খতিব তাজুল ইসলাম
লেখক ও গবেষক
পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম শিশু কিশোররা যে বয়সে ফুটবল নিয়ে মাঠে দৌড়ানোর কথা সেই বয়সে দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে তাদের মাঠে নামতে হয়েছে। মাঠে নেমে যে যৌক্তিক ভাবে দাবি পেশের সাথে সাথে পুলিশের কাছে লাইসেন্স খুঁজছে সত্যিই বিস্ময়কর।
আমার মনে হয় ওরা দেখতে পেয়েছে যে সকল রাজনৈতিক দলগুলো মরে পঁচে একেবারে বিনাশের শেষ প্রান্তে। ক্ষমতাসীনরা ফেরাউনি দম্ভ নিয়ে অরাজকতা চালিয়ে যাচ্ছে। একের পর এক খুন গুম হচ্ছে মানুষ মরছে কারো কিছু যায় আসে না।
পুলিশ মানুষ মারছে, যানবাহন গাড়ি চাপা দিয়ে মানুষ মারছে, হাসপাতালে ডাক্তার মানুষকে মারছে, আদালত নির্দোষ মানুষকে ফাসি দিচ্ছে খুনীকে দিচ্ছে মুক্তি! এমনি পরিস্থিতিতে এই কিশোরদের প্রতিবাদী কণ্ঠ আমাকে সাহস যোগায়।
হে জাতি আমরা লজ্জিত। হে পুরুষগণ আমাদের উচিত কঁচু গাছে ফাঁস দিয়ে মরা।
কোথায় আছে আইনের শাসন? টপ টু বটম কোনো জাগায় ইনসাফ নেই। মন্ত্রী এমপিরা ভিলেনের মত কথা বলে। প্রধানমন্ত্রী খোদ সংসদে ওয়াদা করে জাতিকে আশ্বাস দিয়ে আবার কথা ফিরিয়ে নেয়। এই পরিস্থিতিতে এই কিশোরদের (রাশিদ জামিলের ভাষায়) খোদ আল্লাহ তায়ালা তার কুদরতি কেরেশমায় আবাবিল পাখি হিসাবে তাদের প্রেরণ করেছেন বলে মনে হয়।
যাক ডিউটি শেষে এখন ঘুমাতে যাবো বলে মনস্থ করেছিলাম কিন্তু এই কিশোরের দল আর ঘুমাতে দিলো না। তাদের আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণার সাথে সাথে কিছু দিক নির্দেশনা মূলক বক্তব্য পেশ করা জরুরি ভাবছি।
নিরাপদ সড়ক কিভাবে সম্ভব? কিছু ড্রাইভার হেলপার আর শ্রমিকদের জেল জুলুম দিলেই কি তামাম? না কখনো না। কয়েকটা বাস কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল করেও তা সম্ভবপর হবে না।
দেখেন খোদ পুলিশরা গাড়ি চালায় বিনা লাইসেন্সে। যা এই কিশোরদের মাধ্যমে জাতি জানতে পারলো। তাহলে আগে সৎ যোগ্য মেধাবী ট্রান্সপোর্ট পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী থাকতে হবে।
সরকার পুলিশকে যেভাবে খুনের লাইসেন্স দিয়ে রেখেছে সেভাবে কি তা গড়ে তুলা সম্ভব?
অতএব কথার শুরুতেই বলতে চাই যে সরকারকে সিটি পুলিশের সাথে ট্রান্সপোর্ট পুলিশের ব্যাপারে শক্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে আগে। বাংলাদেশে যাকে আমরা ট্রাফিক পুলিশ বলি তাদের যানবাহন বেতন ভাতা জীবন মান উন্নত করে কাজের ট্রেনিংগের সাথে আদর্শিক প্রশিক্ষণ দিয়ে মাঠে নামাতে হবে।
এটা হলো প্রথম কাজ। কারণ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসাবে আগে এই বিভাগের মাঝে গ্রহন যোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। তারপর দ্বীতিয় পর্যায়ে যে কাজ হবে তাহলো মজবুত পরিবহন আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
ইন্সুরেন্স বা বিমা পলিসি, ক্ষতিপূরণ প্রদান, রাস্তায় গাড়ি চলা চলের নীতিমালা চূড়ান্ত করে প্রতিটি ড্রাইভারকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জানিয়ে দিতে হবে। দেখা যায় ইউরোপে মাদক সেবন করে গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ আর বাংলাদেশে মাদক সেবন করার পরই গাড়ি চালায়। তাহলে সে এক্সিডেন্ট করবে না তো কি করবে?
তাই মাদক সেবন করে যারা ড্রাইভ করবে তাদের বিরুদ্ধে শুধু লাইসেন্স বাতিল নয় কঠোর শাস্তি মূলক আইন রাখতে হবে।
তৃতীয়ত রাস্তায় মার্কিং করে বিভিন্ন জাগায় মোড়ে মোড়ে সাইন বোর্ড লিখে নিয়ম কানুন জানিয়ে দিতে হবে। যত্রতত্র গাড়ি পার্ক করলে জরিমানা চার্য করা হবে। সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে মনিটরিং হবে। ফুটপাতকে সম্পূর্ণ আলাদা করে ডিভাইডার দিয়ে রাখতে হবে।
পাতাল পারাপার উড়াল ব্রিজ খুব বেশি করে বাস্তবায়ন করে রাস্তা থেকে মানুষের চাপ কমাতে হবে। স্কুল ও গুরুত্বপুর্ণ জাগায় স্পিডব্রেকার দিতে হবে। পথচারী পারাপার বা জেব্রা ক্রসিং এর নিয়ম কঠোরভাবে মানার আইন প্রয়োগ করতে হবে।
টাউন বাস লোকাল বাস কোথায় থামবে তার জন্য রাস্তায় মার্ক করা থাকবে। যাকে আমরা বাস স্টপ বলি সেখানে ছাউনিসহ বাসস্টপে সবাই অপেক্ষা করবে। বাসস্টপে অন্য কেউ দাঁড়াতে পারবে না। বা ব্লকও করতে পারবে না।
প্রতিটি জাগায় নিয়ম কানুন লিখে সাইন বোর্ড থাকবে। ট্রাফিক সিগনাল হবে ফরজের মতো নিয়ম। যে মানবে না তার লাইসেন্স বাতিল সহ শাস্তি মুলক আইন থাকতে হবে। যারা রাস্তায় গাড়ি চালাবে তাদের লাইসেন্স প্রাপ্তির আগে থিওরি টেস্ট চালু করতে হবে। তারপর প্রাক্টিক্যাল টেস্ট।
আর যারা ইতিমধ্যে লাইসেন্স পেয়ে গেছে তাদেরও ডেকে এসে নিয়ম কানুনের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। প্রতিটি শহরে গাড়ি চালনা ও থিওরি ও প্রাক্টিক্যাল টেস্টের জন্য সেন্টার থাকবে। হাজার হাজার লোকের যেমন কর্মসংস্থান হবে তেমনি হবে বিরাট আয়।
চতুর্থত গাড়ির ফিটনেস। খুবই গুরুত্বপুর্ণ। গাড়ি এক্সিডেন্টের বড় কারণের একটি কারণ হলো ফিটনেসবিহীন গাড়ির চলাচল। গাড়ির কালো ধোয়া ক্যান্সার ছাড়ায়। সকল অসুখের মূল হলো এই কালো ধোয়া। তাই এসব বন্ধ করতে হলে ফিটনেস সার্টিফিকেট চালু ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
শহরের জাগায় জাগায় ফিটনেস টেস্ট সেন্টার থাকবে। সাধারণত একটি গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট একবছরের জন্য থাকে। তারপর মেয়াদ শেষ হলে আবার নবায়ন করতে হবে।
এখানেও হাজার হাজার যুবকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। রোডটেক্স তো আছেই। তা পরিশোধ হচ্ছে কিনা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রশ্ন হলো পুরানা বিশবছর পঁচিশ বছরের গাড়িগুলোর ফিটনেস হবে কিভাবে? লক্কড় ঝক্কড় গাড়িগুলো যখন রাস্তা থেকে তুলে নেয়া হবে তখন যানবাহন সংকট মোকাবেলা করা হবে কিভাবে?
যতটুকু জানি বাংলাদেশে গুটি কতেক কোম্পানিকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে গাড়ি আমদানির জন্য। আর তারা ছাড়া যেমন আর কেউ গাড়ি আনতে পারে না তেমনি আছে চড়া মূল্যের টেক্স। ডবল ত্রিপল টেক্সের কারণে গাড়ি আমদানি কারকরা নতুন গাড়ি নামাতে ভয় পায়। কেন?
টেক্স নাকি এজন্য বেশি দেয়া হয়েছে যাতে গাড়ি দেশে কম আসে। দেশের রাস্তাঘাট অনুপাতে গাড়ি আমদানির ছাড় হয়। ভাল কথা। আমার প্রশ্ন হলো, নতুন গাড়ি আনতে দাম টেক্স বেশি হওয়ার কুফল কি হচ্ছে দেখছেন?
দেশে লাখ লাখ পুরাতন লক্কড় ঝক্কড় মার্কা গাড়ি এখন রাস্তা দখল করে বসে আছে। লাভ হলো কি? এসব নিয়ে কারো ভাবার সময় নেই। দেশ ও জনগণ দরদি যদি কেউ হতো তাহলে ভাবতো যে পুরাতন সকল গাড়ি রাস্তা থেকে নামিয়ে ফেলা হবে।
নিত্য নতুন গাড়ি এনে সেই খালি জায়গা পুর্ণ করে দেয়া হবে। এতে যেমন অর্থনীতির চাকা ঘুরতো তেমনি যুবকদের আরো বাড়তি কর্মসংস্থান তৈরি হতো। পুরাতন গাড়িগুলো নামিয়ে ভেংগে রিসাইকেলিং করে অন্য কাজে ব্যবহার করার নজির পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আছে।
সস্তা ও সহজভাবে যদি নতুন গাড়ি আনার পথ খোলা না হয় তাহলে পুরাতন কেন্সার আক্রান্ত গাড়ি থেকে জাতি কখনো মুক্তি পাবেনা। আজ যে কিশোররা আন্দোলন করছে তাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে সড়ক ও জনপথের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করে প্রধানমন্ত্রী তড়িৎ ব্যবস্থা নিবেন এটাই আমরা আশা করছি এখন।
সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামবে কীভাবে?
-আরআর