আতাউর রহমান খসরু
আওয়ার ইসলাম
গত এক দশকে মধ্যপ্রাচ্যের আরব বসন্ত থেকে শুরু করে দেশে দেশে তারুণ্যের জাগরণ দেখছে বিশ্বব্যবস্থা। স্বতঃস্ফূর্ত এ জাগরণ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও তার ওপর সওয়ার শাসক গোষ্ঠিকে।
তরুণরা জরাগ্রস্থ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও কায়েমি স্বার্থপুষ্ট শাসক গোষ্ঠির ওপর নির্ভর করে থাকতে চায় না; বরং তারা প্রচলিত বিশ্বব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়েছে। তারা এখন নিজের ভাগ্য নিজেই নির্ধারণ করতে চায়। তারা চায় সময়ের গতিকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে এবং জীবনোন্নয়নের প্রশ্নে তারা রাষ্ট্র ও সমাজের কোনো অজুহাত শুনতে প্রস্তুত নয়।
তারুণ্যের এ জাগরণ বৈশ্বিক। শুধু তৃতীয় বিশ্বের বঞ্চিত বেকার তরুণ-যুবারাই নয় তারুণ্যের স্ফূরণ দেখা যাচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকার দেশগুলোতে।
তরুণ্যের জাগরণ হচ্ছে শাসকদের স্বৈরতন্ত্র, রাষ্ট্রের দুর্নীতি, ধর্মগুরুদের নৈতিক স্খলন ও জীবনের দুঃসময়ের বিরুদ্ধে। তাদের লক্ষ্য যেসব অন্যায় ও অপব্যবস্থা তাদের জীবনকে থমকে দিচ্ছে তার অবসান ঘটাতে হবে এবং পায়ের নিচের মাটি শক্ত করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
কোটা বিরোধী ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশের চলমান দুটি ছাত্র আন্দোলনকে তারুণ্যের বৈশ্বিক জাগরণেরই অংশ মনে করছেন অনেকে। চলমান আন্দোলনসহ যে কোনো জাতীয় ইস্যুতে একটি প্রশ্ন বারবার উচ্চারিত হয়- কওমি তরুণরা কেনো শামিল হচ্ছে না এসব আন্দোলন সংগ্রামে?
তবে কি বৈশ্বিক জাগরণের ছোঁয়া স্পর্ষ করে নি তাদের? নাকি দেশ, মাটি ও মানুষ স্পর্ষ করে না তাদের?
আলেম লেখক ও সাংবাদিক জহির উদ্দিন বাবর মনে করেন, কম হোক বা বেশি বৈশ্বিক পরিবর্তনের ছায়া পড়েছে কওমি অঙ্গনেও। চার দেয়াল উপচানো স্রোত কওমি তরুণদের বাহিরমুখী করেছে।
এখন তারা অনেক বেশি জীবনমুখী। অনেক বেশি সময় সচেতন। কারণ, জীবন, সময়, রাষ্ট্র ও বিশ্ব ব্যবস্থা নিয়ে সরব আলোচনা হয় কওমি তরুণদের মধ্যে। তারা বিভিন্ন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ইস্যুতে বিতর্কে লিপ্ত হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
তাহলে তারা কেনো জাতীয় ও সামাজিক ইস্যুতে সক্রিয় হয় না? তিনি বলেন, কওমি শিক্ষার্থীরা একটা বদ্ধ পরিবেশে বাস করে। জগত-জীবন থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখার একটা প্রয়াস সেখানে কাজ করে। তাদের নিঃশর্ত আনুগত্য ও সংস্কার রক্ষার তালিমই বেশি দেয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, এ ধারার অধিকাংশ শিক্ষার্থী আবাসিক ব্যবস্থার মধ্যে লেখাপড়া করে। তাই তাদের পক্ষে স্কুল-কলেজের মতো স্বাধীনভাবে মাঠে নামার সুযোগ নেই। মাদরাসা কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিলেই কেবল তারা বাইরে সক্রিয় হতে পারে।
বৈশ্বিক জাগরণের যে ছোঁয়া কওমি তরুণদের গায়ে লাগতে শুরু করেছে তা কওমি তরুণদের কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে? তারুণ্যের বিকাশ ও সঠিক নেতৃত্ব কি গড়ে উঠছে সেখানে?
খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও প্রবীণ আলেম মাওলানা আহমদ আলী কাসেমি মনে করেন, কওমি তরুণরা একবিংশ শতাব্দীর নেতৃত্ব দেয়ার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না। কারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তারা নেতৃত্ব বা আত্মবিকাশের উপযোগী পরিবেশ পাচ্ছে না।
দ্বিতীয়ত বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের সঠিক ধারণা দেয়া হচ্ছে না। তারা সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি ও অর্থনীতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখে না। ফলে বৃত্তের বাইরে এলেই বিপাকে পড়ছে বা বিব্রত হচ্ছে। পরিণত শিক্ষা ও ধারণা তাদের বিপথেও ঠেলে দিচ্ছে কখনো কখনো।
ঢাকার রাস্তায় শিক্ষার্থীদের দেখানো শৃঙ্খলা কি বাস্তবে সম্ভব?
জহির উদ্দিন বাবর ও মাওলানা আহমদ আলী কাসেমি উভয়ই মনে করেন, কওমি শিক্ষা সিলেবাসের পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন। তারুণ্যের বিকাশ ও আগামীর নেতৃত্ব তৈরির জন্য তাতে অন্তর্ভূক্ত করা প্রয়োজন আধুনিক অর্থনীতি, সমাজ ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো।
মাওলানা আহমদ আলী ব্যাখ্যা করেছিলেন, এসব আধুনিক বিষয়ের অনুপস্থিতি তারুণ্যের উত্থানকে কিভাবে বাধাগ্রস্থ করছে। তার ভাষায়, প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাবে তরুণ আলেমরা যেমন পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছে না, অন্যদিকে তারা মানুষকে বোঝাতে পারছে না বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইসলামকে কিভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
ফলে মানুষ মনে করছে বর্তমান সময়ে ইসলাম তার আবেদন হারিয়ে ফেলেছে। অথচ ইসলাম সর্বযুগের জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান।
ইসলামি রাজনীতিবিদ মুফতি ফয়জুল্লাহ অবশ্য মনে করেন, কওমি শিক্ষাধারার বর্তমান সিলেবাস তারুণ্যের বিকাশ ও নতুন নেতৃত্ব তৈরিতে সক্ষম। আধুনিক জীবনব্যবস্থার মৌলিক উপাদানগুলো এ শিক্ষা সিলেবাসের মধ্যে রয়েছে। প্রয়োজন শুধু গভীর অধ্যায়ন ও পাঠপদ্ধতির পরিবর্তন।
তিনি বলেন, আমি স্বীকার করি না আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু নেই। বরং আমি বলবো আমাদের সিলেবাসে সবকিছুই আছে। হয়তো বিস্তারিত নেই। নীতিমালা আকারে আছে।
তিনি বলেন, কোনো শাস্ত্রের মূলনীতি জানা থাকলে পরবর্তীতে তা অর্জন করা কঠিন কিছু না। এরপরও যদি অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজ বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ আলেম তৈরি করতে হয় তবে তার জন্য উচ্চতর গবেষণা কোর্স বা তাখাসসুস কোর্স খোলা যেতে পারে। মূল পাঠ্যক্রমে হাত দিলে তা হিতে বিপরীতও হতে পারে। মনে রাখতে হবে আমাদের লক্ষ্য যোগ্য আলেম তৈরি করা।
মাওলানা আহমদ আলী ও মুফতি ফয়জুল্লাহ উভয়ের বক্তব্য উপস্থান করেছিলাম জামিয়া সাঈদিয়া কারিমিয়া-এর অধ্যক্ষ ও সাবেক ছাত্র নেতা মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদের কাছে। তিনি মাওলানা আহমদ আলীকে সমর্থন করে বলেন, তারুণ্য ও নেতৃত্বের যে বিকাশের কথা আপনি বলছেন তা সবার জন্যই প্রয়োজন। আর সার্বজনীন শিক্ষা ব্যতীত তা সম্ভব নয়।
তাখাসসুস হতে পারে তবে আমাদের প্রতিটি শিশু যেনো আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে; বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ গ্রহণের উপযুক্ত হয় তার জন্য পাঠ্যপুস্তকেই এসব বিষয়ের অন্তর্ভূক্তি প্রয়োজন।
তিনি তার ছাত্র জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, আমি ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন স্তরে দায়িত্ব পালনের সময় উপলব্ধি করেছি কওমি তরুণরা সততা, ত্যাগ, নিবেদন ও নিষ্ঠার ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকলেও বর্তমান সময়, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্তার বাস্তবতা উপলব্ধি করতে তাদের সময় লেগে যায়। যা তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে বাধাগ্রস্থ করে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রতিটি শিশু কোনো না কোনো সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে। দেখা যায়, একটি গ্রাম থেকে একটি শিশু মাদরাসায় পড়তে আসে। তাই বলা যায়, সে তার সমাজের প্রতিনিধি। আমরা যদি তার ভেতর নেতৃত্বের গুণাবলী তৈরি করে দিতে না পারি, তাকে আধুনিক জীবনব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা দিতে না পারি তবে সে নিজ সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দেবে কিভাবে। আলেম নবীর উত্তরসূরী, সমাজের নেতা।
মাওলানা ফজলে বারী মাসউদের কথার সঙ্গে আরেকটি বিষয় যোগ করেন জহির উদ্দিন বাবর। তার কথা দিয়েই লেখাটি শেষ করবো।
তিনি বলেন, তারুণ্যের জাগরণ ও নেতৃত্বের বিকাশ সবকিছু আশাব্যঞ্জক। তবে হতাশাও এখানে কম নয়। কওমি তারুণ্যে জাগরণের পুরোটাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। তাদের মধ্যে জীবনগঠন ও গঠনমূলক কাজের উদ্যোগ খুব কমই দেখা যায়।
যদি বিষয়টি এভাবে চলতে থাকে তবে তাদের প্রতি জাতির সব আশা নিরাশায় পরিণত হবে।
ব্যবসার হিসাব এখন খুব সহজে, ক্লিক বিসফটি
-আরআর