বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪ ।। ১৯ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫


সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন যেসব আলেম

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

রোকন রাইয়ান
আওয়ার ইসলাম

বাংলাদেশের সড়ক মৃত্যুর ফাঁদ বনে আছে সেই আদিকাল থেকেই। কিন্তু এটি ঠেকাতে কখনো কঠোর হতে দেখা যায়নি প্রশাসনকে। সড়কের অর্ধেকজুড়েই অদক্ষ চালক ও ফিটনেসহীন গাড়ি। আইন থাকলেও সে আইন প্রয়োগ না করে অসৎ ট্রাফিকদের অর্থ উপর্জনের বিষয় করা হয়েছে একে। ফলে দিনের পর দিন এ মৃত্যুর হার বেড়েই চলছে।

সড়কে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দেশ হারিয়েছে বহু গুণী মানুষকে। অনেক আলেম, ওয়ায়েজ, শিল্পী ও স্কলারকে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছে এ সড়কে। কিন্তু প্রশাসন কিছুতেই সরব হয়নি।

গত ২৯ জুলাই রাজধানীর কুর্মিটোলায় ২ শিক্ষার্থী বাসের চাপায় নিহত হলে আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠে নগরী। পর্যায়ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। এ আন্দোলন টিনেজ শিক্ষার্থীরা পরিচালনা করছেন। যে কারণে সড়কে দুর্ঘটনার ইস্যু নতুন করে সবার মধ্যে আলোচনায় এসেছে।

সড়কে ইতোপূর্বে অনেক আলেম নিহত হয়েছেন। দুর্ঘটনায় পড়ে হারিয়েছেন মূল্যবান জীবন। আর দেশ হারিয়েছে সমাজ সংশোধনকারী মানুষকে। আবার অনেককে গুরুতর আহত হয়েছে জীবনের দীর্ঘ সময় কাটাতে হয়েছে হাসপাতালের বেডে। আসুন জেনে নেই যেসব আলেম নিহত হয়েছেন সড়ক দুর্ঘটনায়।

মাওলানা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী

একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানা থেকে যুদ্ধে অংশ নেয়া আলেমে দীনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে একটি বেপরোয়া ট্রাক। ওয়াজ মাহফিল করার সুবাদে জীবনের দীর্ঘ সময় কেটেছে গাড়িতে।

তেমনি একদিন মাহফিল থেকে ফেরার পথে মারাত্মক আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন তিনি।

২০০৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে মৌলভীবাজারে অনুষ্ঠিত এক তাফসীরুল কুরআন মাহফিলে বয়ান শেষে ঢাকা ফেরার পথে নরসিংদীর কাছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হন মাওলানা আড়াইহাজারী।

প্রথমে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগে ভর্তি করা হয়। পরে ঢাকার ইবনে সিনা হাসপাতালে বড় ধরনের অপারেশন হয়। পরবর্তীতে সি.আর.পি, সিটি হাসপাতাল, সমরিতা হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসধীন ছিলেন।

দীর্ঘ তিন মাস দশদিন চিকিৎসাধীন থেকে ২০০৯ সালের ৩ এপ্রিল বিকাল ৫টায় ঢাকার শমরিতা হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

মাওলানা ইসহাক ফরিদী

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের মধ্যে রয়েছেন খ্যাতিমান আলেমে দীন মাওলানা ইসহাক ফরিদী। তিনি ছিলেন ঢাকার চৌধুরীপাড়ার শেখ জনুরুদ্দীন রহ. দারুল কুরআন শামসুল উলূম মাদরাসার প্রিন্সিপাল।

একজন খ্যাতিমান লেখকও ছিলেন মাওলানা ইসহাক ফরিদী। লিখেছেন গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে ৩২ টি বই।

আলোচিত বইগুলোর মধ্যে রয়েছে, বাতিল যুগে যুগে, নবী প্রেমের অমর কাহিনী, উজ্জ্বল একটি নক্ষত্র, সুদ একটি অর্থনৈতিক অভিশাপ, জীবন গঠনে কুরআনের অবদান, ইসমতে আম্বিয়া (উর্দূ), সিনেমার কুফল,  খিলাফত ও ইসলামের রাজনৈতিক দর্শন, কওমী মাদরাসা কি ও কেন, ইসলামী রাষ্ট্র ও রাজনীতি, ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং ব্যবস্থা ইত্যাদি।

মাওলানা ইসহাক ফরীদি রহ. ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। তার হাত ধরে তৈরি হয়েছে-ইলমে নবুওয়তের উত্তরাধীকারী-আলেমদের এক বিশাল কাফেলা। বহুরৈখিক প্রতিভাবান এ আলেম ২০০৫ সালের ৫ জুন চট্রগ্রামে নিজ শায়েখ হজরত নানুপুরী রহ-এর সঙ্গে সাক্ষাতে যাওয়ার পথে মর্মান্তি এক সড়ক দূর্ঘটনায় ইন্তেকাল করেন।

ড. মাওলানা খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর

বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, টেলিভিশন আলোচক ও কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরও সড়ক দুর্ঘটনায় ইন্তেকাল করেন।

মাগুরায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি এবং তার গাড়ির চালক নিহত হন।

দেশ-বিদেশে পরিচিতি ও বহু গ্রন্থের প্রণেতা ড. আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর ছিলেন একজন আলোকিত মানুষ। যিনি আলোকিত করেছেন হাজারও মানুষকে।

ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর সৌদি আরবের রিয়াদ ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা করে সেখানেই শিক্ষকতা শুরু করেন। পরে তিনি কুষ্টিয়া ইসলামী ইউনিভার্সিটিতে যোগদান করেন।

২০১৬ সালের ১১ মে সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে মাগুরার বাস টার্মিনাল এলাকায় তার প্রাইভেটকারকে একটি কাভার্ডভ্যান সামনে থেকে এসে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই ইন্তেকাল করেন তিনি।

তবে ড. আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীরের মৃত্যু নিয়ে রহস্য রয়েছে। সেটি রোড একসিডেন্টে ছিল নাকি পরিকল্পিত হত্যা তা নিয়ে এখনো সন্দেহ রয়েছে জনমনে।

মাওলানা আইনুদ্দীন আল আজাদ

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের তালিকায় রয়েছেন আরেকজন খ্যতিমান সঙ্গীত শিল্পী মাওলানা আইনুদ্দীন আল আজাদ। তিনিও একটি প্রোগ্রাম থেকে ফেরার পথে গাড়ি চাপায় ইন্তেকাল করেন।

আইনুদ্দীন আল আজাদ জাতীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন কলরবের প্রতিষ্ঠাতা। মূলত ইসলামি সঙ্গীতকে এদেশে জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে তার অবদান অন্যতম। তার দেখানো পথ অনুসরণ করে কলরব আজ এগিয়ে গেছে অনেক পথ।

২০১০ সালের ১৮ জুন সকালে নাটোরের লালপুরে তার প্রাইভেটকারকে চাপা দেয় একটি বাস। কার চালকসহ সেখানেই নিহত হন তিনি।

মাওলানা মুফতী নোমান কাসেমী

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের তালিকায় আরেকজন প্রসিদ্ধ আলেম মাওলানা মুফতী নোমান কাসেমী। এই প্রতিভাবান আলেম গত ২০১৩ সালের ১৫ আগস্ট বৃহস্পতিবার সকাল ৬:৩০ মিনিটে ভূঁইগড় থেকে সাইনবোর্ড যাওয়ার পথে জামেয়া আশরাফিয়ার নিকটস্থ রাস্তার পাশে বেপরোয়া ট্রাকের তীব্র আঘাতে ঘটনাস্থলেই ইন্তেকাল করেন।

১৯৭৩ সালের ১ আগস্ট নোয়াখালী জেলার চাটখিল থানাধীন প্রসিদ্ধ গ্রাম দৌলতপুরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মেছিলেন তিনি। শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা জামিয়া রাহমানিয়ায় ১৯৯৫ সালে দাওরায়ে হাদীস পাস করেন। এরপর ভারতের গাঙ্গুহ ও দারুল উলুম দেওবন্দে ইফতা পড়েন।

২০০৫ সালে তিনি জামেয়া আশরাফিয়া সাইনবোর্ডে দাওরায়ে হাদীসের উস্তাদ হিসেবে যোগদান করেন এবং পরবর্তীতে উক্ত জামেয়ায় ফতোয়া বিভাগে দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশ কওমী শিক্ষাবোর্ড বেফাকের নিরীক্ষক পদে নিযুক্ত ছিলেন।

মুফতি নোমান কাসেমী লেখক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। বেফাকের মেশকাত জামাতের সিলেবাসভুক্ত ‘ফেরাকে বাতেলা’ তার লেখা অন্যতম বই। এছাড়া মাকামাতে হারিরির বাংলা অনুবাদ করেছেন তিনি।

কারী মাওলানা জামিল হোসাইন

গতবছর ইন্তেকাল করেন ছাত্রনেতা মাওলানা জামিল হোসাইন। বিয়ের দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ায় ঘটনা নিয়ে বেশ তোলপাড় হয়। তার মৃত্যুতে বহু মানুষ সড়কে নেমে আসে চালকদের দৌরাত্ব কমাতে।

ক্বারী মাওলানা জামিল হুসাইন ছিলেন কানাইঘাট ছাত্র জমিয়ত চতুল ইউনিয়ন শাখার সভাপতি। তরুণ এ আলেমের মৃত্যুর শোক ছাপিয়ে গেছে বহু মানুষকে।

২০১৭ সালের ৭ ডিসেম্বর সিলেট-তামাবিল মহাসড়কের বাঘের সড়ক এলাকায় মোটরসাইকেল-লেগুনা মুখোমুখি সংঘর্ষে গুরুতর আহত হন মাওলানা জামিল হুসাইন।

১১ ডিসেম্বর মাওলানা জামিলের বিয়ের তারিখ ঠিক ছিল। বিয়ের আমন্ত্রণ জানিয়ে মোটরসাইকেলযোগে বাড়ি ফেরার পথে দুর্ঘটনার শিকার হন তিনি।

চিকিৎসার জন্য সিলেটের বেসরকারি হাসপাতাল ওয়েসিস-এ ভর্তি থাকা অবস্থায় ১১ ডিসেম্বর রাতে মারা যান তিনি। মাওলানা জামিল হোসেনের বাড়ি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার বড় চতুল ইউনিয়নের হারাতৈল বড়াই গ্রামে।

হ্যাঁ, এবার তোরা ব্যারাকে ফিরে যা...

-আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ