হাওলাদার জহিরুল ইসলাম
আওয়ার ইসলাম
বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফকের সিলেবাস থেকে মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া রহ. লিখিত ‘দেওবন্দ আন্দোলন ইতিহাস ঐতিহ্য অবদান’ নামক বইটি স্থগিত করার ঘোষণায় আলোচনা চলছে সর্বত্র। সোশ্যাল মিডিয়ায়ও পক্ষে বিপক্ষে মতামত ব্যক্ত করছেন বহু তরুণ, শিক্ষার্থী।
জানা যায়, বেফাকের সিলেবাস কমিটির এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বইটিতে তথ্যগত ভুল রয়েছে এমন অভিযোগ এনে এর স্থলে ‘তারিখে দারুল উলুম দেওবন্দ’ নামের আরেকটি উর্দু বই সিলেবাসে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত হয়।
মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া লিখিত বইটি ১৯৯৮ সাল থেকে কওমি মাদরাসার ফজিলত শ্রেণিতে পড়ানো হচ্ছি। সে সময় তিনি বেফাকের সহকারী মহাসচিব ছিলেন। গতবছর তার ইন্তেকাল হয়।
বইটি সিলেবাস থেকে পরিবর্তনের ফলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া চলছে। অনেকেই এ পরিবর্তনকে ভালো চোখে দেখেননি। তাদের অভিমত ২০ বছর ধরে পড়ানো একটা বইয়ে হাঠাৎ করে তথ্য ভুলের অভিযোগ এনে তা সরিয়ে ফেলার মধ্যে অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
তবে অনেকেই এ সিদ্ধান্তের পক্ষাবলম্বন করে বলেছেন, বইটি অনেক কঠিন করে লেখায় শিক্ষার্থীদের বুঝতে সমস্যা হতো। এ কারণে পরিবর্তন জরুরি ছিল। তারা বলছেন, শিক্ষার্থীদের এমন অভিযোগের ফলেই মুরব্বিরা এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন।
তবে বইটি বেফাকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়েও পাওয়া গেছে ভিন্নরকম তথ্য। এ বইটি সিলেবাসভুক্ত হওয়ার আগে একই নামে একই ইতিহাসের আরেকটি ভিন্ন বই পড়ানো হতো। সেটি ড. মাওলানা মুশতাক আহমদের। কোনো প্রকার অভিযোগ ছাড়াই ড. মাওলানা মুশতাক আহমদের বই বাতিল করে মাওলানা আবুল ফাতাহ ইয়াহইয়া’র বই অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এটিও আসছে আলোচনায়।
বিষয়গুলো বোদ্ধাজনরা কিভাবে দেখছেন জানার জন্য যোগাযোগ করা হয় বিদগ্ধ ইসলামি লেখক ও গবেষেক মাওলানা উবাইদুর রহমান নদভির সঙ্গে। বইটির স্থগিত হওয়া বিষয়ে তিনি বলেন, সিলেবাসে পরিবর্তন পরিবর্ধন হতে পারে। মুরব্বিরা চাইলে সেটা করতে পারেন।
তিনি বলেন, কোন বই রাখা বা বাদ দেয়ার বিষয়ে বেফাকের অধিকার রয়েছে। বেফাক কারো একক সম্পদ বা প্রতিষ্ঠান নয়। বরং এটা জাতীয় ইলমি প্রতিষ্ঠান। তারা ভালোর জন্যও যদি কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন তাহলে তার কারণটা সবার সামনে স্পষ্ট থাকা দরকার। বেফাক কোন সিদ্ধান্ত নিলে সে বিষয়ে কওমি আলেম শিক্ষার্থী অভিভাবক সবার জানার অধিকার আছে। বেফাকের যে কোন সিদ্ধান্তিই বাস্তবভিত্তিক হওয়া চাই।
তিনি দাবি করেন, মাওলানা আবুল ফাতাহর বই বাদ দেয়া হলে তার কারণও সবার সামনে তুলে ধরা দরকার।
বইটি সংশোধন হয়ে আসতে পারে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, যদি বইটি সংশোধন হলে সমস্যার সমাধান হয়ে যায় তাহলে সংশোধন হওয়াই শ্রেয়।
শোনা যাচ্ছে, দেওবন্দ অান্দোলনের পরিবর্তে ‘তারিখে দারুল উলুম দেওবন্দ’ পড়ানো হবে?
এটা যদি পড়ানো হয় তাহলে দোষের কিছু নেই। বরং আমি মনে করি বইটি আন্তর্জাতিক মানের হওয়ায় তা পড়ানো যেতেই পারে।
তারিখে দারুল উলুম দেওবন্দ’ বইটি তো উর্দুতে লেখা। সে ক্ষেত্রে কোন সমস্যা মনে করেন কিনা?
না, এখানে সমস্যার কোন বিষয় নেই। কওমি মাদরাসায় উর্দু বাংলা বলে কিছু নেই। যা উপুযুক্ত ও সমৃদ্ধ তাই পাড়ানো যেতে পারে। আর উর্দু থেকে বাংলায় অনুবাদ করতেই বা কতোক্ষণ?
আলোচিত বইটির বিষয়ে আরেক আলেম শাইখুল হাদিস ড. মাওলানা মুশতাক আহমদের মতামত জানতে চাইলে তিনি আওয়ার ইসলামকে বলেন, বইটি তো ভালই ছিলো। এটি পাঠ্যবই হিসাবে কোনো সমস্যা ছিল না।
আমি এখনও সুপারিশ করছি, বইটি পাঠ্যবই হিসাবে অপরিবর্তিত থাকুক। তবে কারো দৃষ্টিতে যদি কোনো আপত্তি আছে বলে মনে করা হয় কিংবা সেখানে তথ্যগত কোনো ভুল আছে বলে সন্দেহ থাকে তাহলে নির্ভরযোগ্য আলিমগণের সমন্নয়ে একটি সম্পাদনা কমিটি গঠন করে তা যথাযথ সম্পাদনা করে নেয়া যায়। এ কারণে বইটি পাঠ্য থেকে অহেতুক সরিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হয় না।
বইটির সাহিত্য মান সম্পর্কে ড. মুশতাক আহমদ বলেন, মাওলানা আবুল ফাতাহর লেখা অত্যন্ত মানসম্পন্ন। এটাকে নিম্মমান কিংবা মধ্যমমান বললে অবিচার হবে।
উর্দু ভাষায় লিখিত ‘ তারিখে দারুল উলুম দেওবন্দ’ পড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, তারিখে দারুল উলূম দেওবন্দ শীর্ষক গ্রন্থ আমি পড়েছি। বইটির তো বিষয়বস্তুই ভিন্ন। এটা তারিখ; তাহরিক নয়। উভয়ের মধ্যে আসমান জমিন পার্থক্য।
আমি যতদূর জানি, বেফাকে যেই জিনিসটি পাঠ্য করা হয়েছে সেটা হল তাহরিকে দেওবন্দ; তারিখে দেওবন্দ নয়। তাহরিকে দেওবন্দ বা দেওবন্দ আন্দোলন হল একটা বিশেষ দর্শন ও চিন্তাধারার নাম; যা ইতিপূর্ব থেকে চলে আসা এক দীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে আছে। পক্ষান্তরে তারিখে দেওবন্দ হল দেওবন্দ মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হওয়া ও হওয়ার পর একাডেমিক বিভিন্ন কার্যক্রমের ইতিহাস। আমার মনে হয় কোনো অজ্ঞাত কারণে এখানে ‘তাহরিক’ আর ‘তারিখ’ শব্দের মধ্যে গোলমাল পাকিয়ে ফেলা হয়েছে।
আমরা জানি দেওবন্দ আন্দোলন বিষয়ে আপনার লিখিত একটি বই মেশকাত জামাতে পড়ানো হতো। সেটা কেন সরানো হলো? এ বিষয়ে আপনার মতামত কি? হ্যাঁ, আমার লেখা ‘দারুল উলূম দেওবন্দ আন্দোলন ইতিহাস ঐতিহ্য অবদান’ নামে একটি বই বেফাকের নেসাবভুক্ত ছিলো৷ বইটি ৫/৬ বছর মেশকাত জামাতে পড়ানো হয়৷ কিন্তু হঠাৎ আমার বইটি বেফাকের নেসাব থেকে বাদ দেয়া হয়৷
কী কারণে তারা বাদ দিয়েছেন তা আমি জানি না। তবে এতটুকু জানি, তখন আমার বন্ধু মাওলানা আবুল ফাতাহ বেফাকের উচ্চ দায়িত্বে ছিলেন। তিনি নেসাব ও পাঠ্যবই ইত্যাদি ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতেন। তার প্রতি অনুগতদের সবিশেষ সম্মানবোধের কারণে হয়তো আমার বইটি সেখান থেকে ছিটকে পড়ে গিয়েছে। তদস্থলে তার রচিত বইটি স্থান পেয়েছে। যাক তা নিয়ে আমার কোন দুঃখবোধ নেই।
তিনি আরও বলেন, বইটি থেকে আমি বছর বছর কিছু টাকা পেতাম, সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। আমি এই টাকা পাবো কোন স্বার্থে, আমি তো বেফাকের কোন কর্তাব্যক্তি নই। এখন সেই টাকা আমার এক ভাই পাচ্ছেন, তাতে মন্দ কি আছে।
আপনার লিখিত ‘তাহরীকে দেওবন্দ’ বইটি কি আপনি নিজ থেকে লিখেছিলেন না বেফাকের অনুরোধে? এ প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি তখন পিএইচডি করছিলাম৷ গবেষণা কর্মের অনেক চাপ থাকা সত্তেও বেফাকের মহাসচিব মাওলানা আবদুল জাব্বার জাহানাবাদী, হযরত মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী, মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদসহ বেফাকের সে সময়ের নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে বার বার আমাকে বলা হলে আমি এই বই লিখি। তখন তাহরীকে দেওবন্দ এই শিরোনামে কোন বই না বাংলা ভাষায় ছিল না। আমি আমার গবেষণা কায়দায় শত শত বই পড়ে, ব্যাপক ঘাটাঘাটি করে এটাকে সাজিয়েছি।
আপত্তি করা হয় যে, মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া রচিত বই চিন্তাধারার ক্ষেত্রে দেওবন্দ চিন্তাধারাকে প্রতিনিধিত্ব করে না। কথাটি কি সত্য?
এ বইটিই আগে পাঠ্য ছিল
ড. মুশতাক আহমদ বলেন, আসলে এটা তো একটি জটিল প্রশ্ন। মাওলানা আবুল ফাতাহ রচিত বইকে কোনো কোনো সচেতন ও দার্শনিক আলিম দর্শনগতভাবে দেওবন্দ দর্শনকে প্রতিনিধিত্ব করে না বলে যে মন্তব্য করে থাকেন- সেটার যথার্থতা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। চিন্তাধারার ক্ষেত্রে এখানে লীগ মানসিকতার বেশী প্রতিফলন পাওয়া যায়। যাক এগুলি উপযুক্ত সম্পাদনার দ্বারা অবশ্যই সংশোধন যোগ্য।
দেওবন্দ আন্দোলন সম্পর্কে জানার জন্য একজন শিক্ষার্থীর কী কী বই জরুরিভাবে পড়া দরকার জানতে চাইলে ড. মুশতাক আহমদ বলেন, দেওবন্দ আন্দোলন কোনো রাজনীতির আন্দোলন নয়, রাজন্যবর্গের ইতিহাস জানার আন্দোলনও নয়। এ হলো ইসলামের সম্পূর্ণ একটি তাজদিদ ও সংস্কার আন্দোলন।
যুগে যুগে সমাজের আমূল সংস্কারকার্যের জন্য মুজাদ্দিদীন যা করে গিয়েছেন এবং প্রত্যেক যুগে তাজদিদ ও এহইয়ায়ে দীনের স্বার্থে যা যা দরকার সেটা শিক্ষা হোক, দাওয়াত হোক, তাযকিয়্যা হোক, রদ্দে বাতিল হোক, জালিম শাহির বিরুদ্ধে জিহাদ হোক সবই হল দেওবন্দ আন্দোলনের মূল ও মূখ্য বিষয়।
তিনি বলেন, সামগ্রিকভাবে দেওবন্দ আন্দোলনকে বুঝতে হলে কয়েকটি কিতাব বুঝতে হবে। যেমন মুজাদ্দিদে আলফে সানির মাকতুবাত, শাহ ওয়ালিউল্লাহর হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, শাহ আবদুল আজিজের ফতওয়ায়ে দারুল হারবসহ মুজাহিদীনে বালাকোট, উলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাযি, মুসলমানুকা রওশন মুস্তাকবিল, উলামায়ে হক আউর উনকে মুজাহিদানা কারনামে, সাওয়ানিহে কাসেমি, তাযকিরাতুর রশিদ, তাযকিরাতুল খলিল, নকশে হায়াত, তাহরিকে রেশমি খুতুত, তারিখে দারুল উলূম দেওবন্দ, হামারে হিন্দস্তানী মুসলমান, বিস বড়ে মুসলমান ইত্যাদি বই পড়া জরুরি।
বেফাকের সিলেবাস থেকে মাওলানা আবুল ফাতাহ রহ.’র বই স্থগিত
বেফাকের পদ স্থগিত নিয়ে মুফতি ফয়জুল করীমের তীব্র প্রতিক্রিয়া
-আরআর