রিদওয়ান হাসান
মাদরাসা শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
কুরবানির ঈদ এলেই কয়েক দিন আগে থেকে সারাদেশে একধরনের পোস্টার লিফলেট চোখে পড়ে। তাতে লেখা থাকে, ‘আপনার কুরবানির চামড়া অথবা উহার মূল্য মাদরাসায় দান করুন’।
বিভিন্ন মাদরাসা, এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের পক্ষ থেকে এসব বিলি করা হয়। পোস্টার লাগানো, লিফলেট বিলি থেকে শুরু করে চামড়া সংগ্রহ পর্যন্ত সব কাজই করতে হয় মূলত কওমি মাদরাসা শিক্ষার্থীদের।
আমাদের দেশের প্রায় সিংহভাগ কওমি মাদরাসায় কুরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের একটি রীতি প্রচলিত আছে। এ রীতির ঠিক কোত্থেকে প্রচলন ঘটেছে, তা আমি জানি না। তবে আকাবির থেকে যে এই প্রচলন আসেনি, তা শতভাগ নিশ্চিত।
বাংলাদেশের ঢাকা শহর কওমির প্রাণকেন্দ্র। শুধু ঢাকাতেই যে পরিমাণ মাদরাসা রয়েছে, গোটা বাংলাদেশের মাদরাসাসংখ্যাও এরচে খুব বেশি নয়। তাই ঢাকার মাদরাসাগুলোতে কুরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ নিয়ে চলে একপ্রকার প্রতিযোগিতা। আর চামড়া কালেকশন থেকে মাদরাসার যে আয় হয়, তাতে মাদরাসার ওই বছরের ব্যায়খাত কিছুটা নির্ভার থাকে।
ঢাকাতে আয়তনের বড় মাদরাসাগুলোর মধ্যে পর্যায়ক্রমে যাত্রাবাড়ি, ফরিদাবাদ, মাদানিনগর, রহমানিয়া, আরজাবাদ, জামেউল উলূমসহ বেশ কয়েকটি পিঠাপিঠি মাদরাসা আছে। এসব মাদরাসার নিজস্ব ছাত্রসংখ্যা গড়ে তিনহাজারের উপরে। এই সংখ্যাবহুল ছাত্র দিয়ে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ চামড়া সংগ্রহের কাজ করে থাকে।
জিলকদের ২৫ তারিখ (কুরবানির ১৫ দিন আগ) থেকে চামড়া সংগ্রহের জন্য একেক মাদরাসার একেক বিধিনিয়ম থাকে, সব ধরনের প্রস্তুতির জন্য নূন্যতম ১৫ দিন মাদরাসাগুলোতে ক্লাশ বন্ধ করা হয়। এই সময়ের মধ্যে তারা প্রথমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিঠি বিলানো, তারপর মাঝখানে আবার গিয়ে এলাকা পর্যবেক্ষণ, শেষে ঈদের দিন থেকে শুরু হয় ছাত্রদের মূল কার্যক্রম।
ঢাকায় মাদরাসাসংখ্যা বেশি হওয়াতে ছাত্রদের চামড়া সংগ্রহ করা নিয়ে নানারকম অভিজ্ঞতা আমি নিজ চোখে দেখেছি। তার উপর এলাকা নেতাখেতারাও ইদানিং চামড়া ব্যবসায় লাভজনক ফল পাচ্ছে, তাই ছাত্রদের সাথে তাদের বৈরিতাও চোখে ধরেছে একাধিকবার।
উপরে যেসব মাদরাসার নাম নিয়েছি, আমি সেসবের একটি মাদরাসার শিক্ষক। তাই প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমি আমাদের মাদরাসার বিগত বছরের একটি আয়-ব্যয়ের ফিরিস্তি তুলে ধরবো।
গতবছর আমাদের ভর্তি ক্রমিকানুসারে ছাত্রসংখ্যার কোটা দাঁড়িয়েছিল পাঁচহাজারে।অপ্রাপ্তবয়স্কের কোটায় বাদ পড়েছে আনুমানিক একহাজার। আর গড়ে ৫০০ টাকা করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাড়িতে যাওয়ার ছাড় পেয়েছে আরও একহাজার। বাকি রইল তিনহাজার ছাত্র।
এই তিনহাজার ম্যানপাওয়ার খাটিয়ে গতবছর আমাদের মাদরাসার আয় ছিল প্রায় ৪৬,০০০০০ (ছেচল্লিশ লাখ) টাকা। তন্মধ্যে কুরবানির পশু ক্রয় আর ছাত্রদের খাবার দাবারসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩২,০০০০০ (বত্রিশ লাখ) টাকা।
তাহলে যোগ বিয়োগ করে মাদরাসার আয় যা দাঁড়ালো, তা রাউন্ড ফিগারে ১৪,০০০০০ (চৌদ্দ লাখ) টাকা।
মাদরাসার অডিট দফতরের পরিসংখ্যানমতে তিনহাজার ম্যানপাওয়ার খাটিয়ে আমরা পেলাম চৌদ্দ লাখ টাকা। এটি মাদরাসার আয়ের একটি ইতিবাচক দিক। এতে যেমন ছাত্রদের মাঝে সেবামূলক কাজ করার প্রেরণা তৈরি হয়, তেমনি এর সাথে সংশ্লিষ্ট নানারকম অভিজ্ঞতা ও কৌশল আগামীতে সেবার দরজাকে আরও প্রশ্বস্তই করবে।
কিন্তু আমরা যদি এই তিন হাজার ছাত্রের প্রত্যেকের নিজ বাড়ির চামড়ার টাকা গড়ে ৫০০ টাকা করে নিয়ে বাড়িতে আনন্দে ঈদ উদযাপনের সুযোগ দেই, তাহলে আমাদের আয় হয় ১৫,০০০০০ (পনের লাখ) টাকা, যা পরিশ্রমের আয়ের চাইতেও এক লাখ টাকা বেশি।
এখানে নিজের এলাকায় ছাত্ররা পশুর চামড়ার টাকা সংগ্রহ করে মাদরাসায় দিবে, তাতে সেবামূলক কাজের ধারাও অব্যাহত থাকবে আর এতে যে আরো নানাবিধ সুবিধা পাওয়া যাবে, তার একটি ফিরিস্তি আকার দেয়া যেতে পারে:
১. পনের দিন আগ থেকে ক্লাশ বন্ধ থাকবে না। এতে পড়ালেখা সামান্য হলেও বেশি হবে।
২. ক্লাশ চলতে থাকবে জিলকদের শেষ পর্যন্ত। প্রয়োজনে একটি মেধাযাচাই পরীক্ষারও আয়োজন থাকতে পারে। পরে ঈদের দশ দিন আগে তারা বাড়িতে গিয়ে সুন্দরভাবে ঈদপালন করে মাদরাসা ফেরত আসত। এতে মাদরাসার বোর্ডিং খরচটাও বেঁচে যেত।
৩. এ সুবিধা শুধু বড় বড় মাদরাসাগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। প্রয়োজনে মাদরাসাগুলোর নিজ এলাকায় চামড়া সংগ্রহের একটি ঘরোয়া ক্যাম্প বসাতে পারে। যার ইচ্ছা চামড়া দিয়ে যাবে অথবা ৫০জন ছাত্র দ্বারা এই গ্রুপটি পরিচালনা করা যেতে পারে। এতেও লাখ খানেকের মতো টাকা আয় হত।
৪. ছোট ছোট মাদরাসাঅলারাও তাদের অল্পসংখ্যক ম্যানপাওয়ার দিয়ে বিনাপ্রতিযোগিতায় ভালো আয় করতে পারত। ছাত্র ভার্সেস ছাত্র কোনো সংঘাত অন্তত আমাদের শুনতে হত না।
৫. ছাত্ররা ঈদের বন্ধটাও বিশ দিন পেত। এই বিশ দিনে তারা ব্রেনফ্রেশ করে ঈদের পরে নতুন উদ্যমতায় পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে পারত।
ঢাকার আয়তনে বড় বড় সব মাদরাসার এই আয়মুখি প্রস্তাবনায় সাড়া দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আমি গরিষ্ঠহারে সব মাদরাসা থেকে এই প্রচলন থেকে বেরিয়ে আসতে বলছি না। নিদেনপক্ষে যেসব মাদরাসা কুরবানির পশুর চামড়া কালেকশন না করেও সুচারুরূপে মাদরাসা পরিচালনার ক্ষমতা রাখে, তাদেরকে এর প্রতি উদ্বুদ্ধ করছি।
এতে মাদরাসা ও ইসলাম বিরোধিতার যুগে আমাদের ওপর আরেকটি মিথ্যা কলংক অল্প হলেও ঘুচবে। তাছাড়া, আমাদের ম্যানপাওয়ার দিয়ে এককভাবে টেনারিঅলারা যে হারে ব্যবসা করে, তাতে চির ধরবে সহজেই।
আরও পড়ুন: মাদরাসার তালাবা ও কুরবানির চামড়া
বাংলাদেশে সিরাতচর্চায় এতো ঘাটতি কেন?
-আরআর