শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


‘যুদ্ধের সময় আমাদের বাড়িতে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় দিয়েছিলাম’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

বাংলাদেশের যে এলাকাগুলো ইসলামের জন্য উর্বরভূমি সেগুলোর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্যতম। এ মাটির সঙ্গে মিশে আছে অনেক আন্দোলন ও শহীদের ইতিহাস।

আজ আমরা ইসলাম ও ওলামায়ে কেরামের উর্বরভূমির এক হাফেজে হাদিস, জামিয়া দারুল আরকাম আল ইসলামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল, জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়ার শায়খুল হাদিস, উস্তাজুল আসাতিজা আল্লামা শায়খ সাজিদুর রহমানের একটি সাক্ষাতকার পড়বো।

যে সাক্ষাতকারে আছে তার  রাগ-অনুরাগ, আবেগ, ভালোবাসা, শিক্ষা, শিক্ষক জীবনের কথা।

আছে শিক্ষা চেতনার কথা, মাদরাসা সিলেবাসকে সমৃদ্ধ আর সুন্দর করার স্বপ্নীল কিছু আশার কথা। যেহেতু এটা স্বাধীনতার মাস তাই বাংলাদেশের মু্ক্তিযুদ্ধ নিয়েও রয়েছে তার কিছু স্মৃতিচারণ।

সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন আওয়ার  ইসলাম সম্পাদক হুমায়ুন আইয়ুব। ছবি তুলেছেন তামিম আহমেদ

আপনার শিক্ষা ও শিক্ষক জীবন সম্পর্কে আমরা কিছু জানতে চাই

আমি দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারি থেকে ১৯৮৪ সারে দাওরায়ে হাদিস পাশ করি।বাংলাদেশে  আমার উস্তাদদের মধ্যে অন্যতম শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী।

এরপর দাওরা শেষ করে আমি চট্টগ্রাম ফটিকছড়িতে জামিয়া আরাবিয়া নাজিরহাট বড় মাদরাসায় তিন বছর দরস-তাদরিসের খেদমত করি।

এরপর আল্লামা শাহ আহমদ শফী আমাকে বলেন হাটহাজারী মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে। আমি তাদের অনুরোধে উম্মুল মাদারেস হাটহাজারী মাদরাসায় যোগ দিই এবং সেখানে প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন বছর খেদমত করি।

এরপর উস্তাজুল আসাতিজা শাহ আহমদ শফীর নির্দেশক্রমে কাতারের আওকাফ মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় আমি কাতারে চলে যাই। সেখানে ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অনেককে ফিকহের দরস দিই।

সেখানে কিন্তু আমি ইলেম অর্জন থেকেও দূরে থাকি নি। ড. শায়েখ ইউসুফ কারযাভি ও শায়েখ মুহাম্মদ আজাদের কাছে আমি লেখাপড়া করেছি।

আমি কাতারে থাকাকালীন সেখানের শিক্ষাব্যবস্থা ও তাদের সংস্কৃতি দেখে যে মাদরাসাগুলোর ওসিলায় আমাদের দেশে ইসলাম টিকে আছে সেগুলোতে একটু ভিন্ন মাত্রা যোগ করতে ব্যাপৃত হয়ে পড়ি।

আমার মনে হয় দেশে এসে নতুন একটি মাদরাসা চালু করার যেখানে কমপক্ষে মেট্টিক পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজি, অংক, বিজ্ঞান থাকবে।

কিন্তু এদিকে আল্লামা শাহ আহমদ শফী আমাকে নিজ হাতে চিঠি লিখে বারবার তাগিদ দিচ্ছেন দেশে এলে যেন হাটহাজারীতেই শিক্ষক হিসেবে যোগ দিই।

আমি পরবর্তীতে হুজুরের সঙ্গে পরামর্শ করে এবং অন্যান্য মুরব্বির সঙ্গে পরামর্শ করে দেশে এসে ১৯৯৩ সালে ছোট্ট আকারে জামিয়া ইসলামিয়া দারুল আরকাম প্রতিষ্ঠা করি।

আমের মুকুলে ছাওয়া দারুল আরকাম শিক্ষাভবন

আপনি কওমি মাদরাসায় বেড়ে ওঠা সন্তান। আপনার মাথায় দারুল আরকামের মতো ভিন্নধর্মী একটি  প্রতিষ্ঠান কোন চিন্তা থেকে গড়ে তুলেছেন? এবং এর মাধ্যমে আপনি মৌলিক কোন কোন জায়গায় পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছেন?

মাদরাসা সিলেবাসে কিছু বিষয় আছে যা পরিবর্তন করা অম্ভব। যেমন, কুরআন, হাদিস, আকিদা ইত্যাদি। কিছু জিনিস আছে যেগুলোতে পরিবর্তন আনা যায় এবং যুগের চাহিদা অনুযায়ী সেগুলোতে পরিবর্তন আনাই উত্তম।

যেমন নবী যুগে যুদ্ধ করতেন ঘোড়া, তরবারি, উট ইত্যাদি দিয়ে। কিন্তু এখন তা সম্ভব নয়। তাই যুগ চাহিদা অনুযায়ী তা করতে হবে।

ঠিক তেমনিভাবে এখন আমাদের সিলেবাসে যা যুক্ত বা যেভাবে সমৃদ্ধ করা দরকার সেভাবেই কাজ করাই উত্তম। আমাদের সিলেবাসে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করা দরকার। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি প্রত্যেক নবীকে তার নিজ গোত্রের ভাষায় পাঠিয়েছি।

আমি যখন হাটহাজারীতে ছিলাম তখন ছাত্রদের বাংলা চর্চার বিষয়ে খুব তাগিদ দিতাম। প্রাইভেটভাবে আমি তাদের খাতা দেখতাম। লেখা ঠিক করে দিতাম।

বাংলা নিয়ে আপনার এইযে দরদ, আবেগ ভালবাসা। এটা আপনি কার থেকে পেলেন? কে আপনাকে এ বিষয়ে অনুপ্রাণিত করেছে?

আসলে ওই রকমভাবে আমি কারো থেকে এ বিষয়ে অনুপ্রাণিত হইনি। এটা আমার নিজের থেকেই করা। আমার হৃদয়ে এটা এসেছে, নিজের মাতৃভাষার প্রতি আমাদের যত্নশীল হওয়া উচিৎ।

দারুল আরকামের কম্পিউটার ল্যাব

আমাদের সিলেবাসকে যদি পরিবর্তন করতে হয়, তা তো বড়রা করবেন। কিন্তু আপনার কাছে আমার জানতে চাওয়া হলো, কীভাবে আমাদের সিলেবাসকে আরো সমৃদ্ধ করা যায়?

আমি আগেই বলেছি, মৌলিক বিষয়গুলো বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। সেগুলো ঠিক রেখে সঙ্গে কিছু বিষয় যোগ করা যেতে পারে। যেমন, বাংলা, ইংরেজি, অংক, বিজ্ঞান, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ।

আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের মাদরাসায় বিশাল কম্পিউটার ল্যাব রয়েছে। যেখানে কাফিয়া, শরহে জামি ও শরহে বেকায়ার ছাত্রদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। শুধু কম্পিউটারের জন্যই আমাদের আলাদা প্রশিক্ষক রয়েছে।

সঙ্গে রয়েছে বিজ্ঞানাগার। যা এ মাদরাসা প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ছিল।

আমাদের সিলেবাসে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে যুক্ত করা যায় কিনা?

অবশ্যই। যুদ্ধের সময়  আমি একদম ছোট ছিলাম। সেই ছোট বয়সেই আমি অনেক মুক্তিযোদ্ধার সেবা করেছি। আমাদের বাড়িতে তাদের থাকার জায়গা দেয়া হয়েছে। খাবার দেয়া হয়েছে।

দেশপ্রেম তো বিরাট এক ব্যাপার। নবী করিম সা. যখন মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করছিলেন, তখন তিনি মক্কাকে লক্ষ করে বলেছিলেন, হে মক্কা তুমি আমার কত যে প্রিয়, তোমার কওম যদি আমাকে বের করে না দিতে তাহলে আমি তোমাকে কথনোই ছেড়ে যেতাম না।

আমরা দেখি মাদরাসার প্রথম ক্লাসগুলোতে অনেক ছাত্র থাকে কিন্তু দাওরায় গিয়ে সেই পরিমাণ ছাত্র টিকে থাকে না। ঝরে পড়ে। এর কারণ কী?

ইসলামের মূল শিক্ষা হলো সন্তানকে ইমান শিক্ষা দেওয়া। তাই ছোটবেলায় যদি একটি ছেলে মাদরাসায় কুরআন শিখে পরবর্তীতে তার বাবা মা তাকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানানোর জন্য স্কুল কলেজে নিয়ে ভর্তি করেন তাহলে কিন্তু তার ভেতরে ইসলাম ও ইমানের আলো লেগে থাকলো। আর এটাই তো আমাদের সফলতা।

তবে আপনি যে ঝরে পড়ার কথা বলছেন, তা কিন্তু আমি তেমন দেখি না। দেখুন, গত বছর দাওরায় শুধু বেফাক থেকেই হাইয়াতুল উলিয়ায় পরীক্ষা দিয়েছে ১৮ হাজার শিক্ষার্থী, আর অন্য পাচবোর্ড থেকে দিয়েছে পাচ হাজার।

এদিকে লক্ষ করলে কিন্তু আপনি দেখতে পাবেন তেমন ঝরে পড়ছে না। পাশাপাশি বেফাকও হচ্ছে সমৃ্দ্ধ ও সর্বময়।

দারুল আরকামের বিজ্ঞানাগার

হাইয়াতুল উলিয়াকে সরকার সনদ দিলেও এখনো তা আইনিভাবে কার্যকর হয়নি। এর জন্য আপনারা কী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন?

এর জন্য আমরা একটি সাব কমিটি গঠন করেছি। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের ওয়াদা দিয়েছেন, নির্বাচনের আগেই তিনি আমাদের  এই স্বীকৃতিকে কার্যকর করবেন।

আপনার মাদরাসায় এসে আমরা দেখেছি, এখানের পরিবেশ ও ছেলেদের খেলাধুলার জায়গা অনেক সুন্দর ও মেধাবান্ধব। মাদরাসার পরিবেশ ও বিনোদন ব্যবস্থা ছাত্রদের লেখাপড়ার জন্য কতটা সহযোগী বলে আপনি মনে করেন? এবং এ বিষয়ে আপনি অন্যদের কী পরামর্শ দিবেন?

মুসলিম শরিফে আছে, আল্লাহ পাক সুন্দর এবং সুন্দরকে তিনি ভালবাসেন। তাই আমি আমার মাদরাসাকে পরিষ্কার ও সুন্দর করে রাখার চেষ্টা করি।

কেননা মুসলমানদের ধর্মীয় প্রত্যেকটা বিধানই তো পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার স্বাক্ষী বহন করে। মুসলমান প্রত্যেকদিন পাচবার অজু করে। ঘুম থেকে উঠে হাত না ধুয়ে কোথাও হাও দেয় না। এটাই তো আমাদের শিক্ষা।

যেসব মাদরাসার আমাদের মতো জায়গা নেই, আমি তাদের বলবো তারা যেন একটু জায়গা করে একটি ফুল গাছ লাগায়, পরিবেশ সুন্দর রাখে।

ভারতের বিভিন্ন মাদরাসা, সৌদি আরবের বিভিন্ন মাদরাসা ও মিসরের আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ছেলেরা যেতে পারে না। কেননা তাদের সঙ্গে আমাদের মুআদালা নেই। তাদের সঙ্গে কীভাবে মুআদালা তৈরি করা যায়?

এরজন্যই তো আমাদের স্বীকৃতি প্রয়োজন। স্বীকৃতি কার্যকর হয়ে গেলেই তা আমাদের সম্ভব হবে।

আমাদের দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। মসজিদ রয়েছে পাচ লক্ষাধিক।কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের কথা বলার মতো  কোনো মিডিয়া নেই। এর কারণ কী? এ থেকে আমরা কীভাবে বের হতে পারি?

৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে আমাদের একটি মিডিয়া না থাকা খুবই স্পর্শকাতর বিষয়।বেফাক চেষ্টা করছে নিজেদের একটি মিডিয়া গড়ে তোলার।

এছাড়াও আমি সবার কাছে অনুরোধ করবো সবাই যেন আমাদের কথাবলার মতো একটি মিডিয়া গড়ে তোলে। আপনারা আওয়ার ইসলাম যে খেদমত করে যাচ্ছেন তার কোনো তুলনা হয় না।

আমি মন থেকে বলছি, যোগ্য কেউ যদি একটি মিডিয়া করতে চায়, তাহলে আমি তাদের যথেষ্ট পরিমাণ সহযোগিতা করবো ইনশাল্লাহ।

শ্রুতিলিখন: কাউসার লাবীব


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ