বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


ইসলাম শব্দের ধর্ম না, বিশ্বাসের ধর্ম

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর

বন্ধু সেলিমের ক্যাডেট মাদরাসার অফিসে বসে আছি। মাদরাসার পর্দানশিন মহিলা শিক্ষিকা অফিসকক্ষে ঢুকে আচমকা প্রশ্ন করলেন, 'হুজুর, মালিকুল মউত কে? কাকে মালিকুল মউত বলে?'

বাংলা শিক্ষিকা, যদিও হাত-পা মোজাপরা, কিন্তু ধর্মের সহজ বিষয়কে কেউ কঠিন করে জিজ্ঞেস করলে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া ছাড়া তার করার কিছু নাই। মাদরাসায় পড়ায় বলে প্রতিবেশী কেউ হয়তো জিজ্ঞেস করেছিল, অথবা তাকে পেজগিতে ফেলার জন্যই এমন প্রশ্ন করেছিল। সহজ প্রশ্নের কঠিন উত্তর কামনার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে জ্ঞানী ভাবতে ভালোবাসে। প্রতিবেশীও জ্ঞান জাহিরের ধান্ধায় প্রশ্ন করেছে, বুঝতে পারলাম।

'মালিকুল মউত তো আজরাইলকে বলে। আজরাইল মানুষের জান কবজ করে, মানুষের মউত নিয়ে আসে—সে-ই তো মালাকুল মউত!' সেলিমের প্রাথমিক জবাব এবং এটাই প্রচলিত ও প্রাসঙ্গিক উত্তর। কিন্তু এ উত্তর তো সবার জানা। সবাই যদি জানে তাহলে এ বিষয়ে কেউ প্রশ্ন করবে কেন? নিশ্চয় এই 'মালিকুল মউতের' মাঝে ঘাপলা আছে। সেলিম ভ্রু কুঁচকে চিন্তা করল—ঘাপলাটা কী?

সেলিম ঘাপলার ভেতর আঙুল ডুবিয়ে বলল, 'মালিকুল মউত মানে হলো 'মৃত্যুর মালিক', যার অধীনে মৃত্যু। কিন্তু মৃত্যুর একমাত্র মালিক তো আল্লাহ, আজরাইল তো মৃত্যুর মালিক না। সে হিসেবে তাঁকে মালিকুল মউত বলাটা উচিত না। কী বলেন হুজুর?' পাশে বসে থাকা মুরব্বি গোছের ক্যাশিয়ারের সত্যায়ন দরকার। ক্যাশিয়ার সাহেব হে হে করে হেসে বললেন, ‘তা তো ঠিকই বলছেন হে হে...!’ হাসিমুখ, হাসিমুখে আনন্দধারা...! তিনি এমন জটিল প্রশ্নেও হেসে চলেছেন, জীবন নিয়ে আশাবাদী হওয়া ছাড়া উপায় নাই।

আমি শিক্ষিকার পাশের চেয়ারে বসে ফোন টেপাটেপি করছি। আলোচ্যবিষয় মাদরাসার শিক্ষক আর শিক্ষিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকুক, আমি সামান্য আগন্তুক মাত্র। অপরের আলোচনায় বামহাত ঢুকানো অভব্যতা, আমি ফোনের স্ক্রিনে নিবিষ্ট হলাম। ধ্যাত, নেট কানেকশনই তো পাচ্ছি না!

‘হজরত, আপনে কী বলেন?’
সেলিম আর আমি হেফজখানা থেকে একাধারে সাত-আট বছর একসঙ্গে পড়েছি, সেই শরহে বেকায়া জামাত পর্যন্ত। দুইজনের মাঝে ‘আপনি’ সম্বোধন তো দূরের কথা, তুই-তোকারির নিম্নতম কোনো সম্বোধন যদি থাকে সেই সম্বোধনে কথা বলি। সেই সুযোগ যেহেতু নাই, সম্বোধনের আগে-পিছে একটা করে গালি মিশিয়ে তার ডাকি। সেই সেলিমের মুখে ‘হজরত’ ‘আপনে’...! শিক্ষিকার সামনে এমন অভাবিত সম্মান পেয়ে আমি যারপরনাই গলে গেলাম।

‘জি সেলিম ভাই, যেমনটি আপনি বলছিলেন সেটাই ঠিক। আগে যেটা বলছেন সেটাও ঠিক, পরে যেটা বলছেন সেটাও ঠিক।’ আমি শিক্ষিকাকে ধন্ধে ফেলার জন্য কথার মধ্যে একটু রহস্য রেখে দিলাম। দুনিয়া পুরাটাই রহস্যময়। বিশ্বকাপ থেকে আর্জেন্টিনার বিদায়ও রহস্যময়!

‘আমাদের একটু বলবেন ব্যাখ্যা করে, আসলে মালিকুল মউত তো আল্লাহ, তাই না? তাহলে আজরাইলকে মালিকুল মউত বলা তো শিরকের মধ্যে পড়ে...!’ আলোচনা দেখা যাচ্ছে স্পর্শকাতর দিকে চলে যাচ্ছে। ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার এই সুবর্ণ সুযোগ, আশপাশে বিজ্ঞব্যক্তি কাউকে দেখা যাচ্ছে না। দলিল-যুক্তি দিয়ে যা পেশ করব তা-ই মান্য হবে, এমন সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। শিক্ষিকাও নড়ে চড়ে বসছেন...!

সামনের ডেস্কে রাখা বাংলা একাডেমির বাংলা-ইংরেজি বড় অভিধানটা টান মেরে হাতে নিয়ে ধপাস করে আবার ডেস্কের মাঝ বরাবর ফেললাম। সেলিম এবং শিক্ষিকা-দুজনকেই খানিকটা চমকে দেয়ার এরাদা। আলোচনায় যাওয়ার আগে একটা সিন ক্রিয়েট করতে হবে। সিনের মধ্যেই অর্ধেক উত্তর গলাধঃকরণ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ!

‘ধরেন সেলিম ভাই, এই বইটা আমার। বইটা আপনাকে দিয়ে বললাম, বাংলাবাজার গিয়ে বইটা নবপ্রকাশে দিয়ে আসবেন। আপনি বইটা নিয়ে গাড়িতে উঠলেন। গাড়িতে যাত্রী কম, জানালার ধারের সিটে বসে বইটা পাশের সিটে রাখলেন। আচমকা এক যুবতী আপনার সিটের সামনে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বইটা আপনার?’
আপনি ত্বরিত বইখানা সিট থেকে হাতে নিয়ে বলবেন, ‘বইটা আমারই, বসুন বসুন...!’

‘কিন্তু সেলিম ভাই, বইটা কি আপনার? না, বইটার মালিকানা আপনার নয়। আপনি বইটা পোস্তগোলা থেকে বাংলাবাজার নেয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত মাত্র। দায়িত্বের সূত্রে আপনি সাময়িক মালিকানাপ্রাপ্ত হয়েছেন। কিন্তু ওই যুবতী জিজ্ঞেস করলে আপনি বলবেন না যে বইটা তো আমার বন্ধুর, আমি সেটা নিয়ে বাংলাবাজার যাচ্ছি। এটা শুনতে বেখাপ্পা লাগবে এবং যুবতীর কাঙ্ক্ষিত উত্তরও এটা নয়। তিনি শুধু জানতে চাচ্ছেন, বইটা যদি আপনার দায়িত্বে থাকে তবে সেটা সরান, আমি অত্র সিটে উপবেশন করব।

‘আজরাইলকে মালিকুল মউত বললে সেটা শিরক না হওয়াই যুক্তিযুক্ত। কেননা, তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের মৃত্যুর দায়িত্বপ্রাপ্ত। উপরমহল থেকে তিনি মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে এসে পৃথিবীতে সেগুলো বাস্তবায়ন করে থাকেন। সে হিসেবে তাঁকে মালিকুল মউত বা মৃত্যুর মালিকানাপ্রাপ্ত বলাটা দোষণীয় কিছু নয়।

‘আর তাছাড়া, শব্দটা ‘মালিকুল মউত’ না ‘মালাকুল মউত’। মালাক মানে ফেরেশতা আর মউত মানে মৃত্যু, মৃত্যুর ফেরেশতা। সে হিসেবে কোনো সমস্যা হওয়ারই কথা নয়।’

আলোচনা এখানেই ইতি টানা যেত, কিন্তু পারিপার্শ্বিক নানাবিধ কারণে আমি পণ্ডিতি জারি রাখলাম, ‘ইসলাম শব্দের ধর্ম না, ইসলাম বিশ্বাসের ধর্ম। মানুষের মৌখিক শব্দ সামান্য কারণে এদিক-ওদিক হতে পারে, তাই বলে তাকে ভণ্ড, নাস্তিক, মুশরিক, কাফের বলা অনুচিত। মানুষের হৃদয়ের বিশ্বাসের নাম হলো ঈমান; তারপর সেটা মুখে সত্যায়ন এবং কাজে পরিণত করতে হয়। অনেক হিন্দুকে জানি যারা কালেমা জানে, আলহামদু সুরা জানে, অনেকে কুরআনও পড়তে পারে। তাই বলে কি তাদের মুসলিম বলা যাবে? যাবে না। কারণ, তাদের অন্তর কালেমা বিশ্বাস করে না, কুরআন বিশ্বাস করে না। আপনি যদি কেবল শব্দের পেছনে পড়েন তাহলে দিনশেষে ঈমান নিয়ে ঘুমুতে যেতে পারবেন না।

‘ধরুন একজন কৃষক বললেন, এবারকার বৃষ্টির কারণে ফসল ভালো হইছে, খরার কারণে ধানে চিটা হইছে, শিলের কারণে আম নষ্ট হয়ে গেছে... অর্থের দিকে তাকালে এ-সবই শিরক। কিন্তু একজন কৃষকের বিশ্বাসটা আপনাকে বুঝতে হবে। তার অন্তরের বিশ্বাস হলো—আল্লাহ এবার বেশি বৃষ্টি দেয়ার কারণে ফসল নষ্ট হয়ে গেছে, চৈত্র মাসে আল্লাহ শিলাবৃষ্টি দেয়ায় আমে পচন ধরেছে, অধিক খরা দিয়েছেন বিধায় ধানে চিটা হয়েছে। এটাই হলো বিশ্বাস, এর নামই ঈমান। বাদবাকি মুখে যাই বলুক, সবই কথার কথা। প্রচলিত শাব্দিক পরিভাষা না বুঝে আপনি যদি সেটা নিয়ে হালাল-হারাম আর কুফর-শিরকের প্রশ্ন তোলেন তবে বঙ্গদেশে মুসলিম গুগলে সার্চ দিয়েও খুঁজে পাবেন না।

‘আপনি অনেক বিজ্ঞজন, আলেম বা ধর্মবেত্তাকে দেখবেন যারা শব্দের পেছনে পড়ে আছেন। নানা রকম ধর্মীয় শব্দ নিয়ে তারা সোস্যাল মিডিয়ায় ঝগড়া করে, একজন আরেকজনকে ভণ্ড, ফাসেক, কাফের বলে নিজেকে চমৎকার মুসলিম দাবি করে। কী তাজ্জব! তাদের কাছে মানুষের অন্তরের বিশ্বাসের কোনো মূল্য নেই! তারা শব্দ দিয়ে ইসলামের বিজয়ের স্বপ্ন দেখে, শব্দের মারপ্যাঁচেই সারা পৃথিবীতে দীনের দাওয়াত ছড়িয়ে দেয়ার জোশ দেখায়।

‘বস্তুত এরাই সবচে বড় ফাসাদ সৃষ্টিকারী। কুরআনে সুরা বাকারার ১১ ও ১২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন,
وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ لاَ تُفْسِدُواْ فِي الأَرْضِ قَالُواْ إِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُونَ
أَلا إِنَّهُمْ هُمُ الْمُفْسِدُونَ وَلَـكِن لاَّ يَشْعُرُونَ
‘আর যখন তাদেরকে বলা হয় যে, দুনিয়ার বুকে দাঙ্গা-হাঙ্গা সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলে, আমরা তো মীমাংসার পথ অবলম্বন করেছি। মনে রেখো, তারাই হাঙ্গামা সৃষ্টিকারী, কিন্তু তারা তা উপলব্ধি করে না।’

‘বুঝলেন সেলিম ভাই, যারা ধর্মের নামে বিতর্ক সৃষ্টি করে মানুষের মাঝে বিভেদ ছড়িয়ে দেয়, তারাই হলো সবচে বড় মোনাফেক। কুরআনের এ আয়াত এইসব মোনাফেকদের জন্যই অবতীর্ণ হয়েছে। আমরা সবাইকে বলি ইসলাম শান্তির ধর্ম, আবার আমরাই ধর্মের দোহাই দিয়ে, ধর্মীয় বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়-ফাসাদ লাগিয়ে রাখি। ইসলাম যে শান্তির ধর্ম, এটা আমরা নিজেরাই বিশ্বাস করি না, অন্যকে কীভাবে এই ওয়াজ করি? আমাদের চাইতে বড় মোনাফেক আর কে আছে এ দুনিয়ায়!’

একটানা এতক্ষণ কথা বলে নিজেকে বেশ বিদ্বান বিদ্বান মনে হচ্ছে। সেলিম জলদি পিয়নকে ডাক দিল, ‘জলদি চা আনেন, আদা দেয়া লাল চা। সঙ্গে গজা আছে না? প্লেটে কইরা গজা দিয়া যান।’

শিক্ষিকা এতক্ষণ নড়াচড়া করেন নাই, গজার কথা শুনে তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালেন-এখনই তার চলে যেতে হবে। কী অবাক কাণ্ড! এত জ্ঞানগর্ভ আলোচনার কোনো উপসংহারই তো হলো না, এখনই চলে যাবেন! কী আর করা, আমি আর সেলিম চোখাচোখি করে বিরস মুখে নিরস গজা চিবুতে লাগলাম।

লেখক: তরুণ আলেম, কবি ও কথাসাহিত্যিক

-আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ