বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


আননূর উৎসব; প্রতিভার বর্ণিল মহড়া

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মাদ রাইহান :  জামিয়া গহরপুরের পাশ ধরে চলে গেছে নীরব নিটোল স্রোতের বড়বাঘা নদী। নদী আর মাদরাসার মাঝখানে সটান শুয়ে আছে সুদীর্ঘ উঠোন। উঠোনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ পাকা। বাকিটুকুতে সবুজ ঘাসের শৈল্পিক মহড়া। সুবিস্তৃত এই অংশটুকুতে অমোচনীয়ভাবে সেঁটে থাকে গাঢ় সবুজের বিজ্ঞাপন। যেন ছুঁয়ে দিলেই মুঠো ভরে যাবে সবুজে।

হেঁটে গেলে পায়ে পায়ে লেগে যাবে সবুজের কাচা রঙ। নরোম ঘাসে-মোড়া এই অংশের মধ্যখানে কোনাকুনিভাবে নির্মাণ করা হয়েছে মাঝারি সাইজের তিনটি মঞ্চ। হৃদয়াকর্ষক, দৃষ্টিনন্দন। আঁড়াআঁড়িভাবে নির্মিত মঞ্চে দাঁড়ালে তিনটি ভবন নিয়ে একসঙ্গে চোখে পড়ে পুরো জামিয়া।

মঞ্চের তিনপাশ ঘিরে আঁধারের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে বাহারি রঙের বাতি। অন্ধকার সাড়া দিলেই মঞ্চের গায়ে উপচে পড়বে আলোর ফোয়ারা। মঞ্চের সামনে চেয়ারের সারি। সারিগুলো বেশ লম্বা, অনেকদূর বিস্তৃত।

মঞ্চ থেকে খানিকটা দূরে সুবিন্যস্ত কয়েকটি স্টল। বইয়ের, ফাস্টফুডের, চা-কফির। আন-নূর ছাত্রকাফেলার প্রথম দশকপূর্তি উপলক্ষ্যে এভাবেই ছিলো আননূর উৎসব উদযাপনের প্রস্তুতি।

গহরপুর জামিয়ার ছাত্রদের বহুমাত্রিক প্রতিভা, মেধা ও মননের পরিপূর্ণ বিকাশের লক্ষ্যে ২০০৮ সালের ১৭ নভেম্বর গঠন করা হয় একটি ছাত্র সংগঠন। জামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা নূরউদ্দীন আহমদ গহরপুরী রহ.-এর নামানুসারে সংগঠনের নাম রাখা হয় আননূর ছাত্রকাফেলা।

সাপ্তাহিক, মাসিক ও বার্ষিক এবং সরকারি বিভিন্ন ছুটিকে কেন্দ্র করে বহুমাত্রিক ও বহু বৈচিত্র্যময় আয়োজনের মধ্য দিয়ে এগুতে থাকে আননূরের কার্যক্রম।

আননূরের বিভিন্ন কার্যক্রম ও প্রতিযোগিতার সূত্র ধরে জামিয়ায় আনাগোনা বাড়তে থাকে লেখক, কবি, সংস্কৃতিকর্মী ও দেশের খ্যাতিমান ব্যক্তিদের। তারা আসেন। মুগ্ধ হন। মুগ্ধতা প্রকাশ করেন কথায়, কাজে, লেখালেখিতে।

জামিয়ার সঙ্গে বাড়তে থাকে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। ছাত্রদের উৎসাহ দেন। অনুপ্রেরণা যোগান। প্রশংসা করেন মন খুলে। কওমি অঙ্গনের বাইরের লোকেরাও আসেন। মুগ্ধ হন ছাত্রদের আগুনঝরা বক্তব্যের নিখুঁত উপস্থাপনায়।

বিতর্কে হতবাক হয়ে শোনেন উভয়পক্ষের যুক্তি চালাচালি এবং বিপক্ষের শক্তিশালী যুক্তিখণ্ডন। কোরআন তেলাওয়াতের মাধুর্যে, সঙ্গীতে সুরের চাতুর্যে; কোনো কিছুতেই মুগ্ধতার সীমা ধরে রাখতে পারেন না।

অবশেষে ২০১৫ সালে মানুষের আগ্রহ এবং ছাত্রমিলনায়তনে লোকসঙ্কুলান না-হওয়ায় জামিয়ার দুইদিনব্যাপী বার্ষিক অনুষ্ঠান মাঠে আয়োজন করতে হয়। সেই থেকে বার্ষিক অনুষ্ঠান মাদরাসার মাঠে জমকালো আয়োজনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হতে থাকে। দশ বছরপূর্তি উপলক্ষে এবারের আয়োজনটি করা হয়েছ তিন দিনব্যাপী।

তিন দিনের ইভেন্টগুলোর মধ্যে প্রথমদিনের প্রতিযোগিতায় ছিলো আজান, হামদ-নাত ও ইসলামি সঙ্গীত প্রতিযোগিতা, বড়দের বিতর্ক, বাংলা বিষয়ভিত্তিক বক্তৃতা, আঞ্চলিক বিতর্ক এবং সবশেষে দর্শকপর্ব।

দ্বিতীয়দিন ছিলো বাংলা ও আরবি হস্তলিপি প্রতিযোগিতা, জামিয়ার প্রাথমিক পর্যায়ের ছাত্রদের নিয়ে ক্ষুদে বিতর্ক, বিকেল সাড়ে চারটায় 'তালাক' বিষয়ে তাত্ত্বিক ও দালিলিক আলোচনা নিয়ে মুফতি আব্দুল্লাহ সাহেবের 'কনফারেন্স অন রিলিজিয়ন', সন্ধ্যে সাড়ে ছ'টায় আরবি বক্তব্য প্রতিযোগিতা।

রাত সাড়ে আটটায় শুরু হয় কনফারেন্স অন রিলিজিয়নের দ্বিতীয় পর্ব। 'ইসলাম ও মিডিয়া' বিষয়ে সারগর্ভ আলোচনা রাখেন মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ। কনফারেন্সের পরে ছিলো 'টক-শো'।

এতে অংশ নিয়েছিলেন জামিয়ার প্রিন্সিপাল মাওলানা মুসলেহুদ্দীন রাজু, লেখক ও প্রাবন্ধিক মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ এবং কবি ও গবেষক মুসা আল হাফিজ এবং মুফতি রেজাউল করিম আবরার। টক-শোর উপস্থানাপনায় ছিলেন কবি আবৃত্তিকার মীম সুফিয়ান। সবশেষে ছিলো দর্শকপর্ব।

উৎসবের তৃতীয় দিন ছিলো সবচেয়ে সেরা এবং মনোজ্ঞ সব আয়োজন। ছিলো জাতীয় পর্যায়ের হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতা। পুরো দেশের হিফজুল কুরআন বিভাগে অধ্যয়নরত হাফিজে-কুরআনরা এতে অংশগ্রহণ করেন।

সকাল দশটায় নিবন্ধনভুক্তদের নিয়ে শুরু হয় বাছাইপর্ব। সন্ধ্যা সাড়ে ছ'টায় বাছাইকৃত হাফিজদের নিয়ে শুরু হয় প্রতিযোগিতার মূল পর্ব। ছিলো শ্রোতাকর্ষক মনোজ্ঞ আয়োজন 'সবাই মিলে মান বাঁচাও' এবং দর্শকপর্ব।

আননূর ছাত্রকাফেলার বিগত দশ কার্যবর্ষের সকল দায়িত্বশীলকে প্রদান করা হবে আননূরের পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল সম্মাননা ক্রেস্ট। এরপর তিনদিনের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয় এবং পুরস্কার প্রদান করা হয় ।

সবশেষে আগত অতিথিদের অভিব্যক্তি এবং দুয়ার মাধ্যমে শেষ হয় তিনদিনের বৈচিত্র্যপূর্ণ আননূর উৎসব।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইন্ডিয়ার খ্যাতিমান গায়েন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নন্দিত নাশিদশিল্পী শাইখ ইহসান মুহসিন। ইতোপূর্বে তিনি আরও একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন জামিয়ার 'কওমি গ্রাজুয়েশন'-এর আমন্ত্রণে।

তার আগমণ অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেছিলো পুরো এলাকায়। তার পরিবেশিত সঙ্গীত ছড়িয়ে পড়েছিলো মানুষের মুখে মুখে। তাই এবারো কানায় কানায় ভরে উঠেছিলো জামিয়া। অসংখ্য ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষীর পদচারণায় মুখর ছিলো জামিয়াপ্রাঙ্গন।

বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সভাপতি ও বিচারকের ভূমিকা পালন করেন জামিয়ার শিক্ষকবৃন্দ। প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম, মুহাদ্দিস মাওলানা শোয়াইব আহমদ। আমন্ত্রিত সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বেফাক শিক্ষাবোর্ডের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আব্দুল খালিক সাহেব।

জামিয়ার আসাতিযায়ে কিরামের পাশাপাশি আমন্ত্রিত বিচারক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন লেখক, প্রাবন্ধিক ও ইসলামি চিন্তক মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ, কবি, গবেষক মুসা আল হাফিজ, মদিনা ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব থেকে আসা মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকী, মাদরাসায়ে আবু বকর ঢাকার শিক্ষক মুফতি রেজাউল করিম আবরার, লিডিং ইউনিভার্সিটির প্রভাষক শফি আহমদ, দৈনিক সিলেটের ডাক-এর সাহিত্য সম্পাদক ফায়যুর রাহমান, শিল্পী ও সুরকার আহমদ আব্দুল্লাহ এবং কণ্ঠশিল্পী শালিন আহমদ।

উৎসবের আমেজ মাদরাসার চৌহদ্দি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিলো পুরো এলাকায়। গহরপুর এলাকার তরুণ ও যুবকদের সমন্বয়ে গঠিত 'মাদরাসাবাজার যুব সমাজ' জামিয়ার প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের মতো উৎসবকে কেন্দ্র করে এবারও নিয়েছেলো বহু ধরনের উদ্যোগ।

যুব সমাজের পক্ষ থেকে আননূরের বিগত দশ বছরের দশ জিএস-কে প্রদান করা হয় বিশেষ সম্মাননা স্মারক। অর্ডার করা হয়ে উৎসবের লগো সম্বলিত টি-শার্ট। জামিয়ার প্রধান ফটকে নির্মাণ করা হয় দৃষ্টিনন্দন তোরণ।

এছাড়াও অনুষ্ঠানজুড়ে ছিলো তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। পুরো অনুষ্ঠানটি সামাজিক যোগাযোগব্যবস্থা ফেইসবুকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

এতে করে সারাবিশ্বের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে থাকা জামিয়ার সুহৃদসমাজ অনুষ্ঠানটি উপভোগ করার সুযোগ পান। তাদের প্রচুর অভিনন্দন ও প্রশংসা আয়োজনের আনন্দে ভিন্নমাত্রা যোগ করে।

আমন্ত্রিত অতিথিসহ এলাকার বিদগ্ধসমাজের ধারণা, কওমি গ্রাজুয়েশন-এর মতো আননূরের এ বৈচিত্র্যবহ ও বহুমাত্রিক উৎসবও আগামীর জন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে।

লেখক: শিক্ষক, জামিয়া গহরপুর; সাবেক জিএস, আননূর ছাত্রকাফেলা

বিবিদের সাথে কাটানো বিশ্বনবীর আনন্দঘন পাঁচ মুহূর্ত


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ