বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫


বুদ্ধিজীবীরা ক্ষমতার ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছে: অসীম সাহা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

[কবি অসীম সাহার জন্ম ১৯৪৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। পিতৃপুরুষের ভিটে মানিকগঞ্জ। ১৯৬৫-তে মাধ্যমিক পাশ করার পর মাদারীপুর নাজিমুদ্দিন মহাবিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭-তে উচ্চমাধ্যমিক, ১৯৬৯-এ স্নাতক পাশ করে ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন।

১৯৭১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত পরীক্ষা হবার কথা থাকলেও অসহযোগ আন্দোলন এবং পরে ২৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার ফলে সে-পরীক্ষা আর অনুষ্ঠিত হয়নি। পরে ১৯৭৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

অসীম সাহার লেখালেখি জীবনের শুরু ১৯৬৪ সালে। সাহিত্যের সকল বিষয়ে তুখোড় এই লেখক ঋদ্ধতায় বিশ্বাসী বলে অতিপ্রজ হওয়ার দিকে তাঁর মনোযোগ কম। তাই এত বছরেও তাঁর বইয়ের সংখ্যা মাত্র ৩০টি।

এ-পর্যন্ত প্রকাশিত তাঁর উল্লখযোগ্য বইগুলোর কয়েকটি হচ্ছে : পূর্ব-পৃথিবীর অস্থির জ্যোৎস্নায় (১৯৮২), কালো পালকের নিচে (১৯৮৬), পুনরুদ্ধার (১৯৯২), উদ্বাস্তু (১৯৯৪), মধ্যরাতের প্রতিধ্বনি (২০০১), অন্ধকারে মৃত্যুর উৎসব (২০০৬), মুহূর্তের কবিতা (২০০৬), Refujee and the festval of death in darkness (2010, সৌর-রামায়ণ (২০১১), অক্টাভিও পাস ও ডেরেক ওয়ালকটের কবিতা (অনুবাদ) (২০১১), কবর খুঁড়ছে ইমাম (২০১১), প্রেমপদাবলি (২০১১), পুরনো দিনের ঘাসফুল (২০১২) (কবিতা)।

ষাটের দশকের কবিদের অন্যতম প্রধান এ-পর্যন্ত আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৩), ময়মনসিংহ সাহিত্য-সংস্কৃতি ফোরাম সম্মাননা (২০০৯), সাতক্ষীরা জাতীয় কবিতা পরিষদ কবিসম্মাননা (২০১০), কবিতাবাংলা কবিসম্মাননা (২০১০), বিন্দুবিসর্গ কবিসম্মাননা (২০১১), শৃন্বন্তু কবিসম্মাননা (কোলকাতা) (২০১১), দিকচিহ্ন কবিসম্মাননা (২০১১), কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর কবিসম্মাননা (২০১১) এবং কবিতায় সামগ্রিক অবদানের জন্য বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (২০১১), শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পুরস্কার (২০১২) এবং কবিতালাপ পুরস্কার (২০১২) লাভ করেছেন। -বিডিনিউজ আর্টস]

কবি অসীম সাহার সঙ্গে আসানসোলের ইমাম ইমদাদুল্লাহ রাশিদি ও পৃথিবীব্যাপী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়ে কথা বলেছেন কবি রনজু রাইম

আপনার কাছে জানতে চাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিষয়ে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিপন্ন হচ্ছে সেখানে বিশেষ করে ভারতের আসানসোলের ইমাম সাহেব যে দৃষ্টান্ত রাখলেন এ বিষয়টি তো আপনি মিডিয়ায় দেখেছেন। আমাদের দেশেও কিংবা পার্শ্ববর্তীদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়ে থাকে, রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে। কিন্তু আমরা মানবতাবাদে উজ্জীবিত হয়ে একটা জায়গায় একত্রিত হতে পারি কিনা?

আসলে মানবতাবাদে উজ্জীবিত হয়ে এক জায়গায় দাঁড়াতে হলে আমাদের ধর্মের ব্যঞ্জনাটা বুঝতে হবে। ধর্ম কি কাউকে খুন করতে বলেছে? এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। নিরিহ মানুষদের হত্যা করা হচ্ছে।

আমরা সারা পৃথিবীতেই দেখছি সব সময় সাধারণ মানুষ আক্রান্ত হয়। যে অপরাধী সে কিন্তু আক্রান্ত হচ্ছে না। যারা হয়তো ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন সম্প্রদায়ের, ভিন্ন চিন্তা ও মানসিকতার তারাই আক্রান্ত হচ্ছে।

কিন্তু সমস্যা হলো এসব বন্ধ করার জন্য যারা সত্যিকারার্থে মানবতার জয়গান গাইবেন তারা তো সে ভূমিকা পালন করছেন না।

আজ আমরা যে দৃষ্টান্ত দেখলাম, তিনি তো সাধারণ একজন ইমাম। সাধারণত আমরা যে দৃষ্টান্ত দেখি না। নিজের সন্তান খুন হওয়ার পর ভারতবর্ষসহ গোটা পৃথিবীর মানুষকে অবাক করে দিয়ে তিনি যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন এরকম দৃষ্টান্ত আমার জানা নেই।

তার প্রতি কীভাবে  শ্রদ্ধা জানাবো সত্যিই ভাষা নেই। তবে একটা আশার কথা হলো শুভবুদ্ধির মানুষগণ তাকে স্বাগত জানিয়েছেন। কিন্তু গেরুয়া বেশধারী যারা ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে উস্কে দিচ্ছে তারা কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়ার মধ্যে চলে গেছেন।

আমরা সাম্প্রতিককালে দেখলাম আগরতলায় এ গেরুয়াবাদীদের উত্থান। অথচ সেখানকার মূখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার তিনি কিন্তু সৎ ছিলেন। কিন্তু তার সততা কাজে লাগেনি। তাহলে বোঝা যায় মানুষ ঘুরে যাচ্ছে। মানুষের চিন্তা চেতনা ঘুরে যাচ্ছে। এর একটা বড় কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন।

এই আসানসোলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দল বিজেপি, তৃণমূল, কংগ্রেস পরস্পরকে দোষারোপ করছে। কিন্তু এ ঘটনায় কি রাজনৈতিক দলগুলোর দায় নেই? সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় তাদের কতটুকু ভূমিকা?

রাজনৈতিক দলগুলো সে ভূমিকায় ছিলো কিন্তু এই দোষারোপের রাজনীতি করে সেটাকে গোপন রাখতে চায়। কারণ তারা ক্ষমতায় এলে হয়তো একই ভূমিকা পালন করবে।

আজ তৃণমূল ক্ষমতায় আছে, কিন্তু মুসলিমরা যদি তাদের ভোট না দেয় তাহলে হয়তো সরাসরি ক্ষতি করবে না কিন্তু গোপনে তাদের ক্ষতি করা হবে, উস্কে দেয়া হবে। এটা কিন্তু আরও ভয়ঙ্কর।

কিংবা সিপিএম যাদের আমরা কমিউনিস্ট বলে জানি তারা কি ৩৪ বছরে সেখানে মানুষকে কেন মোটিভেট করতে পারেনি? মানুষের মতভেদকে কেন চেঞ্জ করতে পারেনি? সেখানে ধর্মান্ধ মানুষ বাড়লো কী করে?

এটা বাড়ার কারণেই ৩৪ বছর পর এসে তৃণমূল ক্ষমতায় গেছে। তারাই তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে। সুতরাং এটা হচ্ছে রাজনৈতিক নেতাদের চালাকি। শুধু ভোটের রাজনীতি করলে যা হয়।

অতএব এটা স্পষ্টই বলা যায়, আদর্শিক রাজনীতি কোথাও নাই। আদর্শ বলতে কোনো কিছু আমাদের এ তথাকথিত রাজনৈতিক দলগুলোতে নেই। পুরো বিশ্ব থেকেই আদর্শ উঠে যাচ্ছে।

বিশেষত আমি এ কথা বলতে চাই, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে তাতে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো আগে যা করতো একই প্রক্রিয়ায় ধর্মবাদীদের উস্কে দিয়ে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে।

কিন্তু এ কথা বলে আমরা দায় এড়াতে পারি না যে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো আমাদের উস্কে দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের উস্কে দিলেই আমরা উস্কাবো কেন?

অনেকেই বলেন লাদেনকে আমেরিকা সৃষ্টি করেছে। লাদেনকে তৈরি করতে পারলে আমাকে তোমাকে কেন তৈরি করতে পারে না? লাদেন নিশ্চয়ই সে ফাঁদে পা দিয়েছে। তো সেখানে আমি পা দিচ্ছি কেন- যেখানে অন্যায়, যেখানে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন সেখানে প্রতিবাদের ভাষা কোথায়?

তুমি যেটা বললে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা, লেখক, সাহিত্যক ও সচেতন মানুষরা কোথায়? তাদের কণ্ঠ কোথায়?

আজ যে ইমাম সাহেব নিজের ছেলের রক্তাক্ত দেহ দেখার পরও শান্তির যে বার্তা দিয়ে গেলেন তা কি আমাদের ভেতর কোনো দোলা দেয়নি? এটা কি শুধু ফেসবুকেই সীমাবদ্ধ রাখবো?

আমাদের কোনো বুদ্ধিজীবীকে দেখলাম না তারা এ বিষয়ে একটুও আলোচনা করেছেন। তারা সুযোগ পেলেই এমন সব বিষয় নিয়ে রাস্তায় নামেন এবং টকশো করেন যেটা আমার কাছে কৌতুক মনে হয়। কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের কাজ কৌতুক করা নয়, কৌতুক করার জন্য অন্য লোক আছে।

তার মানে এই বোঝা যাচ্ছে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে যে ভূমিকায় ছিলেন এখন সে ভূমিকায় নেই। তারা ক্ষমতার লোভে, হালুয়া রুটির লোভে ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছে। এবং বিকৃত দাসে পরিণত হয়েছে।

আমাদের দেশে সম্প্রীতি রক্ষায় আমরা কী করবে পারি, এ ব্যাপারে আপনার সুপারিশ কী?

একটা কথা আমি সব জায়গায় বলি, সেটা হলো- মানুষকে সচেতন করা। সচেতন করা মানে কী? চেতনার বিপ্লব যদি আমি করতে না পারি তাহলে কোনো কিছুতেই আমরা সফল হতে পারবো না। আমি বক্তব্য দেবো, মিছিল করবো, সেমিনার করবো কোনো কিছুতেই কোনো কাজ হবে না।

একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে যদি কাজ করতে না পারি, শিশুদের মনন তৈরি করতে না পারি, পরিবার থেকে যদি তাদের সচেতন করতে ব্যর্থ হই, তাহলে বাইরের আবরণ দিয়ে কাজ হবে না।

ধর্ম তো কোনো দোষ করেনি কিন্তু ধর্মকে বোঝার যে অন্ধত্ব সেটি সব ধর্মেই রয়েছে। এ বিষয়টি একটু বলবেন?

ধর্মটা আসলে কী? ধর্ম হলো ধারণ করা। ধারণ করেন যিনি। যিনি কারো না কারো আদর্শ ধারণ করেন। মুসলিমরা হজরত মুহাম্মদ সা. এর আদর্শ ধারণ করেন, হিন্দুরা বেদ-গীতার আদর্শ এবং খ্রিস্টানরা বাইবেলের আদর্শ ধারণ করেন।

অনুসারীরা কি ধর্মকে পূর্ণাঙ্গ পাঠ করেছেন? সেখানে কি পজেটিভ জিনিস নেই? হজরত মুহাম্মদ যে জিহাদের কথা বলেছেন, জিহাদ কাদের বিরুদ্ধে যারা অন্যায়কারী তাদের বিরুদ্ধে। যারা অন্যায় করেনি তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেননি। বরং তাদের রক্ষা করেছেন। এ দৃষ্টান্ত কি আমাদের সামনে নেই?

ধর্মকে বিকৃত করে তাকে ব্যবহার করে কিছু কাজ করা হচ্ছে, যা পৃথিবীর কোনো ধর্মই সাপোর্ট  করে না। এটা মূলত মোনাফা লোটার জন্য করা হচ্ছে। এটা ধর্মের জন্য করা হচ্ছে না।

ধর্মের জন্য যারা কাজ করবেন তারা এ ধরনের কাজ করতে পারেন না।

ভিডিও

-রোরা


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ