এ এস এম মাহমুদ হাসান
আলেম, কলামিস্ট
চলতি শতকে বিশ্বের তথ্য প্রযুক্তিখাতের আধুনিকায়ন বিশ্বয়কর। সারা বিশ্বে প্রযুক্তি বিপ্লবের প্রভাবে মানুষ মুহূর্তেই বিশ্ব জগতকে হাতের মুঠোয় নিয়েছে। এই প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় অন্যতম উপাদান হলো ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া।
বিশ্বের অপরাপর ঘটে যাওয়া ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক সংবাদগুলো খুব যত্নসহকারে তুলে আনার চেষ্টা করে ইলেক্ট্রিক মিডিয়া। কিন্তু প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, কিছু স্বার্থান্বেষী মহল উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে প্রযুক্তিকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে।
অথচ তথ্য প্রযুক্তির এ উন্মক্ত জগতে অন্তত চলতি শতাব্দীতে তথ্য বিকৃতি, মিথ্যা তথ্য প্রদান, তথ্য সন্ত্রাসীর মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যেতে পারে কিন্তু সত্যকে দাবিয়ে রেখে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ আর নেই।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশের সময় টেলিভিশন ও একাত্তর টেলিভিশনের একটি বিকৃত ও মনগড়া প্রতিবেদন পুরো মিডিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
প্রযুক্তির উদোমযুগে ইলেক্ট্রিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রদর্শিত নানান তথ্য এখন অনলাইনে বিশ্লেষন করা হয়। পূর্বাপর সচিত্র দালিলিক প্রমান হাজির করা হয়।
মিথ্যায় আশ্রিত মিডিয়াকে শক্ত সমালোচনার শূলে বিদ্ধ করা হয়। এমনকি অনলাইনে ভাইরাল বিষয়কে সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও গুরুত্ব দেওয়া হয়। সম্ভবত এ তথ্যগুলো সময় ও একাত্তর সংশ্লিষ্টরা ভালোই জানেন।
সরকারের মাদক বিরোধী অভিযানের অন্যতম সহযোগী হয়ে মিডিয়াগুলো মাদক ব্যবসায়ী ও গডফাদারদের মুখোমুখি হয়েছে। নিত্যদিন প্রকাশ করছে মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা ও অভিযানের পূর্বাপর নানান তথ্য। যা অত্যন্ত প্রসংশনীয় হয়েছে।
কিন্তু সুকৌশলী কিছু মিডিয়া নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নে মাঝে মাঝে চমক দেখানোর ধান্দায়, টেলিভিশনের দর্শক জরিপে এগিয়ে থাকতে বিপথে হাঁটার যথেষ্ট কোশেশ করে থাকে। যা নিন্দনীয়।
পুলিশের কাছে তথ্য অনুযায়ী টেকনাফের বাসিন্দা লেবাসধারী শহিদুল্লাহর কাছে আসছে মাদক ইয়াবার বড় চালান। আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা সংবাদিকরা গোপন ক্যামেরা নিয়ে যাত্রাবাড়ীর একটি মসজিদে হাজির।
আশপাশে ঘুরঘুর করছে পুলিশের গোয়েন্দা বাহিনী। যথারীতি শহিদুল্লাহর কাছে এক যুবক হাটু গেড়ে উস্তাদ শাগরেদ সাক্ষাতের ন্যায় বসে সন্মানসূচক সালাম ও হ্যান্ডশেক করল। শহিদুল্লাহ নিজের দৃষ্টি থেকে পেছনে থাকা একটি বাজার ব্যাগ হাতে নিয়ে আগত যুবকটির হাতে তুলে দিল।
শান্ত মেজাজে যুবকটি মসজিদের বাইরে আসা মাত্রই ব্যাগসহ তল্লাশীর শিকার হয়ে ব্যাগটির দাতা গ্রহীতা উভয়েই গ্রেফতার হলো। মিডিয়া দুটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভিডিও ফুটেজের চিত্র ঠিক এমনি দেখাচ্ছে।
কিন্তু গোপনে ধারণ করা ভিডিওটির কলাকৌশল ও মিডিয়া দুটির প্রশ্নবিদ্ধ প্রতিবেদনে ব্যাপক সন্দেহ ও সমালোচনা চলছে দেশজুড়ে।
সন্দেহ ও সমালোচনা কেন?
ভিডিও ফুটেজ দেখাচ্ছে, হুজুরের লেবাসধারী ইয়াবা ব্যবসায়ী শহিদুল্লাহ মসজিদের এককোণে নামাজরত। আর ইয়াবা ভর্তি ব্যাগ তার দৃষ্টির একবারেই বাইরে। অর্থাৎ ব্যাগটি ছিল শহিদুল্লাহর পেছনে।
এক. প্রশ্ন উঠেছে যাত্রাবাড়ীর মত জনাকীর্ণ এলাকায় এবং মসজিদের পাশেই সিএনজি ষ্টেশনের মত বহু মানুষের আনাগোনা স্থলে, ইয়াবার বিরুদ্ধে সরকারের সাড়াশী অভিযান চলাকালে ইয়াবা ব্যবসায়ী কেন নামাজের সময় তার ইয়াবার ব্যাগ পেছনে রেখে নামজ পড়বে ? অথচ এই ঢাকায় মসজিদে মুসল্লিরা নিন্মমানের জুতাও নিজের দৃষ্টির আঁড়ালে রেখে বা পেছনে রেখে নামাজে দাঁড়াতে চায় না। সেখানে শহিদুল্লাহ ব্যবসায়ীর পেছনে রাখা ব্যাগ নিয়ে প্রশ্ন উঠাই স্বাভাবিক।
দুই. শহিদুল্লাহর নামাজ তখন শেষ পর্যায়ে। (ভিডিওতে) কোনো ধরনের পূর্ব অপেক্ষা ছাড়াই যুবকটি শহিদুল্লাহর কাছে যেয়ে সালাম মুসাহফা শেষে ব্যাগটি নিয়েই রওনা হলো।
ব্যাগ হ্যান্ডবদলের সময় উভয়ের শারীরিক ভঙ্গিমা ও আচরণ দুই ব্যবসায়ীক পার্টনারশিপের মত ছিল না। যেটা ভিডিওতে স্পষ্ট। বরং ভিডিওতে তৃতীয় কোনো পক্ষের শেখানো ভঙ্গিমা ও আচরণ উভয় পার্টনার থেকে স্পষ্ট পরিলক্ষিত হয়েছে।
তিন. যুবকটি পেছন থেকে শহিদুল্লাহর কাছে হেঁটে আসার সময় শহিদুল্লাহ সামনের (পশ্চিম) দিকেই তাকানো ছিল। শহিদুল্লাহ ডান পাশে হাত বাড়িয়েই পেছন থেকে আগত যুবকের সাথে করমর্দন করলো।
অথচ পেছন থেকে তার একন্ত ব্যবসায়ীক পার্টনার যুবকটিই হেঁটে আসছে সেটা মুহূর্তেই কিভাবে নিশ্চিত হলো শহিদুল্লাহ? যেন নাটকের শুটিংয়ের মত মুখস্থ বিদ্যা অনুযায়ী কাজগুলো করছে শহিদুল্লাহ ও তার পার্টনার।
চার. প্রতিবেদনে ভিডিওটি গোপনে করার কথা বলা হয়েছে। অথচ লেবাসধারী শহিদুল্লাহ যখন ব্যাগ হস্তান্তর করছিল, তখন সে ক্যামেরার দিকে কয়েকবার তাকিয়েছে এবং তার পার্টনার যুবকটিও ফেরার সময় ক্যামেরার দিকে মিটি মিটি চোখে তাকিয়েছে।
কিন্তু ইয়াবার বিরুদ্ধে সারা দেশে সরকারের এতবড় অভিযানের সময়ও জনবহুল যাত্রাবাড়ীর অন্যতম প্রধান সড়কের পাশেই মসজিদে ক্যামেরার সামনে দিয়ে এত সহজেই ইয়াবার চালান যাবে? সত্যিই হাস্যকর গল্প।
পাঁচ. মসজিদের একটি মাত্র সরু গেইট দিয়েই প্রবেশ করে ভিডিওটি ধারণ করা হয়েছে। এখানে ক্যামেরা গোপন করে রাখার মত কোনো চিপা বা অন্দরমহল ছিলনা। মসজিদের ঠিক একই গেট দিয়ে ক্যামেরা তাক করার স্থাপনের স্থান দিয়েই শহিদুল্লাহর কাছে ঐ যুবকটি প্রবেশ করেছে। যা ভিডিওতে সুস্পষ্ট। তাহলে গোপনে ভিডিও ধারণ করার যুক্তি আসলো কিভাবে?
ছয়. ভিডিওটি যদি সত্যিই গোপনে করা হয়ে থাকে, তাহলে সাধারণত গোপন ভিডিওগুলো অনেক ছোট ডিভাইস দ্বারা ধারণ করা হয়। অথচ একটি ভিডিওটিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, একটু পাশেই প্রকাশ্যে বড় ভিডিও ডিভাইস ক্যামেরা দ্বারা অন্যকেহ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভিডিও ধারণ করছে। যা কোনোভাবেই গোপন ভিডিও বলে প্রতিয়মান হয় না।
সাত. গোপন ভিডিও ধারণ করার স্থান হয় সংকীর্ণ। ভিডিওর ছবি স্থির হয়না। ধারণ করা ভিডিওর রেজুলেশন (চিত্র) ব্যাপ্তিও হয় খুব কম জায়গা নিয়ে। কিন্তু মিডিয়া দুটির কথিত গোপনে ধারণ করা ভিডিও ঠিক এর উল্টো।
ভিডিওটিতে যথেষ্ট ইমেজ স্থিরতা দিয়ে, প্রকাশ্যে, ইয়াবা ব্যবসায়ীদ্বয়কে বারংবার ক্যামেরার দিকে চোখ তুলে তাকানোর ফুরসত রেখে গোপনে ভিডিওটি ধারণ করা হয়েছে বলে কিভাবে মিডিয়া দুটি চালিয়ে দিল, তা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন, সন্দেহ ও চিন্তার উদ্রেগ ঘটেছে।
আট. ভিডিওটি বলছে, মসজিদ থেকে বের হয়েই গেটে ধরা পড়ার সাথে সাথে হুড়হুড় করে পুলিশ ও মিডিয়ার কাছে ইয়াবা ব্যবসায়ীদ্বয় সব স্বীকারোক্তি দিয়ে দিচ্ছে।
ইয়াবার চালান কোথায় যাবে, কোথা থেকে এসেছে, তাদের ব্যক্তি পরিচয় থেকে শুরু করে আদ্যোপান্ত সব তথ্যাদি সহজেই দিয়ে দিল। অথচ কোনো ইয়াবা ব্যবসায়ী কখনো এত সহজে স্বীকারোক্তি দিয়েছে তা আমরা কখনো দেখিনি।
প্রবল সন্দেহ রয়েছে, পূর্বেই ধরা পড়া ইয়াবা ব্যবসায়ীকে চাপ দিয়ে সব তথ্য বের করার পর মিডিয়ার উপস্থিতিতে নাটক মঞ্চস্থ করে ২য় বার আবার একই স্বীকারোক্তি প্রদানে বাধ্য করা হয়েছে। যাতে করে সরকার, বুদ্ধিজীবি, আপামর জনসাধারণ মসজিদ, আলেমসহ দ্বীনি প্রতিষ্ঠানকে এখন থেকে ভিন্ন (খারাপ) চোখে দেখা শুরু করার একটি মাধ্যম বা উপাদান খুঁজে পায়।
ইয়াবা ব্যবসায়ী লেবাসধারী শহিদুল্লাহর গ্রেফতার হওয়ার আগে ইয়াবার বিরুদ্ধে চলতি অভিযানে অন্য কানো ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে এতটা খোলাখুলিভাবে ভিডিও ধারণ করে মিডিয়া কোনো প্রতিবেদন তৈরী করতে পারেনি। এবং ব্যবসায়ী কোথায় কোথায় পড়েছে (?)
তার উপস্থিত শিক্ষাজ্ঞানের ধারনা সম্পর্কেও মিডিয়া কখনো জানতে চায়নি। অথচ হুজুর সেজে বসা ইয়াবা ব্যাবসায়ী শহিদুল্লাহ কোন কোন মাদরাসায় পড়েছে, কি পড়েছে এমনকি কুরআন তেলাওয়াত দর্শকদের শুনিয়ে প্রতিবেদন করে ইয়াবা ব্যবসায়ী শহিদুল্লাহ মাদরাসা পড়–য়া নিশ্চিত করার জন্য মিডিয়া ফলাও করে ব্যাপকভাবে প্রচার করেছে।
ইয়াবা ব্যবসায়ী শহিদুল্লাহ গ্রেফতারের প্রতিবেদন ও ভিডিওটিতে অসংখ্য গড়মিল, অসামঞ্জস্যতা, প্রতিবেদন করার অসঙ্গত কৌশলী দৃষ্টিভঙ্গি নানান প্রশ্নের জন্ম দেওয়া সত্বেও তা দেদারচে প্রচার করে আমাদের মাঝে প্রবল উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে।
দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ইয়াবা ব্যবসায়ীকে আলেম সাজিয়ে একজন বিপথগামী শহিদুল্লাহ দ্বারা মাদরাসা শিক্ষাকে স্তব্ধ করে দিতে চাচ্ছে। অথচ গতপরশু নাফ বৃহত্তর ছাত্র সংগঠন বিপথগামী শহিদুল্লাহর জীবন বৃত্তান্ত পেশ করে একটি নাতিদীর্ঘ বিবৃতি দিয়েছে। যেখানে স্পষ্ট করা হয়েছে যে, শহিদুল্লাহ আলেম নন এবং কোনো ভালো মানুষও নন।
তবে প্রতিবেদনে শহীদুল্লাহ ও তার ব্যবসায়ী পার্টনারের ভিডিওতে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় হলো, প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে হতে পারে শহিদুল্লাহ হাতে নাতে ধরা খাওয়ার পর শহিদুল্লাহর মাধ্যমে মসজিদ, মাদরাসা, আলেমদের বিতর্কিত করতে নাটকের স্ক্রিপ্ট সাজিয়ে মিডিয়া ও প্রশাসনের যোগসাজসে শহীদুল্লাহকে দিয়ে জোরপূর্বক নামাজ পড়িয়ে ভিডিওটি নাটকের মতই ধারণ করা হয়েছে।
যে নাটকটি উপস্থাপন করতে শহিদুল্লাহ ও তার সহযোগী ছিল বাধ্য। কিন্তু চিত্রনাট্যে অদক্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীর পারফরমেন্স পোক্ত না হওয়ায় ভিডিওর গল্পটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এগুলো স্পষ্টতই মিডিয়া তার গন্ডি ডিঙ্গিয়ে, আদর্শ পায়ে মাড়িয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মাদরাসা, মসজিদ, আলেম উলামাদের সমাজে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করার সুদূরপ্রসারী চক্রান্তের অংশ হিসেবে করছে। হাতে হাতে প্রযুক্তি, ইন্টারনেট, ভিডিও ডিভাইস ব্যবহারের বহুবিধ সুবিধা থাকার এই যুগেও কিভাবে এমন একটি প্রশ্নবিদ্ধ ভিডিও দিয়ে হিংসাত্বকভাবে নেতিবাচক ধারায় প্রতিবেদন করে এমন প্রশ্ন রেখে মানুষ চরম ক্ষিপ্ত হয়েছে।
মিডিয়া দুটি আলেম উলামা ও কওমী মাদরাসাকে বিতর্কিত করতে এর আগেও বহুবার ইচ্ছাকৃতভাবে মনগড়া প্রতিবেদন করেছে। ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা আহমদ শফীর একটি বয়ানের ভিডিও পূর্বাপর কোনো অংশ না রেখে একটি খন্ডচিত্র দিয়ে এই মিডিয়া দুটি বিজ্ঞাপনের ন্যায় যত্রতত্র প্রচার করেছিল। হেফজতের আমীরকে নারী বিদ্বেষী তকমা দিয়ে সমাজে হেয় করার বন্দোবস্তও করেছিল।
সুতরাং তথ্য প্রযুক্তির সীমাহীন অবাধ ব্যবহারের এই যুগে এমন বানোয়াট চিত্রনাট্য ও গল্প সাজিয়ে তথ্য সন্ত্রাসী করে একজনের দায় অন্যের উপরে চাপিয়ে দিয়ে কোনো নিরীহ, নির্দোষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠির সর্বনাশ ও কলঙ্ক থেকে যদি মিডিয়া ফিরে না আসে, তাহলে সে দেশের কোনো নিরাপরাধ ব্যক্তি বা গোষ্ঠিই কখনোই নিজেকে হেফাজত ও নির্দোষ সাব্যস্ত করতে পারবে না।
জনগনের জান মাল, ইজ্জত আব্রু নিরপত্বা দিতে অবশ্যই প্রথমে মিডিয়াকে হলুদ সাংবাদিকতা থেকে বেরিয়ে কলুষহীন হতে হবে।
আরো পড়ুন- ইয়াবাসহ আটক শহিদুল্লাহ পটিয়ার ছাত্র নয়: আল্লামা আবু তাহের নদভী