শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


পবিত্র শবেবরাত : করণীয় বর্জনীয়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি ইমদাদুল হক ফয়েজি: লাইলাতুন্নিসফি মিন শা’বান। অর্থাৎ মধ্য শা’বানের রাত। আরেকটু সহজ ভাষায় চৌদ্দ শা’বান দিবাগত রাত। যা আমাদের পরিভাষায় ‘শবে বরাত' বা ‘লাইলাতুল বারাআত’ তথা মুক্তির রাত। কুরআন–হাদীসে ‘বারাআত’ শব্দের উল্লেখ না থাকলেও সম্বন্ধের কারণ সম্ভবত নাসূল সা. এর হাদীস।

নবীজী সা. ইরশাদ করনে, আল্লাহ তা’য়ালা অর্ধশা’বানের রাতে সৃষ্টির দিতে (করুনার) দৃষ্টি করেন। মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষনকারী ব্যতিত সকলকে ক্ষমা করে দেন।' (ইবনে হিব্বান-৫৬৬৫)

হাদীস থেকে বুঝা যায়, আল্লাহ তা’য়ালা দু’ প্রকার মানুষ ছাড়া সকলকে ক্ষমা দেন। অন্যভাবে বললে-দোযখ ও শাস্তি থেকে মুক্তি দেন। হতে পারে ইহাই নামকরনের স্বার্থকতা। আর এ কারনেই বলা হয় ‘শবে বরাত’ বা ‘লাইলাতুল বারাআত’ তথা মুক্তির রাত।

আমাদের কেউ কেউ এ রাতের ফযিলত একেবারেই অস্বীকার করেন। আবার কেউ কেউ ইবাদাতের নামে মনগড়া পথ ও পদ্ধতির অনুসরণ করেন, যা ইবাদাতের পরিবর্তে বিদ’আতে রুপ নেয়। অস্বীকার কিংবা মনগড়া ইবাদাত কোনোটিই কাম্য নয়। শরীয়ত যা যেভাবে নির্দেশ করেছে তা হুবহু সেভাবে পালন করাই ইবাদাত এবং শরিয়তের চাহিদা। এতে কম-বেশি করার কোনো প্রকার সুযোগ বা অবকাশ নেই।

শা’বান মাস রামাদ্বানের প্রস্তুতি গ্রহনের সময়। এ মাসের ফযিলত বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। শা’বান মাসে রাসূল স. অধিক হারে রোযা রাখতেন।উম্মতকেও এর ওপর উৎসাহিত করেছেন।

উম্মুল মুুমিনিন হযরত আয়েশা রা. বলেন, 'আমি রাসূল স. কে কখনও রামাদ্বান ছাড়া পূর্ণ কোনো মাসে রোযা রাখতে দেখিনি। শা’বান মাসে তিনি অধিক পরিমানে রোযা রাখতেন। বছরের অন্য কোনো মাসে এরূপ করতেন না।' (বুখারি-১৬৮৬)

হযরত উসামা ইবনে যায়দ রা. নবীজী স. কে শা’বান মাসে অধিক রোযা রাখার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, 'অধিকাংশ মানুষ এ মাসের ব্যাপারে উদাসীন থাকে। অথচ এটি এমন মাস, যে মাসে আল্লাহর কাছে বান্দাদের আমলনামা পেশ করা হয়। আমি চাই আমার আমলনামা এমন অবস্থায় পেশ করা হোক, যখন আমি রোযাদার।' (নাসায়ি-২৩৫৭)

'লাইলাতুল বারাআত’ শব্দ সরাসরি হাদিসে নেই বলে এ রাতের কোনোও মর্যাদা বা ফযিলত নেই, একথা বলা একেবারেই অবান্তর। মধ্য শা’বানের রাত তথা শবে বরাতের ফযিলত সম্পর্কে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যদিও অধিকাংশ হাদীসের সনদ দুর্বল।

এ ব্যাপারে যুুগের অন্যতম শীর্ষ আলেম শায়খুল ইসলাম আল্লামা তকি উসমানী দা.বা. বলেন, 'দশ জন সাহাবী থেকে শবে বরাতের মর্যাদা সম্পর্কে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। অবশ্যই কোনো কোনোটির সনদ দুর্বল। এই সনদগত দুর্বলতার কারণে কেউ বলে দিয়েছেন এ রাতের ফযিলত ভিত্তিহীন।

কিন্তু মুহাদ্দিসগণ ও ফকীহগণের ফয়সালা হলো কোনও একটি হাদিস যদি সনদগত ভাবে দুর্বল হয় অতঃপর বিভিন্ন হাদীস দ্বারা তা সমর্থিত হয় তাহলে এ সমর্থনের কারণে তার দূর্বলতা রহিত হয়ে যায়। সুতরাং শবে বরাতের ফযিলতকে ভিত্তিহীন বলা একটি অকাট্য ভুল।' (নির্বাচিত বয়ান-পৃ. ৯৭ )

উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা রা. বলেন, 'একবার মধ্য শা’বান রাতে রাসূল স. আমার নিকট এসে আবার বের হয়ে গেলেন। আমি তাঁর পেছনে বের হয়ে তাঁকে ‘জান্নাতুল বাক্বি’তে পেলাম। তিনি মুমিনগণ ও শহীদগণের জন্য ইন্তেগফার করছিলেন। রাসূল স. ঘরে ফিরে আমাকে বললেন--হে আয়েশা, আজ মধ্য শা’বানের রাত।

আজ রাত আল্লাহ তা’য়ালার বনু কালব গোত্রের ছাগলের পশমের পরিমান (অধিক সংখ্যক) বান্দাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ তা’য়ালা মুশরিক , হিংসা পোষনকারী, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী, টাখনুর নীচে কাপড় পরিধানকারী পুরুষ, মাতা-পিতার অবাধ্য ও মদপানকারীদেরকে ক্ষমা করবেন না।

অতঃপর রাসূল স. আমাকে বললেন- হে আয়েশা, তুমি কি আজ রাত আমাকে ইবাদাতের অনুমতি দিবে? আয়েশা রা. বলেন, আমি বললাম আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎস্বর্গীত।

রাসূল সা. দাঁড়িয়ে নামায পড়তে লাগলেন। অতঃপর এতো দীর্ঘ সিজদা করলেন যে আমার সন্দেহ হলো তাঁর রুহ মোবারক কবয করা হয়নি তো! আমি উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুল নাড়া দিলাম, তা নড়ে উঠলো। আমি শান্ত ও আনন্দিত হলাম যে, রাসূল সা. জীবিত আছেন।

তিনি সিজদায় এ দু’য়া পড়ছিলেন-(অনুবাদ) আমি আপনার নিকট আপনার শাস্তি থেকে ক্ষমার, আপনার অসন্তুষ্টি থেকে সন্তুষ্টির, আপনার থেকে আপনার (শাস্তি ও পাকড়াও থেকে) আশ্রয় চাই। আপনার সত্ত্বা মহান, আমি আপনার উপযুক্ত প্রশংসা করতে অক্ষম, আপনি এরূপ, যেরুপ আপনি আপনার প্রশংসা করেছেন।

আয়েশা রা. বলেন, আমি রাসূল সা. এর কাছ থেকে এ দু’য়া পড়তে লাগলাম। তিনি বললেন, হে আয়েশা, এ দু’য়া শিখো এবং অন্যদেরকেও শিখিয়ে দাও।'
(বায়হাকি-৩৮৩৩)

হযরত আলী রা. বলেন, রাসূল সা. ইরশাদ করেন, ‘যখন তোমাদের মাঝে মধ্য শা’বানের রাত আসে, তখন তোমরা এ রাতে ইবাদাত করো এবং দিনের বেলা রোযা রাখো।'
(ইবনে মাজাহ-১৩৮০)

পূর্বেও বলা হয়েছে, এ রাতের ফযিলত সম্পর্কিত হাদীসগুলোর কোনো কোনোটি সনদের দিক থেকে দুর্বল। কিন্তু দশজন সাহাবী থেকে বর্ণিত হওয়ায় এবং দুর্বলতা কঠিন না হওয়ার কারণে তা হাসানের স্তরে পৌঁছে গেছে। ফলে ফযিলত অস্বীকার করা যায়না। সুতরাং আমাদের উচিৎ কোনো প্রকার অবজ্ঞা, অবহেলা না করে বাসূল স. এর আমল এর আলোকে মনগড়া ও বাড়াবাড়ি মুক্ত ইবাদাত করা।

হাদীস থেকে রাসুল স. এর আমল স্পষ্ট। যেমন- তিনি একবার মধ্য শা’বানের রাতে মুসলমানদের কবরস্থানে গিয়ে মাগফিরাত কামনা করেছেন। দেখুন, রাসূল সা. থেকে তাঁর দীর্ঘ জীবনে মাত্র একবার এ রাতে কবরস্থানে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। তাও একাকী, সুতরাং আমরা এ রাতে কবর যিয়ারত করতে পারি।

তবে তা প্রতি বছর নয়। আবার দলবদ্ধভাবে যাওয়ার ও কোনো ভিত্তি নেই। বলা বাহুল্য, আমরা যদি প্রতি বছর কবর যিয়ারতের রুটিন করে ফেলি এবং দলবেঁধে
যাই তবে তা ভ্রান্তি এবং মনগড়া বাড়াবাড়ি। আর এরূপ কিছুই বিদ’আত।

রাসূল সা. এর দীর্ঘ নামায সম্পর্কিত হাদীস আমাদের আমলের মাপকাঠি। দেখুন, রাসূল সা. দীর্ঘ নামায পড়েছেন, সিজদা করেছেন কিন্তু তা একাকী এবং নিজঘরে। এছাড়া অন্যান্য রাত্রিতেও রাসূল সা. নফল নামায নিজঘরেই আদায় করেছেন।

সুতরাং আমাদের নফল নামায ও ইবাদাত এরুপ হওয়াই সুন্নাহ'র চাহিদা। স্মরণ রাখতে হবে, নফল নামায আল্লাহর সাথে বান্দার বিশেষ সম্পর্ক স্থাপনের সোপান, যা নির্জনে হওয়াই কাম্য। একথা সবারই জানা যে, রাসূল স. এর কামরার দরজা খুললেই ছিল মসজিদে নববী সা.।

যদি নফল আমল ঘরের চেয়ে মসজিদে করা উত্তম হতো তবে রাসূল সা. কেনো স্থানস্বল্পতা সত্ত্বে এবং মসজিদে নববী পাশে রেখেও নিজঘরে নফল আমল করতেন? আরোও বাড়াবাড়ি হচ্ছে, আমরা অনেকেই এ রাতে তাহাজ্জুদ নামায জামাতের সাথে আদায় করি। অথচ তা কোনোভাবেই প্রমাণিত নয়।

আমাদের ভাবা উচিৎ, আমরা আবেগের বশীভূত হয়ে ইবাদাত মনে করে অনেক কিছুই করি- যা বাস্তবে শরিয়ত বা সুন্নাহ সম্মত নয়। ফলে আমল নামায় পূণ্যের পরিবর্তে পাপ জমা হয়।

আবার ইবাদাতের নামে এমন কিছু কাজ এ রাতে করা হয় যা একবারেই ভিত্তিহীন। যেমন: হালুয়া, শিরনি, আতশবাজি, মোমবাতি প্রজ্জ্বলন, আলোকসজ্জা, গোসল, মৃত্যের রুহ ঘরে আসার ধারণা, বরাতের নামায, আলফিয়া নামায ইত্যাদি। এগুলো কু-সংস্কার এবং বেদ’আত। যা কোনোভাবেই শরীয়ত সমর্থন করেনা বরং জঘন্যতম পাপ।

মধ্য শা’বান রোযা রাখার ব্যাপারে আল্লামা তকী উসমানী দা. বা. বলেন, 'এটাকে রীতিমতো সুন্নত মনে করা ঠিক নয়।

যেহেতু হাদিসটি দুর্বল, তাই কেবল মধ্য শা’বানের কারণে নয় বরং নবীজী স. এ মাসে অধিক রোযা রাখতেন এবং রাখতে উম্মতকেও উৎসাহিত করেছেন এছাড়া প্রতি আরবি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোযা রাখা মুস্তাহাব, উদ্দেশ্যে এগুলো অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া যেতে পারে। যাতে রাসূল সা. এর অন্যান্য হাদীসের ওপর আমলের কারণে পূণ্য অর্জন হয়ে যায়।

আল্লাহ তা'য়ালা আমাদেরকে সঠিকভাবে তথা তাঁর রাসূল সা. এর হাদিসের আলোকে নীরবে, নিভৃতে ইবাদাতের মাধ্যমে মহিমান্বিত এ রজনিকে মূল্যায়ণ করার তাওফিক দান করুন। সকল প্রকার প্রান্তিকতা ও বাড়াবাড়ি থেকে মুক্ত রাখুন। আমীন।।

আরো পড়ুন- শবেবরাতে রাসুল সা. যেভাবে কবর যিয়ারত করতেন

এইচজে


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ