সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে আন্দোলনকারীদের একাংশ। আগামী ১৫ এপ্রিলের মধ্যে দাবি মানা না হলে ১৬ এপ্রিল ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচি পালন করা হবে বলেও ঘোষণা এসেছে। ৯ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টায় এদিনের মতো কর্মসূচি শেষ করে এ ঘোষণা দেন আন্দোলনের নতুন মুখপাত্র বিপাশা চৌধুরী।
এর আগে চাকরিতে বর্তমান কোটা পদ্ধতি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্বাসে আন্দোলন ৭ মে পর্যন্ত স্থগিত রাখার ঘোষণা দেন আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আসা কমিটি।কিন্তু ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সরকারের অস্পষ্ট আশ্বাসে’ আন্দোলন স্থগিতের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের একাংশ। আগের কমিটিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন তারা।তাদের এমন সিদ্ধান্তকে দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে স্বাগত জানাই।
এদিকে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলার পর জাবি উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক সংলগ্ন রাস্তায় উপস্থিত হয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলার সময় তিনি বলেন, ৫৬% কোটা আসলেই একটি জাতির জন্য লজ্জাজনক।
এ আন্দোলনে আমাদের সমর্থন আছে, আমরা তোমাদের পাশে আছি। প্রয়োজন হলে তোমাদের সাথে আমরা একসাথে আন্দোলন করব। সাধুবাদ জানাই অধ্যাপক ফারজানা ইসলামকে।
জেনে ভালো লাগছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার ঘটনায় ঢাবি ছাত্রলীগের বিভিন্ন বিভাগ এবং হল ছাত্রলীগের একাধিক নেতা পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। এছাড়া ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অনেক নেতাই কোটা সংস্কার চেয়ে আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন।
সোমবার তারা ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে এবং স্বহস্তে লিখিত দরখাস্তের মাধ্যমে এই পদত্যাগের ঘোষণা দেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান।
আসলে অবাক হচ্ছি এই জেনে যে, কোটা প্রথা বাতিল নয়- সংস্কারের মতো শতভাগ যৌক্তিক দাবির বিরুদ্ধেও কিছু মানুষ অবস্থান নিতে পারে স্বাধীন বাংলাদেশে!
টেলিভিশনে প্রচারিত খবরে ৮ এপ্রিল রাতে দেখেছিলাম- কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও চাকুরিপ্রার্থীদের ওপর পুলিশ আক্রমণ করেছে। কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এটা সাধারণ ব্যাপারই। তারপর অনেকের মতো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু আক্রমণের মাত্রা যে কতটা ভয়ঙ্কর ছিল, কতটা নারকীয় ছিল, তার প্রায় কিছুই রাতের সংবাদ দেখে বুঝতে পারিনি। পরদিন সকালে কিছুটা বুঝেছি একাধিক পত্রিকা পড়ে।
পুলিশ লাঠি দিয়ে নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে। শত শত টিয়ারসেল নিক্ষেপ করেছে। শাহবাগ- চারুকলা-টিএসসি-দোয়েল চত্বর, কার্জন হল... পুরো এলাকা টিয়ারসেলের ধোঁয়ায় মেঘের আকার ধারন করেছিল। রাবার বুলেট দিয়ে গুলি করা হয়েছে।কী বিচিত্র আমার স্বদেশ!
নিপীড়নের শিকার শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে ঢাবির ভিসির বাড়ি আক্রমণে। আন্দোলন বা ক্ষোভ ব্যাকরণ মেনে চললে, এমন হওয়ার কথা নয়। আন্দোলন বা ক্ষোভ যেহেতু ব্যাকরণ মেনে চলে না, তাই ভিসির বাড়ি ভাংচুর হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়।কিন্তু ভিসি বলছেন তাকে এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার উদ্দেশে বাড়িতে আক্রমণ করে ভাংচুর করা হয়েছে!
কথা এখানেই শেষ নয়, সারা রাত ধরে শিক্ষার্থীরা নির্যাতিত-নিপীড়িত হলেও সোমবার সকালে ভিসি হত্যা প্রচেষ্টা মামলার উদ্যোগ নিচ্ছেন বলে শোনা গেল। শিক্ষকরা সারা রাত নীরব থেকে, এদিন সকালে ‘দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র’র প্রতিবাদে মানববন্ধন করতে চেয়েছেন বলেও শোনা গেছে। আচ্ছা, হক কথা বললে বা ন্যায্য দাবি আদায়ে আন্দোলন করলে বুঝি কেউ দেশবিরোধী বা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী হয়ে যায়?
প্রসঙ্গত, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবি অনেক দিনের। সম্প্রতি নতুন উদ্যমে আবারও শুরু হয়েছে ৫ দফা দাবিতে আন্দোলন। মূলত কোটা পদ্ধতি সংস্কার করে ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নিয়ে আসা, কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে শূন্য থাকা পদগুলোয় মেধায় নিয়োগ দেওয়া, কোটায় কোনো ধরনের বিশেষ নিয়োগ পরীক্ষা না নেওয়া, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা এবং চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার না করার ইস্যুতে মাঠে নেমেছেন মেধাবী চাকরিপ্রার্থী আন্দোলনকারীরা।
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে নামা শিক্ষার্থীরা প্রধানত মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে বলে এ নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়াও আছে। যারা আন্দোলনে নামছে, তাদের যুক্তি হলো, সিংহভাগ কোটায় নিয়োগ পেতে পারে না। ৫৬ শতাংশ কোটায় এবং ৪৪ শতাংশ সাধারণ পরীক্ষার্থী থেকে নিয়োগ-এই বিষয়টি মানতে চাইছে না তারা। এতে সরকারি প্রশাসনে অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীরা নিয়োগ পাচ্ছে না বলেই দাবি তাদের। ব্যক্তিগতভাবে তাদের দাবি আমি যৌক্তিক বলেই মনে করছি।
বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এক নির্বাহী আদেশে কোটা পদ্ধতি চালু হওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে তা পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু সেসব পরিবর্তনে কোটা পদ্ধতিকে আরও নেতিবাচক করে তোলা হয়েছে। পিএসসিসহ অনেক বিশেষজ্ঞ মহল বিভিন্ন সময়ে সরকারের কাছে কোটা সংস্কারের সুপারিশ জানালেও এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি।
বলা যায়, বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে কোটা চালু হলেও এখন এই কোটাই যেন প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্যের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে! বাংলাদেশে এখন মোট ৫৬ শতাংশ কোটা রয়েছে। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ৩০ শতাংশ, ১০ শতাংশ নারী, জেলা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পাঁচ শতাংশ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য এক শতাংশ কোটা সংরক্ষিত।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, সরকারি চাকরিতে প্রায় ২৫৮ ধরনের কোটা রয়েছে। কথা হচ্ছে, পৃথিবীর কোথাও স্থায়ীভাবে কোটা পদ্ধতি নেই বলেও ওই গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে। যেসব রাষ্ট্রে কোটা পদ্ধতি চালু রয়েছে, সেখানে নিয়মিতভাবে তা সংস্কারের মাধ্যমে যুগোপযোগী করে তোলা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে তা হয় না কেন?
আর হয় না বলেই নাগরিকদের সুযোগের সমতা নিশ্চিত করার বিষয়ে সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও চাকরি ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতিতে সংবিধান লঙ্ঘনের মতো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বলা যায়, বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে যে কোটা অনুসরণ করা হয়, তা অনেক ক্ষেত্রেই সংবিধানের এই ধারণাগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কোটা পদ্ধতির কারণে নাগরিকের সাংবিধানিক এ অধিকার যথাযথভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে না।
বাংলাদেশ তার সামর্থ্যানুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা ও তার পরিবারকে আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করছে। প্রয়োজনে এটা আরও বর্ধিত কলেবরে মুক্তিযোদ্ধাদের আমৃত্যু সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার সর্বাত্মক প্রয়াস রাষ্ট্র গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু কোটার ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আনুপাতিক হার দেখে মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরীদের কোটা তাদের সন্তান পর্যন্ত বর্ধিত রাখলেই বোধ হয় রাষ্ট্রের সবার জন্য মঙ্গল হতো। চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা নিয়ে যে আপত্তি ওঠছে তা বোধ হয় মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনীদের পর্যন্ত বর্ধিত না হলে উত্থাপিত হওয়ার যৌক্তিকতা থাকত না।
মনে রাখা চাই-কোটার বিরুদ্ধে যৌক্তিক কিছু বললেই কেউ রাজাকার হয়ে যায় না। বরং ‘নাতি কোটা’র মতো রাজনৈতিক কোটা বন্ধ করা উচিত।একই সাথে কোটাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারও বন্ধ করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে আরও বলা যায়, চাকরিতে জেলা কোটাও বর্তমান সময়ে বেশ হাস্যকর শোনায়। দেশের ৬৪ জেলার মানুষের মধ্যে কেউ কারও চেয়ে বেশি সুবিধা পাবে-এটা বোধ হয় এখন আর কাম্য নয়। বলতে চাচ্ছি, জেলা কোটা প্রবর্তনের শুরুর দিকটায় এটা প্রাসঙ্গিক থাকলেও বর্তমান সময়ে এ রীতির বহাল স্বাভাবিক দৃষ্টিতে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। কারণ এখন পিছিয়ে পড়া জেলা বলতে কিছু নেই। এটা বাতিল হয়ে গেলেই কোটাধারীর সংখ্যা কমে ৪৬ হয়ে যাবে। আর সাধারণ শিক্ষার্থী বেড়ে হবে ৫৪।
তবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য এবং পঙ্গু-বিকলাঙ্গদের জন্য কোটা সংরক্ষণ করা যৌক্তিক বলে মনে করি। কেননা, দেশের অন্যান্য মানুষ এবং গোষ্ঠীর তুলনায় এরা সত্যিই আজও পিছিয়ে।
নারী কোটার ক্ষেত্রে এখনও কিছু উচ্চারণ করার সময় আসেনি। কেননা আমাদের মা-বোনদের যারা উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযোগ পান তাদের নানাবিধ প্রতিকূলতা উৎরে তবেই পথ চলতে হয়। অবশ্য সমাজের কেউ কেউ উপহাস করে বলেন, নারীদের জন্য কি না চাকরিতে সুন্দরী কোটাও আছে! যদিও আমরা এমন বাজে মন্তব্য শুনতে চাই না।
আবারও বলছি, কোটা পদ্ধতি অবশ্যই মেধা বিকাশের অন্তরায়। কেননা, জন্ম থেকেই একটি সন্তান যখন জানতে পারে-তার জন্য একটি কোটা সংরক্ষিত আছে; তার জন্য বয়স দু’বছর বেশি থাকবে; কোনো রকম পাস করতে পারলেই চাকরি নিশ্চিত-এমতাবস্থায় একজন ছাত্রের মেধার স্বাভাবিক বিকাশ কখনোই ঘটতে পারে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। আমরা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মেধার স্বাভাবিক বিকাশের উন্মুক্ত পথ চাই।
কোটা সংস্কারের আন্দোলনকারীরা হেরে যাবে না এবং তাদের যৌক্তিক দাবি না মেনে, সরকারের কোনো উপায় নেই বলেই মনে করছি। তাই এ বিষয়ে যত দ্রুত সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হয়, ততই মঙ্গল।
লেখক : কবি, কলামিস্ট ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম
soyedfaizul@gmail.com
১০ এপ্রিল ২০১৮
আরো পড়ুন : মাদকের বিস্তার রোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে
[আওয়ার ইসলাম বৃহত্তর কলেবরে প্রকাশ করতে যাচ্ছে রমজানুল মোবারক সংখ্যা, আপনার মাদরাসা-স্কুল বা কোম্পানির বিজ্ঞাপন দিয়ে সহযোগিতা করুন। আপনার কপি সংগ্রহ করতে ফোন করুন 01717831937 বিকাশ]