মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১০ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫


রাজীবের মৃত্যু: দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হবে কি?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
কবি, গবেষক ও সাংবাদিক

পাশাপাশি দুই বাসের রেষারেষিতে হাত হারানো তিতুমীর কলেজছাত্র রাজীব হোসেন চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তাকে বাঁচানো গেলো না। সোমবার গভীর রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের চিকিৎসকরা রাজীবকে মৃত ঘোষণা করেন।

৩ এপ্রিল রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সার্ক ফোয়ারার কাছে বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের দুই বাসের রেষারেষিতে হাত হারান ছাত্র রাজীব। দুই বাসের চাপায় তার ডান হাত কনুইয়ের ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

দুর্ঘটনার পরপরই তাকে পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে পরে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে রাজীবের শারীরিক অবস্থার ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছিল। কিন্তু পরে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। বলা যায়, গত কয়েকদিনে তার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি।

দুই বাসের চাপায় রাজীবের হাত হারানোর রেশ কাটতে না কাটতেই ৫ এপ্রিল মর্মান্তিক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন এক নারী। রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় আজিমপুর-আব্দুল্লাহপুর রুটে চলাচলকারী বিকাশ পরিবহনের দুটি বাসের প্রতিযোগিতায় চাপা পড়েন গৃহিণী আয়েশা খাতুন।

মূলত নিজের ৬ বছর বয়সী মেয়েকে বাঁচাতে গিয়েই বাসের নিচে পড়েন আয়েশা খাতুন। চিকিৎসকরা বলছেন, মেরুদণ্ড ভাঙ্গার কারণে আর কখনোই দাঁড়াতে পারবেন না তিনি।

রাজধানীসহ সারাদেশে সড়কপথে পরিবহনগুলোর এক প্রকার নৈরাজ্যে প্রতিদিনই ঝরছে অনেক প্রাণ। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে মোট ৪ হাজার ৯৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ৭ হাজার ৩৯৭ জন। আর আহত হয়েছেন ১৬ হাজার ১৯৩ জন। এর মধ্যে অনেকেই পঙ্গু হয়ে গেছেন।

এত দুর্ঘটনার পরও সড়কপথে নৈরাজ্য থামছে না কেন? এসব দুর্ঘটনায় দোষী চালক দৃষ্টান্তমূলক সাজা পেয়েছেন এমন ঘটনাও যে হাতেগোনা। তাহলে কি সঠিক বিচার না হওয়ায়ই বেপরোয়া হচ্ছেন চালকরা?

বেপরোয়া গাড়িচালকদের খামখেয়ালিতে রাজীব, আয়েশার মতো অঙ্গহানিসহ প্রতিদিন এত মানুষের জীবন রাজপথে ঝরে যাচ্ছে। ভেঙ্গে যাচ্ছে অসংখ্য পরিবারের স্বপ্ন, শান্তি ও স্বচ্ছলতা।

যে শহরে বাসের গড়গতি পায়ে হাঁটার গতির প্রায় সমান, সেই শহরেই রাজিবের মতো জীবন সংগ্রামী, সম্ভাবনাময় তরুণরা বাস চালকের বেপরোয়া প্রতিযোগিতার কারণে জীবন দিচ্ছে অথবা হাত-পা হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করতে বাধ্য হচ্ছে।

বছরের পর বছর ধরে চলছে গণপরিবহণের এই অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা ও মর্মান্তিক জীবনসংহারি ভূমিকা। এ থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় কি সরকারের হাতে নেই? উপায় নিশ্চয়ই আছে। অভাব শুধু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা ও দায়িত্ববোধের।

বলতে চাচ্ছি, দায়িত্বশীল মহলের দায়িত্বহীন আচরণের কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা এবং গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না।

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন অসংখ্য মৃত্যুর মিছিলে দু-একটি মর্মান্তিক ঘটনা চাঞ্চল্যকর হয়ে দাঁড়ায়। গণমাধ্যমের সুবাদে নাগরিক সমাজে তোলপাড় সৃষ্টি করা এসব ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কিছু লোক দেখানো তদন্ত ও ঘোষণা শোনা যায়। কখনো কখনো আদালতের পক্ষ থেকেও নির্দেশনা জারি করা হয়। ব্যাস, এই পর্যন্তই!

কথা আরও আছে, তদন্তের সুপারিশ বা আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব যাদের ওপর তারা বেপরোয়া চালক ও মালিকদের অন্যায্য দাবির পক্ষে তাদের কথা বলতে শোনা যায়।

মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ এবং মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মিশুক মুনীরের মৃত্যুর পর ইতিমধ্যে ৭ বছর পেরিয়ে গেলেও দায়ী ব্যক্তিদের এমন কোনো শাস্তির দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়নি যে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটানোর সাহস আর কেউ করবে না।

মামলার ৬ বছরের মাথায় আদালত তারেক মাসুদের পরিবারকে ৪.৬১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিলেও এখনো সে নির্দেশ বাস্তবায়নের কোনো খবর আছে কি?

বেপরোয়া গাড়ি চালনার কারণে হতাহতের ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তির দু-চারটি দৃষ্টান্ত তৈরি হলে হয়ত দুর্ঘটনার হার অনেক কমিয়ে আনা যেত।

যেখানে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বাসচালকদের কঠোর শাস্তির বিধানের পাশাপাশি বাস মালিকদের ওপর মোটা অংকের ক্ষতিপূরণের আইন করার দাবি করা হচ্ছে, সেখানে সম্প্রতি প্রণীত খসড়া আইনে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য চালকের সর্বোচ্চ ৩ বছরের সাজা, ২৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডের বিধান রাখা কতটা যৌক্তিক?

আইনের এ পরিবর্তনে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আন্দোলনকারিদের দাবিগুলোকে অগ্রাহ্য করে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দাবিকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। সরকারের প্রভাবশালী মহল জনগণের নিরাপত্তার চেয়ে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় বেশি তৎপর থাকার কারণেই গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলা এবং সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না বলেই ধরে নেওয়া যায়।

এমন বাস্তবতায় বলতে বাধ্য হচ্ছি, বছরে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ হরণ, হাজার হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির জন্য দায়ী পরিবহণ চালক ও মালিকদের প্রতি সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের অনৈতিক পক্ষপাতিত্ব বন্ধ করতে হবে।

গণপরিবহনে চাঁদাবাজি ও যাত্রী হয়রানি বন্ধ করতে হবে। একই সাথে যাত্রী ও পথচারীদের সচেতনতা এবং দায়ী চালক-মালিকদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানি অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করি।

soyedfaizul@gmail.com
১৭ এপ্রিল ২০১৮


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ