মুমিনুল ইসলাম: আজ পবিত্র ঈদুল ফিতর। কক্সবাজারের উখিয়া টেকনাফে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা মসজিদ ও নুরানী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঈদের জামাত আদায় করেছেন।
উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থিত এক হাজার ২০টি মসজিদ ও ৫৪০টি নুরানী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (মত্তব) ও টেকনাফের নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৫টি, অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২৪৫টি ও ২০টি নুরানী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (মত্তব) রয়েছে।
এসব মসজিদ ও নুরানী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঈদের জামাত আদায় করেছেন ধর্মপ্রাণ মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। নামাজ শেষে মোনাজাতে আল্লাহ কাছে তাদের একটাই প্রার্থনা- যত দ্রুত সম্ভব তারা যেন নিজ দেশ রাখাইনে ফিরে যেতে পারেন। রাখাইনে যাতে শান্তি ফিরে আসে।
নিরাপদে নিজ দেশে ফিরে গিয়ে যেন তাদের মা-বাবা, দাদা-দাদীসহ আত্মীয় স্বজনদের কবর জিয়ারত করতে পারে।
উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সাধারণ সম্পাদক নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘রাখাইনে বর্বর ও নানা নির্যাতনের শিকার হলেও নিজ দেশের জন্য মায়া হয় আমাদের।
আমরা চাই নিরাপদে রাখাইনে ফিরতে। আজকে ঈদ জামাত শেষে আল্লাহ কাছে এই ছিল প্রার্থনা। কারণ, এই ছোট পরিসরে আমাদের জীবন বিষাদ হয়ে উঠেছে। ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই। নেই কোনও আনন্দ উপভোগ করার।’
উখিয়ার থাইংখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা মাস্টার আব্দুল মান্নান বলেন, ‘কী নিয়ে আনন্দ করবো।
এই ঈদে যেখানে আমার বাবা-মা রাখাইনে কবরস্থানে পড়ে রয়েছে, জিয়ারতও করার সুযোগ হচ্ছে না। সেখানে আমাদের আনন্দ ও খুশি করার কিছুই নেই। আমরা চাই, খুব দ্রুত রাখাইনে ফিরতে। এজন্য বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক মহলের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আয়ুব আলী মাঝি বলেন, ‘আজকে ঈদের নামাজ শেষে শুধু ইমাম, মৌলভীরা নয়, মসজিদে উপস্থিত কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নাই।
রাখাইনে আমরা কেউ বাব-মা ও বোনকে হারিয়েছি, আবার কেউ ভাই ও স্বজনকে হারিয়েছি। কবরে পড়ে রয়েছে আমার মা। অন্তত তাদের জন্য হলেও কিছু একটা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
কারণ, গত ৯ থেকে ১০ মাস হয়ে যাচ্ছে আমরা বাংলাদেশে এসেছি। এখনও পর্যন্ত আন্তর্জাতিক কোনও সংস্থা আমাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনে কোনও পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা লালু মাঝি বলেন, ‘ বৃষ্টি না হওয়ায় ঈদের নামাজ নিয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি। খুব ভালো এবং সুন্দর পরিবেশে আমরা ঈদের নামাজ আদায় করেছি।’
বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৮ ব্লকের বাসিন্দা মিনারা বেগম বলেন, ‘রাখাইন থেকে পালিয়ে আসার সময় আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি। এই প্রথম আমার বাবাকে ছাড়া ঈদ করলাম। তাও নিজ দেশে করতে পারলাম না।’
শুধু মিনারা নয়, মিনারার মত রাখাইনে অনেকে বাবা-মাকে হারিয়েছে, হারিয়েছে আদরের ছেলে মেয়েকে। প্রতি বছর যাদের নিয়ে ধুমধাম করে ঈদ উদযাপন করা হয়, আজ তাদের পাশে কেউ নেই। নিজ দেশ ছেড়ে আজ তারা ভিন দেশের বাসিন্দা।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নিকারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘রাখাইন থেকে নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। এদের অধিকাংশ উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান করছে। ঈদে তাদের কথা বিবেচনা করে ঈদ সামগ্রীসহ সুষ্ঠুভাবে যাতে ঈদের নামাজ আদায় করতে পারে, সেজন্য সব ধরনের প্রস্তুতি আগে থেকে করা ছিল। উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক হাজার ২০টি মসজিদ ও ৫৪০টি নুরানী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (মত্তব) রয়েছে। সব মসজিদ ও প্রতিষ্ঠানে নামাজ আদায়ের জন্য আলাদা ব্যবস্থা ছিল।’
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রবিউল হাসান বলেন, ‘টেকনাফে রেজি. ক্যাম্পে ৫টি, আন্ত.রেজিস্টার্ড ক্যাম্পে দেড় শতাধিক মসজিদ ও ২০টি নুরানী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। মূলত এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঈদ জামাত আদায় করা হয়েছে। টেকনাফে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা কম হওয়ায় নামাজ পড়তে তেমন কোন অসুবিধা হয়নি।’
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘ জেলা প্রশাসন সবসময় রোহিঙ্গাদের সার্বিক সুযোগ সুবিধা দিয়ে আসছে। উখিয়া ও টেকনাফে যেসব ক্যাম্পগুলো রয়েছে সব ক্যাম্পে ‘ডব্লিউএফপি’ ‘ইউএনসিআর’ ‘আরআরসি’ সহ বিভিন্ন সংস্থা ঈদ সামগ্রী বিতরণ করেছে। একই সাথে সপ্তাহিক ও মাসিক রেশমও বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও রোহিঙ্গারা যাতে অন্যান্যদের মতো ঈদের নামাজ আদায় করতে পারে সেজন্য মসজিদে মসজিদে নামাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সকাল থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থিত মসজিদগুলোতে পালাক্রম ঈদের জামায়াত আদায় করা হয়েছে।