শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


শায়খ যাকারিয়া রহ.-এর আমানত পেয়ে ধন্য আমি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ড.মুশতাক আহমাদ
প্রাবন্ধিক ও গবেষক

সামান্য একটি তাসবিহের মালা। ইয়া আল্লাহ! কি চমৎকার এর কারামত! কি তার রহস্য! এটি আমাকে তাড়া দেয়, ভীষণ তাড়া দেয়। আমাকে কঠিন পাহাড় অতিক্রমে বাধ্য করে ফেলে। কী অদ্ভুত! কখনো আমার মন নিস্তেজ দেখলে আমি এটি থেকে ঘ্রাণ নেই।

ব্যস; মন কেন যেন সম্পূর্ণ চঞ্চল হয়ে ওঠে। নতুন উদ্যম শরীরকে চাঙ্গা করে দেয়। অলসতা দূর হয়ে যায়। আমি পাই হিম্মত, সজীবতা, প্রাণবন্ততা, শক্তি আরো অনেক কিছু। অন্যরা এই ঘ্রাণ পায় কিনা তা অবশ্য কাউকে জিজ্ঞেস করিনি; আর জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছাও হয়নি।

সামান্য একটি তাসবিহের মালা। কিন্তু আমার খুব প্রিয় এই তাসবিহ মালা। অনেক দিন থেকে এটি আমি সংরক্ষণে রেখেছি। রেখেছিও খুব যত্নের সাথে। খুব দরকার না হলে বের করি না। দানা গুনতির কাজ অন্য কোনো তাসবিহ দিয়ে সেরে নিই। আর এই তসবিহটি অন্যান্য তাসবিহ থেকে একটু বড় আকৃতির। কারণ কাঠের টুকরা দিয়ে বানানো।

এটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, তসবিহটির মধ্যে একটা চলমান সুঘ্রাণ আছে। হৃদয়কাড়া সুঘ্রাণ। এই ঘ্রাণ যেন আমাকে পাগল করে তোলে। তন্ত্রে তন্ত্রে জাগিয়ে তোলে। হৃদয়ের গভীর পর্যন্ত নাড়া দেয়। তসবিহের এই এক ঝাঁকুনি সকাল থেকে সন্ধা নাগাদ অনুভব হতে থাকে।

তাসবিহটি আমাকে দান করেছেন শায়খ আবদুল হাফিয মক্কী রহ.। আরব আজমের শ্রেষ্ঠতম বুযর্গ। সৌদি আরবের নাগরিক। স্বয়ং পবিত্র হরমে মক্কার বাসিন্দা। বিশ্ব নন্দিত শায়খুল হাদিস যাকারিয়া রহ. এর অতি প্রিয়ভাজন ও অন্যতম খলিফা। হযরত শায়খ যাকারিয়া রহ. তাঁকে গভীর স্নেহ করতেন।

তাঁকে ভালবাসতেন আর এত আস্থা করতেন যে, তাঁকে দিয়েই নিজের সকল ইস্তিখারা করাতেন। নিজের কিংবা অন্যের; কখনো ইস্তিখারা করার প্রয়োজন হলে ডাক পড়তো; শায়খ আবদুল হাফীয কোথায়? হযরত শায়খ বলতেন, আবদুল হাফিয পবিত্র হরমের ছোঁয়ায় লালিত পালিত।

শৈশব থেকে পরম পবিত্র স্থান হরমে মক্কায় অবস্থান করে একই সঙ্গে শরিয়ত তরিকত, তালিম তাযকিয়া, যিকির মুরাকাবা, দাওয়াত ও জিহাদের কাজ অবিরাম চালিয়ে যাওয়ার কারণে আল্লাহ পাক তাঁর কলবের আয়না অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন করে দিয়েছেন। এই ধরনের পরিচ্ছন্ন কলব দ্বারা উর্ধ্ব থেকে উর্ধ্বতর কোনো জিনিসও পরিস্কার নজরে চলে আসে।

শায়খ আবদুল হাফীয মক্কী রহ. আমাকে তাসবিহটি দান করেন হজের সফরে। কুতবুল আলম হযরত নানুপুরী রহ. এর ওফাতের পর আমি হজে যাই। তখন সৌভাগ্যক্রমে তাঁর সাথে আমার দেখা হয়। স্থাপিত হয় হযরত মক্কীর সাথে অধমের নতুন সম্পর্ক।

হযরত শায়খ যাকারিয়াকে আমি আগে থেকেই খুব ভালোবাসতাম। জন্মের পর আব্বাজানের যবানে, আমার মামার যবানে এবং অন্যান্য আত্মীয়ের যবানে কতবার যে সেই নাম ইজ্জতের সাথে শুনে আসছি তার ইয়াত্তা নেই। সেই বুযর্গকে স্বয়ং দেখার সুযোগ হয়নি।

আজ তাঁরই প্রিয় খলিফা; আমার সম্মুখে দেদীপ্যমান; আমি এতিম অভিভাবকহীন; আমার শায়খ নানুপুরী রহ. চলে গেছেন কবর জগতে। আমিও দেরি করলাম না, তিনিও দরখাস্ত করতেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ধরলেন তো ধরলেন, আর ছাড়েন না। আল্লাহু আকবার! কী বিরাট মহাসমুদ্র।রুহানিয়াতের মহাসমুদ্র।

লোকেরা আটলান্টিক দেখেছে কিন্তু কোটি কোটি আটলান্টিক যেখানে দিশেহারা হয়ে যায় সেই মহাসমুদ্র কেউ দেখেনি। সেই মহাসমুদ্র নিজ সীনায় লালন করতেন আরবের এই শায়খ, মালিক শায়খ আবদুল হাফীয আল মক্কী আল হানাফী রহ.।

পরের বছর আবারো আমার হজ্জের সফর। মুরিদ পীরকে আগাম নিজ সফরের সংবাদ দেওয়া সঠিক বলে মনে করেনি। ঠিক জেদ্দা বিমান বন্দরে যখন নামলাম তখন ফোন করে জানালাম, হযরত! আমি এসেছি। আমি এখন জেদ্দায় আছি।

হজ্জে বায়তুল্লাহর জন্য এসেছি। হযরত জবাব দিলেন, বহুত আচ্ছা, বহুত আচ্ছা। কথা হলো অনেক। তাঁর শেষ কথা, আমি তো এখন পাকিস্তানে আছি। আপনার সাথে দেখা হবে ইনশা আল্লাহ আরাফাতের ময়দানে। আমি বললাম, এক ভৃত্য, সান্নিধ্য চায়, যেখানে আদেশ করবেন সেখানেই সে যেতে প্রস্তুত।

তারপর আরাফার দিন ১১ টার সময় আবার ফোন বেজে উঠল শায়খের। শায়খ বলছেন, ড. মুশতাক! আজ আমি খুব ব্যস্ত। ময়দানে উপস্থিত আছি কিন্তু প্রচণ্ড ভীড়ের কারণে আজ আর দেখা হবে না। দেখা হবে ইনশা আল্লাহ হজের পর মক্কা মুকাররমায়।

আমি বললাম, হযরত আমার তো হজের পরপরই মদিনা মুনাওয়ারা রওয়ানা করার কথা। হযরত বললেন, ঠিক আছে। যান। কোনো অসুবিধা নেই, দেখা হবে ইনশা আল্লাহ মদীনা মুনাওয়ারায়।

আমার হজের কাজ শেষ হলো। আমি হজের পরপরই চলে এলাম মদীনা মুনাওয়ারায়।

মদীনা মুনাওয়ারা পৌঁছে আমি অনেকটা ভিন্ন প্রেমের আবহে মাতোয়ারা। এখানে বিছানো আছে দয়াল নবীর প্রেমের আসর। হযরত মক্কীর সেই ফোনের কথাও মনে ছিল না। একদিন কি হলো, রাত তখন ১টা। আমি মসজিদে নববি থেকে যিয়ারত সেরে সবে মাত্র হোটেলে ঢুকলাম।

শোবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল হযরত মক্কী রহ. এর। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এখন কোথায় আছেন? আমি কাতর কণ্ঠে বললাম, হযরত! এইমাত্র মসজিদে নববী থেকে হোটেলে এসেছি। তিনি বললেন, আমি রিয়াজুল জান্নাতে আছি। আপনি এখানে চলে আসুন।

আমি ছুটলাম পাগল পারা। আমাদের হোটেল খানিকটা দূরে ছিল। তাই একটু সময় লেগে গেছে। সেখানে পায়ে হাঁটা ছাড়া আর ভিন্ন কোনো ব্যবস্থাও নেই। আমি বাবুস সালাম দিয়ে প্রবেশ করে সামনে এগুতে থাকি। রিয়াজুল জান্নাহর ক্ষুদ্র এরিয়া আসতেই তাকাতে থাকলাম।

ইয়া আল্লাহ! নিমিষেই দেখলাম, রিয়াজুল জান্নাহর প্রথম সারির ডান দিকে একটি ছোট্ট চেয়ারে বসে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করছেন আরব আজমের এই কুতুব। গোটা রিয়াজুল জান্নাহ ভিন্ন সাজে যেন সজ্জিত। অন্য সময়ে পুলিশ খুব ঝামেলা করত, পথে পথে আটকাতো। আজ কিছুই হচ্ছে না। কেউ আমাকে বাধা দিচ্ছে না। আমি নির্বিঘ্নে সম্মুখ হাঁটতে থাকলাম। আমি আমার হযরতের সান্নিধ্যে পৌঁছে গেলাম।

হযরত আমাকে পেয়ে সিনার সাথে মিলিয়ে ধরলেন। অনেক সময় ধরে রাখলেন। তারপর বললেন, আপনি এখানে বসুন। বসে নিয়ম মতো ‘আল্লাহ’ শব্দের ওজিফা আদায় করতে থাকুন। এ কথা বলে হযরত রওজা পাকের দিকে চলে গেলেন।

হযরত শায়খ মক্কী রহ. দীর্ঘ সময় সেখানে সালাত ও সালাম করলেন। আরো যা যা বলার ছিল শোনার ছিল সবই করলেন। তারপর ফিরে এলেন। আমাকে সামনে বসালেন। পকেট থেকে এই পুরনো দিনের একখানা তাসবিহ বের করলেন।

তারপর বললেন, এই তাসবিহ আমাকে দান করেছেন আমার শায়খ; গোটা দুনিয়ার শায়খ হযরত যাকারিয়া রহ.। এটি ছিল আমার কাছে রক্ষিত তাঁর শ্রেষ্ঠ আমানত। বহু বছর থেকে আমি এই আমানতের হেফাযত করে আসছি। আজ আমি মহান আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে আমার এই আমানত আপনার হাতে সোপর্দ করলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমি আপনাকে হযরত শায়খ যাকারিয়া রহ. ও আমার পক্ষ থেকে তরিকতের ‘ইজাযত ও খেলাফত’ দান করলাম। আমি অনুমতি প্রাপ্ত হয়ে আপনার হাতে এই কর্মভার অর্পণ করলাম।

এবার আপনি যান। নবী আলাইহিস সালাম সমীপে সালাত সালাম পেশ করে আসুন। আমার তখন সারা গাল মুখ সবকিছু চোখের পানিতে ভরে আছে। আমি রুমাল দিয়ে মুখ মুছলাম। উঠে গিয়ে রওযা আহতারে সালাত সালাম পেশ করলাম। সে কী অবস্থা! এ কলম যা বলতে সাহস করে না।

যাক। আমি ফিরে এলাম। দেখলাম, হযরত মক্কী হাত উঠিয়ে ঝারঝার রোনাজারি করছেন। আমি এলাম। তাঁর মুনাজাত শেষ হলো। তিনি আমার দুই হাত শক্ত করে ধরলেন। বললেন, আকাবিরের এই আমানত রক্ষা করতেই হবে; নিজ জীবন উৎসর্গিত করে হলেও। শরিয়ত ও তরিকত দুটি সমান্তরালের পাল্লা। ওজন কমবেশ করার সুযোগ নেই। সুন্নাতের উপর আমল সব সময় ঠিক রাখতে হবে। ইনশা আল্লাহ।

তারপর বললেন, আজ অনেক দিন; আপনাকে একটি আমানত বুঝিয়ে দেয়ার দায়িত্ব ছিল আমার উপর। প্রথমে ভাবলাম, আরাফাতের ময়দানে এ আমানত বুঝিয়ে দিব কিন্তু হলো না। তারপর ভাবলাম হরমে মক্কায় সম্পাদন করব তাও হলো না।

তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম, নবীয়ে পাকের দরবারে, রওযা পাকের সান্নিধ্যে, রিয়াজুল জান্নাতে বসে, দয়াল নবীর সাথে .. এই দায়িত্ব অর্পণ করব। আল্লাহ পাকের শোকর, হযরত শায়খ যাকারিয়া রহ. এর সেই তাসবিহ পরবর্তীর জন্য প্রতিস্থাপিত করার কাজ, আমার বিশ্বাস যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়েছে। আল হামদু লিল্লাহ, ছুম্মা আল হামদু লিল্লাহ।

কেবল এই দায়িত্ব অর্পণের জন্যই আমি সুদূর মক্কা শরিফ থেকে এখানে এসেছি। আমার কাজ শেষ। আমি ফিরে মক্কা শরিফ চলে যাচ্ছি। আপনি ফজর পর্যন্ত রিয়াজুল জান্নাতের এখানে বসে তাসবিহ আদায় করতে থাকুন। আমি বিদায় নিচ্ছি। দুআ করবেন। আল্লাহ আপনার জন্য কল্যাণের ফয়সালা করুন। আমিন!

এসএস

আরো পড়ুন: আন্তর্জাতিক কুরআন প্রতিযোগিতায় মিশরেও প্রথম বাংলাদেশী


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ