সোমবার, ০৬ মে ২০২৪ ।। ২৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫


সিরিয়াকে নিয়ে দুই পরাশক্তির মাথাব্যথা বাড়ছেই!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
কবি, গবেষক ও সাংবাদিক

সাম্প্রতিক বাস্তবতা পর্যালোচনায় বলা যায়, সিরিয়াকে কেন্দ্র করে স্নায়ুযুদ্ধের পর এবার বিশ্বের দুই পরাশক্তি রুশ-মার্কিন উত্তেজনা চরমে ওঠেছে।

সোভিয়েত সমাজব্যবস্থার পতনের পর একক পরাশক্তি হিসেবে সাময়িকভাবে পর্যুদস্ত হলেও শিগগিরই নিজের স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্ব-মূর্তিতে আবির্ভূত হয় রাশিয়া। বর্তমানের রাশিয়া গণতন্ত্র ও সোভিয়েততন্ত্রের মিশ্রণÑপুতিনতন্ত্র। যদিও গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্রের এই স্বরূপ নিয়ে সরব আলোচনা চলছে। এই তো সেদিন চতুর্থবারের মতো তিনি একরকম বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে পুতিনতন্ত্রের নজির স্থাপন করেছেন।

অপরদিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বৈরতন্ত্রের দাঁত দেখাচ্ছেন। স্বভাব-চরিত্রে বিষয় বৈশিষ্ট্যে দুজন যে একই জিনিসÑতা বুঝতে কারও বাকি নেই। আসলে দুজনই জাতে মাতাল তালে ঠিক। মার্কিন নির্বাচনে এবং প্রাথমিক সময়ে ওই দুজনের গলায় গলায় দোস্তি দেখেছে গোটা বিশ্ব। তবে কি এটি ছিল দুই পরাশক্তির গতানুগতিক দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে একটি নিপাতনে সিদ্ধ ঘটনা?

হতে পারে, পুতিন চাইছিলেন মার্কিন নেতৃত্বের গতানুগতিকতায় পরিবর্তন। তা হয়েছে। কিন্তু বিপাকে পড়েছেন ট্রাম্প। তার নির্বাচনে গোপন রুশ সহযোগিতার অভিযোগে তদন্ত এখনো চলছে। অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে কপালে দুঃখ আছে!

মার্কিন পরাশক্তির অহমে আঘাত হানতে দিতে চান না বলেই ট্রাম্প সিরিয়ায় দৃশ্যত মার্কিন নীতির পরাজয়ের জন্য দায়ী করেছেন ওবামা-হিলারিকে। কিন্তু যখন সিরীয় সরকারের মধ্যে আরেকবার রাসায়নিক হামলার অভিযোগ ওঠেছিল ট্রাম্প তখন মার্কিন বাহিনীকে সরকারি বিমান ঘাঁটিতে হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এখনকার হামলাটিও সেই হামলার অনুরূপ বলেই গণমাধ্যমে এসেছে।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বলা হয়, ৬ এপ্রিল রাত থেকে ৭ এপ্রিল সকাল পর্যন্ত রাসায়নিক গ্যাস হামলায় অন্তত ৭০ জন নিহত হয়েছে। বাশার বাহিনীর বিষাক্ত সারিন রাসায়নিক গ্যাস হামলায় তারা নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘হোয়াইট হেলমেট’। যদিও সিরিয়া অভিযোগকে ভিত্তিহীন দাবি করেছে। একই সাথে, ঘাঁটিটি মূলত রুশ বাহিনী ব্যবহার করে বলে বার্তা সংস্থার খবরে জানা গেছে।

প্রথমদিকে এ হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করা হয়। মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর সে অভিযোগ অস্বীকার করে। পেন্টাগন জানায়, যুক্তরাষ্ট্র এ সময়ে সিরিয়ায় কোনো বিমান হামলা চালায়নি। এই অস্বীকৃতির পর এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইসরাইলই মূল হামলাকারী। ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র বছরখানেক আগে এ ধরনের একটি হামলা চালিয়েছে।

সিরিয়ার পূর্ব গৌতার বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত দুমায় এ রাসায়নিক হামলায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠেছে গোটা বিশ্ব। এগিয়ে এসেছে মার্কিন মিত্ররা। যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ফ্রান্সসহ যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা এ ঘটনার জন্য সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ ও রাশিয়াকে দায়ী করে কড়া বিবৃতি দিয়েছেন। তারা বলেছেন, তাদের শিক্ষা দেওয়া উচিত।

এ হামলায় প্রাণহানির ঘটনায় উত্তপ্ত হয়েছেন ট্রাম্প। কারণ এটা যতটা না মানবিক তার চেয়েও অধিক সিরিয়ায় রুশ কর্তৃত্বের নিরঙ্কুশ অবস্থানে ধাক্কা দিয়েছে। তাছাড়া সর্বশেষ দৃশ্য ও অদৃশ্য সমঝোতা অনুযায়ী রুশরা মার্কিনিদের কোনো প্রীতি প্রদর্শন করছে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। যে কারণে ট্রাম্পের মাথা গরম। প্রসঙ্গত, সিরিয়ায় যে ভিয়েতনামের মতো সসম্মানে পশ্চাদপসরণের সম্ভাবনাও কম।

ওয়াশিংটন থেকে এএফপি পরিবেশিত খবরে বলা হয়, ট্রাম্প সিরিয়ায় সামরিক শক্তি প্রয়োগের কথা ভাবছেন। তবে এধরনের সামরিক হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে আসছে চীন।

এদিকে দুমায় বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগে প্রাণহানির ঘটনা নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে খসড়া প্রস্তাব দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এর বিরোধিতা করে রাশিয়া। বলা যায়, মুখোমুখি অবস্থানে চলে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের দূত নিক্কি হ্যালি বলেন, ‘নিরাপত্তা পরিষদ এ ঘটনায় কোনো পদক্ষেপ না নিলেও ওয়াশিংটন হামলার জবাব দিতে প্রস্তুত’। তিনি বলেন, নিরাপত্তা পরিষদ তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তারা সিরিয়ার লোকজনকে রক্ষা করতে পারেনি।

এর জবাবে জাতিসংঘে রাশিয়ার দূত ভ্যাসিলি নেবেনজিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে বলেছেন, এমন হামলা হলে যুক্তরাষ্ট্রকে ভয়াবহ পরিণতি বরণ করতে হবে। তবে এদিকে তাদের অন্যায় রাসায়নিক যুদ্ধকে হজম করার জন্য খোদ সিরিয়া সরকার জাতিসংঘের কাছে তদন্ত দল পাঠানোর জন্য আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছে। আর নরম হয়ে আসছে রুশ স্বর।

এমন বাস্তবতায় বলা যায়, সিরিয়া একটি আন্তর্জাতিক যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরব বসন্তের পর যে প্রত্যাশা নিয়ে সিরীয় জনগণ গণতন্ত্র অর্জনের আন্দোলনের সূচনা করেছিল আজ তা বিষবৃক্ষরূপে তাদের জীবনে বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকার রাজনৈতিক উপায়ে জনগণের দাবির মোকাবেলা না করে অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ করায় ব্যথিত হয়ে সেনাবাহিনীর একাংশ স্বপক্ষ ত্যাগ করে। শুরু হয় পক্ষ-বিপক্ষের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ।

রাসায়নিক যুদ্ধের বিরুদ্ধে তথাকথিত গণতন্ত্রের প্রবক্তারা যে লোকদেখানো অশ্রু বিসর্জন করছে তা অস্পষ্ট কিছু নয়। বরং বলা যায়, এ মায়াকান্না মানবতার জন্য নয়, আধিপত্যের প্রতিযোগিতার। তাই বলছি, বন্ধ হোক জনগণের রক্ত নিয়ে এই আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক দাবা খেলা।

আমরা চাই না, সিরিয়াকে কেন্দ্র করে বিশ্বের দুই পরাশক্তি রুশ-মার্কিন উত্তেজনা আরও চরমে ওঠুক এবং বিশ্ববাসী এজন্য কোনো খেসারত দিক।

soyedfaizul@gmail.com
১২ এপ্রিল ২০১৮


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ