শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


প্রিয় তাবলিগি ভাইয়েরা এবার একটু ক্ষান্ত দিন!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

জহির উদ্দিন বাবর
আলেম, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সমস্যার ডালপালা ছড়াচ্ছে অনেক দিন ধরেই। বিভাজন ও বিভক্তির বিষয়টাও এখন ‘ওপেন সিক্রেট’। কোটি হৃদয়ের স্পন্দন প্রিয় তাবলিগ জামাত আর আগের মতো নেই সেটা এখন সবারই জানা। কিন্তু এখানেও খুনোখুনি, ক্ষমতার মহড়া আর মারদাঙ্গা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে সেটা ছিল অকল্পনীয়।

এখানেও প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোর মতো পেশিশক্তির লড়াই দেখতে হবে সেটা ছিল অভাবনীয়। নিজের মত ও খাহেশ পূরণ করতে গিয়ে সন্ত্রাস ও গুণ্ডামির ঘটনা এখানেও ঘটবে সেটা কেউ কোনোদিন চিন্তাও করেনি।

কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, যা ছিল অকল্পনীয়, যা ছিল ভাবনারও অতীত সেটাই এখন ঘটছে প্রিয় তাবলিগের আঙিনায়। ঘটনাগুলো শুধু বিব্রতকরই নয়, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে অনবরত।

গত বিশ্ব ইজতেমার সময় থেকে নিয়ে এমন বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে যা তাবলিগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের জন্য অনেক বড় কষ্টের কারণ। আমরা যারা তাবলিগের সঙ্গে উৎপ্রোতভাবে জড়িত নই কিন্তু দূর থেকে এই কাজকে ভালোবাসি তাদের জন্যও কম কষ্টের নয়।

যে তাবলিগের ইখলাস ও লিল্লাহিয়াত নিয়ে একসময় গর্ব করতাম সেই তাবলিগে আজ চলছে ক্ষমতার মহড়া, লৌকিকতার প্রতিযোগিতা। নিজেদের মনোবাসনা পূর্ণ করার জন্য যা খুশি তাই করছেন এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

যে তাবলিগি ভাইয়েরা একসময় নিজেদেরকে এবং নিজেদের কাজকে আড়াল করার শত চেষ্টা করতেন তারা এখন বাহারি প্রদর্শনের আয়োজন করছেন। শত চেষ্টা করে যে তাবলিগের কোনো তথ্য জানা যেত না সেই তাবলিগে এখন সাংবাদিক ডেকে সমাদর করে পরস্পরের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো হচ্ছে।

যে তাবলিগে প্রচলিত রাজনীতি, রাজনৈতিক পরিভাষা সযতনে পরিহার করা হতো সেই তাবলিগে আজ চলছে রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন ও ফায়দা লুটার চেষ্টা।

তাবলিগে এখন স্পষ্টত দুটি পক্ষ। কার দোষ কতটুকু, কে বেশি দোষী আর কে কম দোষী সেটা বিবেচনা করার সামর্থ্য আমাদের নেই। প্রত্যেকের বক্তব্য শুনলে মনে হবে তারাই সঠিক অবস্থানে। নানা মত-পথের মানুষের সম্মিলিত এই বিশাল কাজে মতপার্থক্য হওয়াটা অসম্ভবও কিছু নয়।

এক পক্ষের সঙ্গে আরেক পক্ষের মত ও পদ্ধতিগত পার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু সেই মতপার্থক্য মারামারি আর খুনোখুনি পর্যায়ে যাবে সেটা ভাবনারও অতীত। কারণ এখানে নেই বৈষয়িক কোনো স্বার্থ। ক্ষমতায় টিকে থাকা কিংবা ক্ষমতায় ফেরার কোনো বিষয়ও এখানে নেই। সামাজিক বা অর্থনৈতিক বড় কোনো প্রাপ্তিও এখানে সম্ভব নয়। নিজের অর্থ ও শ্রম খরচ করে যে কাজটি শত বছর ধরে চলে এসেছে সেই কাজে ছন্দপতন ঘটালো কে?

ইখলাস ও লিল্লাহিয়াতের উৎকৃষ্ট নমুনা হিসেবে যে আন্দোলনটি কোটি মানুষের হৃদয়জগত জয় করেছে সেই আন্দোলনে নেতৃত্বের টানাটানি শুরু হলো কীভাবে!

আমাদের প্রতিটি দীনি কাজেই বিভাজন এখন দৃশ্যমান। এক আল্লাহ, এক রাসুল, এক কালেমার অনুসারী হয়েও আমরা বহুধা বিভক্ত। আমরা ঘরের বাইরের লোকদের সঙ্গে যতটা না প্রতিযোগিতা করি এর চেয়ে বেশি রশি টানাটানি করি ঘরের লোকদের সঙ্গে।

আমাদের দীন ও জাতিসত্তার প্রকৃত শত্রুদের সঙ্গে আমাদের যতটা না পাল্লাপাল্লি এর চেয়ে অনেক বেশি পাল্টাপাল্টি ঘরের লোকদের সঙ্গে, নিজের ভাইয়ের সঙ্গে। চারদিকের বিভক্তি ও অন্তঃকোন্দল দেখতে দেখতে যখন আমরা অতিষ্ঠ তখন একটা জায়গাই ছিল আমাদের অহংকার করার মতো। সেটা ফলপ্রসূ দাওয়াতি আন্দোলন তাবলিগ জামাত। এখানে আমরা যুগের পর যুগ কোনো বিভাজন দেখিনি।

বছরের পর বছর দাওয়াত ও তাবলিগের কাজে যুক্ত কারও মধ্যে নেতৃত্বের লোভ, লৌকিকতা ও প্রদর্শনের ছিঁটেফোঁটাও দেখিনি। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে, অবিরত শ্রম দিয়ে পরের কল্যাণ কামনা করতে দেখেছি তাবলিগি ভাইদের। অপর ভাইকেও দীনের পথে আনার যে আকুতি তাবলিগের লোকদের মধ্যে দেখেছি তা আর কোথাও চোখে পড়েনি।

দিন দিন তাদের অসামান্য ত্যাগ, আল্লাহর দীনের জন্য আত্মনিবেদন ও দাওয়াতি কাজে নিজেকে বিলীন করে দেয়ার নমুনা দেখে শুধু মুগ্ধই হয়েছি। দূর থেকে তাদের দেখে গর্ববোধ করেছি। এই কাজের সঙ্গে উৎপ্রোতভাবে জড়িত না হওয়া সত্ত্বেও তাবলিগ সম্পর্কে কেউ বিরূপ কিছু বললে বিতর্ক করেছি, তাদের পক্ষ নিয়ে ঝগড়াও করেছি।

কিন্তু বড়ই আফসোসের সঙ্গে আজ বলতে হচ্ছে, আমাদের প্রিয় তাবলিগ তার সেই অবস্থান হারিয়ে ফেলেছে। এর সঙ্গে যুক্ত ভাইয়েরা তাদের সেই গর্ব করার মতো উদাহরণগুলো ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন। তাবলিগ জামাতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো একরামুল মুসলিমিন, অর্থাৎ মুসলমান ভাইকে সম্মান করা।

কওমি মাদরাসা নিয়ে একমুঠো ভাবনা

বিশ্ব ইজতেমায় দেখেছি, তাবলিগি ভাইদের গায়ের ওপর কাদামাখা পা দিয়ে পথচারীরা চলে যাচ্ছে, কিন্তু তারা সামান্য বিরক্তিও প্রকাশ করছেন না। অন্য ভাইকে সম্মান করা, অপরের জন্য নিজের সুখ বিসর্জন দেয়া, নিজের চেয়ে অপর ভাইয়ের প্রয়োজনটাকে বড় করে দেখা গুরুত্ব সহকারে শিখিয়েছে তাবলিগ।

কিন্তু সেই তাবলিগে আজ একজন আরেকজনের ওপর হাত তুলছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে লাঞ্ছিত ও অপদস্থ করছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতো ক্যাডারভিত্তিক মহড়ায় লিপ্ত হচ্ছে। মসজিদে নামাজরত আরেক ভাইকে রক্তাক্ত করতেও কুণ্ঠিত হচ্ছে না। আল্লাহর ঘর মসজিদে আরেক ভাইকে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে। নিজের মতের অমিল না হলে তাকে ঘায়েল করার এমন কোনো চেষ্টা নেই যা তাবলিগি ভাইয়েরা করছেন না।

আমি বিশ্বাস করি, এসব কাজের সঙ্গে যুক্ত নামধারী তাবলিগি কিছু ভাই। উভয় পক্ষের অতি উৎসাহী কিছু মানুষ। যাদের নামে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে তারা কিন্তু এমনটা করার কথা বলে দেননি। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে অতি উৎসাহীরা ন্যাক্কারজনক নানা কর্মকাণ্ডে দিনদিন তাবলিগের বদনাম করছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর মতো তাবলিগ কর্মীদের মারামারি ও হানাহানির চিত্র যখন সংবাদপত্রের পাতায় কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখে পড়ে তখন লজ্জায় মাথা হেট হয়ে আসে। আমাদের গর্ব ও অহংকারের জায়গাটি ধুলোয় মিশে যায়।

আমরা জানি, যে চক্রটি শুরু থেকেই তাবলিগকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত তারা এসব দৃশ্য দেখে খুশিতে বগল বাজায়। সেই চক্রটিরই কেউ কেউ কোনো পক্ষের সঙ্গে মিশে ভাইয়ে ভাইয়ের সংঘাতে ইন্ধন যোগায়। তাবলিগের বদনাম হলে তারা বন্য সুখ অনুভব করে।

প্রিয় তাবলিগি ভাইয়েরা! অনেক হয়েছে, এবার একটু ক্ষান্ত দিন। নিজের মত ও প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার সব ঘাটই তো পার হয়েছেন। প্লিজ, আর লোক হাসাবেন না। প্রয়োজনে আপনি তাবলিগ ছেড়ে দিন, ইলহামি এই কাজ আল্লাহ যাকে পছন্দ করেন তাকে দিয়ে বাস্তবায়ন করবেন।

আপনার একান্ত ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে গিয়ে কোটি হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটানোর অধিকার আপনার নেই। আপনি একান্তই আল্লাহর জন্য এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকলে এর কোনো ক্ষতি হোক নিশ্চয় সেটা আপনি চাইবেন না।

প্রয়োজনে ইজতেহাদের ভিত্তিতে অনেক দীনি কাজের মতো তাবলিগও দুই ভাগে ভাগ হতে পারে। ঐক্যের শত চেষ্টা করেও সফল না হলে কথিত ‘ইতায়াত’ আর ‘আলমি শুরা’র ভিত্তিতে ভাগ হয়ে যান। তবুও তাবলিগের নাম করে নোংরামি ছড়াবেন না। একটার পর আরেকটা ফেতনার জন্ম দেবেন না।

নিরেট দীনের এই কাজটিকে পার্থিব স্বার্থ হাসিলের মাধ্যম বানালে পরকালে নিশ্চয় জবাবদিহি করতে হবে। আসুন, আমরা পরকালের জবাবদিহির ভয় অন্তত অন্তরে ধারণ করি।

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম

-আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ