শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


সিটি নির্বাচনে ঘরের মাঠে কেমন করবে ইসলামী আন্দোলন?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আতাউর রহমান খসরু
চিফ রিপোর্টার

ঢাকা, খুলনা, রংপুর ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ভোটের পরিমাণ বাড়িয়ে আলোচনায় এসেছিলো ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ৫ সিটি নির্বাচনে ভোটের দিক থেকে ৩য় স্থান অর্জন করে দলের মনোনীত প্রার্থীরা।

নির্বাচনের এমন ফলাফল অনুপ্রাণিত করেছে দলের নেতা-কর্মীদের। তাই আরও বেশি চমক দেখাতে আসন্ন ৩ সিটি নির্বাচনে আরও বেশি শক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে তারা।

বিশেষত ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ঘরের মাঠ বরিশাল সিটি নির্বাচনে বিজয়ের স্বপ্ন দেখছে দলটি। এখানে সর্বোচ্চ সাংগঠনিক শক্তিও নিয়োগ করতে দেখা যাচ্ছে তাদের।

আগামী ৩০ জুলাই বরিশাল সিটির এ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। এতে ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ৩০টি ওয়ার্ডের ১২৩টি ভোটকেন্দ্রে ২ লাখ ৪২ হাজার ১৬৬ জন ভোটার।

সাংগঠনিক শক্তি, রিজার্ভ ভোট, প্রার্থী ইমেজ ও চতুর্মুখী প্রচারণাই বিজয়ের পক্ষে তাদের প্রধান যুক্তি। দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনেও যুক্তিগুলো গুরুত্ব পাচ্ছে।

এছাড়াও বিএনপির অন্তর্দ্বন্দ্ব; জাময়াতে ইসলামীর সঙ্গে তাদের দূরত্ব ইত্যাদি বরিশাল সিটি নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের জন্য আশির্বাদ হতে পারে ধারণা করছে অনেকে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের বরিশাল সিটি নির্বাচন পরিচালনা কমিটির মিডিয়া সমন্বয়কারী মুহাম্মদ শরীয়াতুল্লাহও আওয়ার ইসলামের সামনে এ কারণগুলোই তুলে ধরেন।

ইসলামী আন্দোলন বারবার বলছে বরিশাল সিটির হিসেব অন্য সিটি থেকে ভিন্ন। কিন্তু কেনো? উত্তরে তিনি বলেন, বরিশাল থেকে আমাদের সংগঠন শুরু। এখানে সংগঠনের ভীত অনেক মজবুত। আমাদের রিজার্ভ ভোট আছে ৪০ হাজারের মতো। কাস্টিং ভোট আছে প্রায় সমপরিমাণ।

তাছাড়া আমাদের প্রার্থী মাওলানা ওবায়দুর রহমান মাহবুব বরিশালে তুমুল জনপ্রিয় একজন ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতা। সুতরাং অতীতের হিসেবে অনুযায়ী আমরা বিজয় আশা করতেই পারি।

এটা সত্য বরিশাল সিটি নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিয়েছে প্রার্থী মাওলানা ওবায়দুর রহমান মাহবুবের ব্যক্তি ইমেজ। তিনি বরিশাল শহরের সবচেয়ে বড় কওমি মাদরাসা জামিয়া মাহমুদিয়ার প্রিন্সিপাল এবং হেফাজতে ইসলামের জেলা আমির। উলামায়ে কেরাম ও সাধারণ মানুষের মাঝে তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।

যদিও হেফাজত ইসলাম জানিয়েছে মাওলানা মাহবুবের নির্বাচনের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।

বরিশালের বিশিষ্টজনের ধারণা মাওলানা ওবায়দুর রহমান মাহবুবের ব্যক্তি ইমেজকে কাজে লাগাতে পীর পরিবার থেকে প্রার্থী না দিয়ে তাকে প্রার্থী করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।

বরিশালের একজন সিনিয়র সাংবাদিক ও একটি জাতীয় দৈনিকের ব্যুরো প্রধান নাম না প্রকাশের শর্তে বলেছেন, ‘মাহবুব সাহেব সবচেয়ে ক্লিন ইমেজের প্রার্থী। বরিশালের সাধারণ মানুষ তাকে পছন্দ করে। এমনকি পীর পরিবারের সদস্যদের চেয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার ইমেজ ভালো। আর সেটা কাজে লাগাতেই তাকে প্রার্থী করা হয়েছে। মূলত তার মাধ্যমেই পাশার গুটি উল্টাতে চায় ইসলামী আন্দোলন।’

তবে তা কতোটা সফল হবে তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, ‘বাংলাদেশের সাধারণ ট্রেডিশন অনুযায়ী মানুষ আলেমদের ভক্তি করলেও ভোট দেয় দলীয় প্রার্থীকে।’

সিনিয়র এ সাংবাদিকের কথার সত্য মিললো বরিশালের ইরান লিমিটেড-এর মালিক কাউসার আহমদের সঙ্গে কথা বলে। বরিশালের টাউন হল এলাকায় ব্যবসা করেন তিনি।

তার ভাষায়, মাহবুব হুজুরকে আমরা শ্রদ্ধা করি এবং পছন্দ করি। কিন্তু মেয়র হিসেবে তিনি কতোটা ফিট? ভালো মানুষ হলেও তিনি কতোটা দক্ষতার সঙ্গে নগরভবন পরিচালনা করতে পারবেন তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

ব্যক্তিগত আলাপে তিনি জানান, মাওলানা মাহবুবের কাছে তার নিয়মিত যাতায়াত আছে। বিপদে আপদে তার দোয়া নেন। তবে তিনি যেহেতু দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগ করেন তাই দলীয় প্রার্থীকেই ভোট দেবেন।

অবশ্য তিনি ভোট না দিলেও অনেকেই ওবায়দুর রহমান মাহবুবের জন্য হাতপাখাকে ভোট দিবেন; বিশেষত অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে বিএনপির কিছু ভোট হাতপাখার পক্ষে চলে যেতে পারে বলে তার ধারণা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিনিয়র সেই সাংবাদিক মাওলানা মাহবুবের ব্যক্তি ইমেজের আরেকটি বিষয় যোগ করেন। তাহলো, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব এবং মাওলানা মাহবুবের তাদের প্রতি সু-ধারণা।

সরকার বিরোধী অবস্থানের সূত্রে এ হেফাজত আমিরের প্রতি স্থানীয় জামাআত নেতাদের এক ধরনের মুগ্ধতা রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।

তার মতে, বরিশাল সিটি নির্বাচনের ফলাফল নির্ভর করছে স্থানীয় নেতাদের ব্যক্তিগত লিয়াজোর উপর। যদি বিএনপির বিদ্রোহী অংশ ও জামায়াতের ভোট নিশ্চিত করা যায় তবে ইসলামী আন্দোলনের বিজয়ের সম্ভাবনা ৯০ ভাগ। বিএনপির শিক্ষা দিতে জামায়াত সেটা করতেও পারে।

তবে তার সাথে একমত হতে পারে নি বরিশাল লাইট ফিউচার স্কুলের পরিচালক বেলাল উদ্দীন খান

তিনি মনে করেন, জামায়াতে ইসলামীর ভোটাররা তুলনামূলক সচেতন। তারা হুজুগে ভোট দিবেন না। তাছাড়া ইসলামী আন্দোলন ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে তিক্ততার ইতিহাস খুবই দীর্ঘ। যা ভুলে যাওয়া খুব সহজ হবে না।

জনাব বেলাল ইসলামী আন্দোলনের প্রচার-প্রচারণায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। তার ভাষায় ইসলামি দলগুলো সাধারণত জেতার জন্য নির্বাচন করে না। প্রার্থী দিয়ে ঘরে বসে থাকে। কিন্তু এবার ইসলামী আন্দোলনের প্রচার দেখে মনে হচ্ছে তারা বিজয়ী হতেই মাঠে নেমেছে।

ভোটের মাঠে জোটে বিশ্বাসী নয় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দলের প্রতিষ্ঠাতা আমির সৈয়দ ফজলুল করীম রহ. এর সময় থেকে একলা চলো নীতি অনুসরণ করছে তারা। তাই অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গে মানসিক দূরত্ব রয়েছে ইসলামী আন্দোলনের।

মাওলানা ওবায়দুর রহমান হেফাজতে ইসলামের জেলা আমির হওয়ায় এ দূরত্ব কিছুটা হলেও ম্লান হবে বলেন মনে করেন মাওলানা সাজিদুর রহমান

তিনি বরিশালের শহরের বেলতলা এলাকার আর রহমান মসজিদের ইমাম ও খতিব।

মাওলানা সাজিদ বলেন, কওমি ধারার সব আলেম আল্লামা আহমদ শফীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মাহবুব হুজুরের সঙ্গে আল্লামা আহমদ শফীর বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বরিশাল জেলা হেফাজতের আমির। সে হিসেবে আলেমরা সাধারণভাবে তাকে ভোট দিবে।

Image may contain: 6 people, people smiling, people standing and crowd

প্রতিবেদক মাওলানা সাজিদের কথার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ৫জন আলেমের সঙ্গে কথা বলেন। তারা হলেন, মাওলানা আবদুল আজিজ, মাওলানা কারামত হোসাইন, মাওলানা বাকি বিল্লাহ, মাওলানা নেয়ামতুল্লাহ ও মাওলানা আবদুল আলিম। তারা বরিশালের বিভিন্ন দীনি প্রতিষ্ঠানে সাথে সম্পৃক্ত।

তাদের মধ্যে দুজন অপর একটি ইসলামি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা বলেন, দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা শরিক দলের প্রার্থী মুজিবুর রহমান সরোয়ারকে ভোট দিবেন। আর অন্যরা মাওলানা মাহবুবকে ভোট দেয়ার কথা জানান।

অর্থাৎ দল নিরপেক্ষ আলেমদের হাতপাখায় ভোট দেয়ার সম্ভবনা বাড়ছে বলেই জানাচ্ছে জরিপগুলো।

আর এ সব সম্ভাবনা ফলপ্রসূ হবে যদি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়। দলীয় প্রভাব ও দখলদারিত্ব বন্ধ থাকে।

এ প্রতিবেদন তৈরির জন্য প্রতিবেদক যতোজনের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের প্রায় সবাই নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার ব্যাপারে তীব্র শঙ্কা প্রকাশ করেছে।

তারা মনে করছেন, সম্প্রতি শেষ হওয়া খুলনা ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে নির্বাচনের ব্যাপারে নিঃশঙ্ক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

অন্যদিকে তাদের সবাই প্রত্যাশা করেছেন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে এবং ভোটাররা ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাবে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাও ভোটারদের আশ্বস্ত করতে বলেছেন, আসন্ন ৩সিটি নির্বাচনে আর প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন নয়।

এখন দেখার পালা ভোটারদের শঙ্কা না, প্রত্যাশা কোনটি সত্য হয়।

‘আমার মনের আশা; এমন একটি দেশ জাতিকে উপহার দেবো’

-আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ