীকার করেন না। তবে তার রাজনৈতিক ‘অস্বচ্ছতা’ এবং ‘পল্টিমারা’ স্বভাবের কথা কারও অজানা নয়।
আশির দশকে রাজনীতি সচেতন শ্রেণিটির কাছে এরশাদের চরিত্র স্পষ্ট। মাঝে তিনি অনেক জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। এজন্য অনেকের একটা সহানুভূতি আছে তার প্রতি।
তাছাড়া প্রধান দুই দলের অপশাসন দেখতে দেখতে অতিষ্ঠ জনগণ মাঝে মাঝে তার প্রতি ঝুঁকতে চায়। কিন্তু তার অস্থিরতা ও ‘পল্টিমারা’ স্বভাবের কারণে কেউই আস্থা পায় না। আর তার নিজের দলের অবস্থাই হযবরল।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন ঘিরে সাবেক এই স্বৈরশাসকের নাটকের বিষয়টি কারও ভুলে যাওয়ার কথা না। অনেকে বলে থাকেন, তিনি ‘জাতে মাতাল তালে ঠিক’। এসব নাটকের অবতারণা মূলত ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে দেনদরবারের সুবিধার্থেই করেছিলেন। বিতর্কিত সেই নির্বাচনের সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী তিনি এবং তার দল।
তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হয়েছেন আর জাতীয় পার্টি পেয়েছে সংসদে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে কোনোটাই হয়ত তাদের কপালে জুটত না।
এরশাদের প্রসঙ্গ এখানে আলোচনায় আসার কারণ হলো শনিবার তার সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছে আলোচিত একটি ইসলামি দল। শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ.-এর হাতেগড়া দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস।
২০০৫ সালে ভাঙনের মুখে পড়া দলটি অবশ্য এর আগে ২০০৬ সালে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গেও একটি জোট করেছিল। দেশের প্রধান তিনটি দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোটের অভিজ্ঞতা অর্জিত হলো দলটির। এমন অভিজ্ঞতা আর কোনো ইসলামি দলের আছে কি না জানা নেই।
জাতীয় পার্টির সঙ্গে এই জোটকে বলা হচ্ছে নির্বাচনী জোট। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ছয় দফা চুক্তির ভিত্তিতে এই জোট হয়েছে। পবিত্র কুরআন-সুন্নাহবিরোধী আইন না করা; সংবিধানে আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস কথাটি পুনঃস্থাপন; কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি দিয়ে জাতীয় সংসদে আইন পাস; ইসলাম, নবী, রাসুল ও সাহাবিদের নামে কটূক্তিকারীদের শাস্তির বিধান; হজরত মোহাম্মদ সা. সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী এটা সংবিধানে যুক্ত করা এবং সব ধর্মের লোকদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করার বিষয়টি রয়েছে সেই ছয় দফায়।
এর আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে পাঁচ দফা চুক্তি করেছিল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। আওয়ামী লীগের সঙ্গে দলটির সেই সময়ের চুক্তি নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ তাদের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে অনেকটা ছাড় দিয়ে এই চুক্তি করে।
এজন্য তাদের মিত্রদের কড়া সমালোচনার মুখে পড়তে হয় তাদেরকে। আর এই চুক্তির জন্য বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসেরও অনেক সমালোচনা হয়। তবে পরবর্তী সময়ে প্রমাণিত হয়েছে, এই চুক্তিটি খুব একটা খারাপ কিছু ছিল না।
ব্যবসা নিয়ে জটিলতা? ক্লিক করুন এখানে
যে পাঁচটি দফা দেয়া হয়েছিল সেগুলো শুধু ইসলামি দলগুলোর নয়, এদেশের সিংহভাগ মানুষের দাবি। তবে এক-এগারোর রাজনৈতিক ঝড়ে সেই জোট কার্যকারিতা হারায়।
বর্তমানে জাতীয় পার্টির সঙ্গে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের জোট করা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে ইসলামপন্থীদের মধ্যে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এর পক্ষে-বিপক্ষে লেখালেখি হচ্ছে।
খোদ বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নেতাকর্মীদের কেউ কেউ পর্যন্ত এই জোটের সমালোচনা করেছেন। এর কারণে দলটি ইমেজ সংকটে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকেই।
একটি রাজনৈতিক দল যে কারও সঙ্গে জোট করতেই পারে। আওয়ামী লীগ-বিএনপির সঙ্গে ইসলামি দলগুলো জোট করতে পারলে জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোট করায় বাধা কোথায়? বরং নারী নেতৃত্বাধীন প্রধান দুটি দল অপেক্ষা জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোট করাই বেশি যুক্তিযুক্ত ইসলামি দলগুলোর জন্য।
নারী নেতৃত্বের প্রশ্নে আপসহীন চরমোনাইয়ের মরহুম পীর মাওলানা ফজলুল করিম ২০০১ সালে এরশাদের সঙ্গে এ ধরনের নির্বাচনী জোট করেছিলেন। সুতরাং নির্বাচনকে সামনে রেখে এ ধরনের জোট করা বিচিত্র কিছু নয়।
তাছাড়া ভোটের রাজনীতিতে ইসলামি দলগুলোর অবস্থান এখনও উল্লেখ করার মতো নয়। এই অবস্থায় অনেকটা বাধ্য হয়েই তাদেরকে কোনো না কোনো জোটের আশ্রয় নিতে হয়।
তবে জোটের রাজনীতি ইসলামি দলগুলোর স্বকীয়তা ধরে রাখার ক্ষেত্রে অনেক বড় অন্তরায়।
২০০১ সালের নির্বাচনে জোটের কারণে ইসলামি দলগুলো কয়েকটি এমপি পদ পেয়েছিল বটে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেটা অনেক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইসলামি রাজনীতি করেও এমপি হওয়া যায়, ক্ষমতার ভাগিদার হওয়া যায় এমন ধারণা সেই নির্বাচনেই জন্মে। ফলে পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাকেন্দ্রিক টানাপোড়েন, দ্বন্দ্ব-সংঘাত আমরা ইসলামি দলগুলোর মধ্যেও দৃষ্টিকটুভাবে লক্ষ্য করেছি।
গতানুগতিক রাজনীতি ও ইসলামি রাজনীতির মধ্যে কিছুটা হলেও পার্থক্য থাকা চাই। শুধুই এমপি-মন্ত্রী হওয়া কিংবা ক্ষমতার ভাগ পাওয়ার জন্য ইসলামি রাজনীতি নয়। রাজনীতির লক্ষ্য যদি হয় ক্ষমতা তাহলে গতানুগতিক দলগুলো করলেই ভালো।
হ্যাঁ, নিজেদের আদর্শ ও বিশ্বাসের গণ্ডিতে থেকে ক্ষমতা ভোগ করা দোষের কিছু নয়। আলেম-উলামা সংসদেও প্রতিনিধিত্ব করুক এটা কে না চায়! তবে তাদের স্বকীয়তা যেন বজায় থাকে সেটা অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে।
এরশাদের সঙ্গে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের জোট নিয়ে নানাজন না কথা বলছেন। এই জোটের ভবিষ্যৎ নিয়েও কেউ কেউ শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। মূলত সময়ই বলে দেবে এই জোট কতটা কার্যকর হবে।
যেহেতু এরশাদের সঙ্গে জোট এজন্য সংশয়টা জোরালোভাবে সামনে আসছে। কারণ এরশাদকে অনেকে ‘রাজনীতির বিনোদন’ মনে করেন। তার আগের কথার সঙ্গে পরের কথার এতোটাই অমিল ও অসংলগ্নতা যে, অনেক সময় দলের নেতারাই হতবাক হয়ে যান।
জোট ঘোষণা উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কোনো কোনো বক্তা এরশাদকে ইসলাম প্রতিষ্ঠার ‘নতুন ইমাম’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। আলেম-উলামার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা এরশাদ সত্যিই এদেশের ইসলামপন্থীদের আশ্রয়ের জায়গা হতে পারতেন, যদি তিনি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হতেন।
আদর্শের কথা তিনি যতই মুখে উচ্চারণ করুন, ক্ষমতার প্রতি লোভটা তার প্রচণ্ড। তিনি বিভিন্ন সময় স্পষ্ট করে বলেছেন, যেকোনো মূল্যে তিনি আবার ক্ষমতায় যেতে চান। এমন ক্ষমতামুখি একজন মানুষের সঙ্গে জোট করে আদর্শের ঠিকানা খোঁজা কতটা সফল হবে সেটা সময়ই বলে দেবে।
বছরখানেক আগে ৫৮টি নামসর্বস্ব দল নিয়ে এরশাদ জোট করেছিলেন। সেই সময় এটা নিয়ে অনেক হাস্যরস সৃষ্টি হয়েছিল। সেই দলগুলোর এখন কী অবস্থা তা হয়ত তিনি নিজেও জানেন না।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সঙ্গে জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তবে আমরা বিশ্বাস করি, শায়খুল হাদিস রহ.-এর হাতে গড়া দলটি জোট-মহাজোট যেখানেই যাক নিজেদের ঐতিহ্য বজায় রাখবে। সাময়িক স্বার্থের পেছনে ছুটে সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হবে না।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, ঢাকাটাইমস
জোট নিয়ে আরও লেখা পড়ুন
‘জাতীয় পার্টির সঙ্গে মজলিসের জোট ইমেজ সংকট তৈরি করবে’
এরশাদ আলেমদের প্রতি আন্তরিক; সংসদেও দেখতে চান: আতাউল্লাহ আমিন
ইসলামি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই মজলিসের সঙ্গে সমঝোতা করছি: এরশাদ
-আরআর