দারুল উলুম দেওবন্দ। পৃথিবীর মানচিত্রে শিক্ষা সংস্কৃতি আদর্শে মদিনার নবীর জীবন্ত কাফেলা। বিশ্বব্যাপী বিশুদ্ধ আকিদাকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কেন্দ্র। পৃথিবীর আর কোনো শিক্ষাব্যবস্থাতেই এমন নজির নেই যে, একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট একটি ধারাবাহিকতা রক্ষা করে পরিচালিত হচ্ছে পুরো শিক্ষাব্যবস্থা। দারুল উলুম দেওবন্দ এক্ষেত্রে পৃথিবীর একমাত্র নজির।
জ্ঞান ও আধ্যাত্মিতকার এমন একটি কেন্দ্রের প্রতি জ্ঞানপিপাসুদের বাড়তি টান থাকা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখজনক হলো, পৃথিবীর অন্যান্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা পর্যাপ্ত ছাড় ও আইনি শিথিলতা থাকলেও দারুল উলুম দেওবন্দের ব্যাপারে উল্টো কঠোরতা দেখানো হয়ে থাকে বরাবর।
তবু শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সেখানে পড়াশোনা করতে যান। তাদের জ্ঞানের পিপাসা নিবারণ করেন। কিন্তু সম্প্রতি ভারত সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোরতা আরোপ করা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে!
দারুল উলুমে পড়াশোনার আইনি প্রক্রিয়া, সংকট ও সমাধান নিয়ে জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া সাতমসজিদ মাদরাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা মামুনুল হকের সঙ্গে কথা বলেছেন আওয়ার ইসলাম নিউজরুম এডিটর সুলাইমান সাদী।
আওয়ার ইসলাম : দারুল উলুম দেওবন্দে পড়ালেখা করতে যেতে শিক্ষার্থীরা কী ধরনের আইনি জটিলতার সম্মুখীন হয়ে থাকেন? এ থেকে উত্তরণের কি কোনো পথ আছে বলে আপনি মনে করেন?
মাওলানা মামুনুল হক : বর্তমানে দুনিয়াব্যাপী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে যাওয়ার নিয়মতান্ত্রিক যে পন্থা সমাদৃত, দারুল উলুম দেওবন্দের ক্ষেত্রে সেটা নেই। দারুল উলুম দেওবন্দে পড়তে দেয়ার জন্য ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ভিসা অনুমোদনের কোনো নিয়ম আমাদের জানা নেই।
খুবই জটিল একটা ব্যবস্থাপনা। কেউ কেউ হয়ত ব্যক্তিগতভাবে সাময়িক ভিসা নিয়ে সেখানে পড়াশোনা করে। তাদের জন্য এ পরিস্থিতিটা খুবই কঠিন এবং অনেক ক্ষেত্রে খুবই বিব্রতকর। বাংলাদেশ সরকারের উচিত ভারত সরকারের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলা।
কারণ সেখানে পড়তে যাওয়া বাংলাদেশের নাগরিকের সংখ্যা অনেক। আমাদের কওমি মাদরাসা প্রাণকেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দ। বিশ্বব্যাপী কওমি শিক্ষার্থীদেরই সেখানে পড়তে যাওয়ার একটা ব্যাপক চাহিদা ও টান আছে। তাই এ ব্যাপারে দুদেশেরে সরকারেরই আন্তরিকভাবে কথা বলা দরকার।
আওয়ার ইসলাম : কওমি মাদরাসার বোর্ডগুলোর মম্মিলিত সংস্থা আল হায়আতুল উলয়া বাংলাদেশকে সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে। হাইআতুল উলয়া কি সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো সমঝোতা বা সমাধানে যেতে পারে? আপনি কী মনে করেন?
মাওলানা মামুনুল হক : হ্যাঁ, হাইআতুল উলয়া এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সাহায্যে ভারতের উচ্চমহলের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। তারা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটা সুন্দর সমাধানে যেতে পারে।
আওয়ার ইসলাম : দারুল উলুম দেওবন্দে পড়তে যাওয়ার অনুমতির ক্ষেত্রে হাইআতুল উলয়ার সনদ কতটা গ্রহণযোগ্য ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন?
মাওলানা মামুনুল হক : হাইআতুল উলয়ার সনদের গ্রহণযোগ্যতা বিচারের আগে দেখতে হবে ভারত সরকার বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের দেওবন্দে পড়তে যেতে দেবে কিনা? যদি দেয় তাহলে দ্বিতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন বা সনদের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন উঠবে। আমার মনে হয় প্রথম দাবি হওয়া উচিত ভারত সরকারের অনুমতি নেয়া।
আওয়ার ইসলাম : দেওবন্দে পড়াশোনা করতে পারার দাবিতে আপনারা মানববন্ধন ডেকেছেন, কী কী দাবি থাকবে সেখানে আপনাদের?
মাওলানা মামুনুল হক : সারা পৃথিবীতেই শিক্ষার দুয়ার উন্মুক্ত। পৃথিবীর যে কোনো দেশে এমন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকা সে দেশের জন্য গৌরবের বিষয়। আল আজহারকে নিয়ে মিশর গর্ব করে, অক্সফোর্ডকে নিয়ে আমেরিকা গর্ব করে। ভারতের জন্যও গৌরবের জায়গাটা হলো দারুল উলুম দেওবন্দ। ভারত সরকারের নিজেদের সুনামের জন্য হলেও সেখানে সারা পৃথিবী থেকে শিক্ষার্থীদের আসতে দেয়া, পড়াশোনা করতে দেয়া উচিত।
আমাদের দাবি থাকবে, পুরো পৃথিবীর জন্যই যেন ভারতে, বিশেষ করে দারুল উলুম দেওবন্দে শিক্ষা গ্রহণের দুয়ার খুলে দেযা হয়। সেইসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের কাছেও আমরা দাবি করব, দারুল উলুম দেওবন্দে শিক্ষা গ্রহণেচ্ছু বিপুল শিক্ষার্থীদের জন্য যেন সুন্দর একটি ব্যবস্থা করা হয়।
আওয়ার ইসলাম : নিয়মতান্ত্রিক কোনো ব্যবস্থা না থাক সত্ত্বেও বাংলাদেশ থেকে শিক্ষার্থীরা দারুল উলুমে পড়তে যাচ্ছেন, এ বিষয়ে আপনার কাছে যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে কী?
মাওলানা মামুনুল হক : এক্ষেত্রে শিক্ষা গ্রহণের যে অভিপ্রায় সেটাকে সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখার কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষা একজন শিক্ষার্থীর মৌলিক অধিকার। এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করা কোনো দেশ বা জাতির জন্যই উচিত নয়। এ ক্ষেত্রে আমার মনে হয়, নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা যারা রাখতে পারেনি দায়টা তাদের। সংশ্লিষ্ট দেশ বা রাষ্ট্রর পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের পরও যদি শিক্ষার্থীরা নিয়মতান্ত্রিকতার ভেতরে না আসে তাহলে আমরা শিক্ষার্থীদের দোষারোপ করতে পারি।
আওয়ার ইসলাম : অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশ থেকে শিক্ষার্থীরা দারুল উলুম দেওবন্দে পড়তে যাচ্ছেন আবার ফিরে আসছেন, কখনও কোনো অপ্রীতিকর কিছু ঘটেনি। কিন্তু এবার হঠাৎ দেওবন্দ ফেরত শিক্ষার্থীদের আটক করা হলো। বিষয়টাকে আপনি কোন দৃষ্টি থেকে দেখছেন?
মাওলানা মামুনুল হক : এ সম্পর্কে মন্তব্য করতে চাই না। মন্তব্য করার জন্য আমাদের আরো সময় নেয়া দরকার মনে করি। হতে পারে, যারা গ্রেফতার হয়েছে তাদের ভিসাগত কোনো জটিলতা থাকতে পারে। অথবা তাদের আটক করে মিডিয়ার সামনে আনার পেছনে অন্য কোনো কারণও থাকতে পারে। বিষয়টি নিয়ে আমরা পযবেক্ষণ করছি।
আশা করছি, তাদের এ সমস্যা কেটে উঠবে এবং সম্মানজনকভাবে তারা ফিরে আসবে।
আওয়ার ইসলাম : এ মুহূর্তে তাদের মুক্তির ব্যাপারে উলামায়ে কেরাম বা সরকারের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কী উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
মাওলানা মামুনুল হক : এটা আসলে উলামায়ে কেরামের দায়িত্ব না। এটা সরকারি আইনগত একটা বিষয়। তবে উলামায়ে কেরাম যেহেতু তাদের অভিভাবক তাই ভারতীয় আইনি প্রক্রিয়ার অধীনে তাদের মুক্তির ব্যাপারে তদবির করার ক্ষেত্রে তারা গ্রেফতারকৃতদের পরিবারকে সাহায্য করতে পারে এবং বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাস ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাহায্যে তাদের মুক্তির বিষয়টি এগিয়ে নিতে পারে।
আওয়ার ইসলামকে : সময় দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
মাওলানা মামুনুল হক : আওয়ার ইসলামের প্রতিও কৃতজ্ঞতা ও শুভ কামনা।
দেওবন্দে পড়ার ন্যায্য দাবীতে মাঠে নামছেন আলেমরা
ত্রিপুরায় গ্রেফতার ২৪ শিক্ষার্থী মুক্তি পায়নি; আখাউড়ায় আটকদের জামিন
-আরআর