শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


‘সর্বস্তরে বিশুদ্ধ মাতৃভাষার চর্চা চালু করতে রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হতে হবে’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আওয়ার ইসলাম: আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভায় জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতৃবৃন্দ বলেন, যে আত্মত্যাগ ও কুরবানীর বিনিময়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বস্তরে সেভাবে ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা পায়নি।

সরকারি দফতর ও আদালতে মাতৃভাষা বাংলার পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার নেই। ইংরেজীকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে সর্বস্তরে। যে কারণে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে এমন একটা বার্তা যাচ্ছে যে, সন্তানদের ভবিষ্যত উন্নতির জন্য অবশ্যই বাংলার পরিবর্তে ইংরেজী শিক্ষাকেই গুরুত্ব দিতে হবে বেশি। এটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য খুবই দুঃখের ও হতাশার।

বিশুদ্ধ মাতৃভাষা বাংলার চর্চা দেশের সর্বস্তরে চালু করার বিষয়ে সবার আগে রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হতে হবে”।

ঐতিহ্যবাহী ইসলামি রাজনৈতিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ ২১ ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা উপলক্ষ্যে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।

বইমেলায় বেস্টসেলার বইগুলো দেখতে ক্লিক করুন

পাশাপাশি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন-সংগ্রামে আত্মদানকারী ২১ ফেব্রুয়ারী’র ভাষা শহীদদের রুহের মাগফিরাত ও আত্মার শান্তির জন্য খতম ও দোয়ার আয়োজনও করেছে দলটি।

গতকাল রাজধানীর জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা মাদ্রাসায় এই আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ এর ঢাকা মহানগর সহসভাপতি মুফতী জাকির হোসাইন এর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন দলের মহাসচিব আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী।

বক্তব্য রাখেন সহসভাপতি আল্লামা জুনায়েদ আল-হাবীব, মাওলানা ফজলুল করীম কাসেমী, যুগ্মমহাসচিব হাফেজ মাওলানা নাজমুল হাসান, অর্থসম্পাদক মুফতী মুনির হোসাইন কাসেমী, মাওলানা আবু সালেহ, ছাত্র জমিয়তের সভাপতি মুফতী নাসির উদ্দীন খান, মাওলানা হাবীবুল্লাহ ইসলামপুরী’সহ বারিধারা শাখা জমিয়ত ও ছাত্র জমিয়তের নেতৃবৃন্দ।

সভায় জমিয়তের সহসভাপতি আল্লামা জুনায়েদ আল-হাবীব বলেন, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন-সংগ্রামে শহীদ হয়েছিলেন- আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, রফিক উদ্দীন আহমদ, আবদুস সালাম, শফিউর রহমান, আবদুল আউয়াল, মো. অহিউল্লাহ।

তারা সকলেই ছিলেন মুসলমান এবং ধর্মভীরু পরিবারের সন্তান। তাদের কেউই অমুসলিম ছিলেন না। অথচ বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য যারা আত্মদান করলেন, এই মুসলমান শহীদদের স্মরণার্থে ইসলামী তরীক্বা বাদ দিয়ে খ্রীস্টানি তরীক্বায় মিনারে ফুল দেওয়া হচ্ছে, নীরবতা পালন করা হচ্ছে।

এতে শহীদ সালাম, বরকত, জাব্বারদের আত্মার কোন উপকারটা হচ্ছে? এতে কবরে তাদের রুহের শান্তির জন্য কোন উপকার হচ্ছে না। বস্তুতঃ জরুরী ছিল, যারা জাতির আত্মমর্যাদা ও সম্মান প্রতিষ্ঠার জন্য ভাষা আন্দোলনে শহীদ হয়ে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন, জাতীয় পর্যায়ে তাদের রূহের শান্তি ও মাগফিরাতের জন্য খতম ও দোয়ার আয়োজন করা।

তিনি বলেন, গণতন্ত্রের মোড়কে পুঁজিবাদি বাণিজ্য আজ এতটা জেঁকে বসেছে যে, মৃতের প্রতি মাগফিরাত জানানোর তরীক্বাতেও এখন কোটি কোটি টাকার ফুল বেচাবিক্রির বাণিজ্য ঢুকে গেছে।

যুগ্মমহাসচিব মাওলানা হাফেজ নাজমুল হাসান বলেন, বাংলার জন্য যারা আত্মত্যাগ করেছেন, তাদেরকে আমরা গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি সব সময়। আমরা ভাষা শহীদদের মাগফিরাত কামনা করি।

আজকে ভাষা শহীদদের জন্য আমরা খতম ও দোয়া-দরূদ শেষে দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে জমিয়তের পক্ষ থেকে। অথচ দুঃখজনভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে সারা দেশে শহীদদেরকে স্মরণ করার ও সম্মান করার পশ্চিমা কালচার ফুল দেওয়া ও এক মিনিট নীরবতা পালন করার রেওয়াজ চালু করা হয়েছে।

মাওলানা নাজমুল হাসান বলেন, এক মিনিট নীরব দাঁড়িয়ে না থেকে এই এক মিনিট দোয়া-দরূদ পড়লেও তো শহীদদের কিছু উপকার হত।

তিনি বলেন, শুধু ২১ ফেব্রুয়ারি ফুল দেওয়া ও এক মিনিট নীরব থাকার মধ্যে শহীদদের যেমন কোন উপকার হচ্ছে না, তেমনি ভাষারও কোন কল্যাণ নেই। এখন জরুরি হচ্ছে, জাতীয় পর্যায়ে ভাষা শহীদদের জন্য মাগফিরাত কামনার পাশাপাশি বিশুদ্ধ বাংলা ভাষার চর্চা সর্বস্তরে চালু করা।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের যুগ্মমহাসচি মাওলানা ফজলুল করীম কাসেমী বলেন, সাংস্কৃতি চর্চার নামে আজ সারাদেশে শুধু ভারতীয় সিনেমা, নাটক ও নায়ক-নায়িকাদের আমদানি করে ন্গ্নপনা চালু করে ক্ষতি করা হচ্ছে- তা নয়, ভাষার ক্ষেত্রে আজ আগ্রাসন চলছে।

হিন্দি নাটক-সিনেমা ও টিভি’র অবাধ প্রবাহের কারণে বর্তমানের তরুণ প্রজন্মের বড় একটা অংশের মধ্যে হিন্দিপ্রীতি দেখা যাচ্ছে দুর্ভাগ্যজনকভাবে।

এছাড়া বাংলার পরিবর্তে ইংরেজী ভাষাকেই মর্যদাকর ভাষা হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা চলছে নানা ভাবে। তিনি বলেন, ইংরেজীকে প্রয়োজনের জন্য শেখার আমরা বিরোধী নই। তবে বাংলা ভাষার মর্যাদা সুনিশ্চিত করার পরই।

ছাত্র জমিয়তের সভাপতি মুফতী নাসির উদ্দীন খান বলেন, যে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার জন্য এই জাতি ত্যাগ স্বীকারে বিশ্বব্যাপী উদাহরণ তৈরি করেছে, সেই মহান মাতৃভাষাটি আজ খোদ নিজে দেশেই যেন অবহিলত হয়ে পড়েছে।

আজকে বাংলার বদলে ইংরেজী মিডিয়ামে শিক্ষাগ্রহণকে মর্যাদার চোখে দেখা হচ্ছে। আদালতের রায়ে মাতৃ ভাষার বড় রকমের অনুপস্থিতি দেখা যায়। সরকারী বেসরকারী দফতরে ইংরেজী ভাষার প্রাবল্যতা।

সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও বাংলার প্রতি চরম অবহেলা পরিলক্ষিত হয়। ভারতীয় চ্যানেলের আধিক্যতার কারণে নতুন প্রজন্মের মধ্যে হিন্দি শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। সব মিলিয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা আজ হুমকির মুখে।

তিনি বলেন, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সর্বত্র বাংলার প্রচলন চালু করতে হবে। পাশাপাশি বিশুদ্ধ বাংলার চর্চা করতে হবে। তিনি বলেন, আজকে এক শ্রেণীর মানুষ ও কিছু মিডিয়া বাংলা ভাষার স্বকীয়তাকে নানাভাবে বিনষ্ট করে চলছে। তারা বাংলার সাথে ইংরেজি ও হিন্দি শব্দের এমনভাবে মিশ্রিণ করছে, যা মোটিও কাম্য নয়।

মুফতী নাছির উদ্দীন খান আরো বলেন, আশার কথা হচ্ছে, বিশুদ্ধ বাংলার চর্চায় মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্র ও আলেম-উলামারা অনেকটা এগিয়ে আছেন। লেখালেখি, সাহিত্যচর্চা, সাংবাদিকতা ও বক্তৃতা-বিবৃতিতে আলেমরা এখন বিশুদ্ধ বাংলার ব্যবহার করেন।

মাদ্রাসার ছাত্রদের মধ্যে প্রায়ই দেখা যায়, বাংলা সাহিত্য চর্চা ও বক্তৃতা প্রতিযোগিতার পাশাপাশি সাংবাদিকতার উপর প্রশিক্ষণ কোর্সে তারা অধিক হারে অংশ নিচ্ছেন। এটা খুবই আশা জাগায়।

সভাপতির বক্তব্যে মুফতী জাকির হোসাইন বলেন, সরকারী অফিস-আদালতসহ রাষ্ট্রের সর্বস্তরে শতভাগ বাংলা ভাষার ব্যবহার চালু করার জন্য আমরা সরকারের কাছে জোর দাবী জানাচ্ছি।

পাশাপাশি দেশের প্রতিটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলেও আবশ্যিকভাবে বিশুদ্ধ বাংলার চর্চা বাধ্যতামূলক করতে হবে।

তিনি বলেন, বেশ কয়েক বছর আগে আদালত নির্দেশ জারি করেছিল- সকল সাইনবোর্ড বাংলায় লেখা বাধ্যতামূলক। অথচ এই রাজধানী ঢাকাতে বাংলা সাইবোর্ড অর্ধেক আছে কিনা আমার সন্দেহ।

এটা গোপন কিছু নয়, রাস্তায় আমরা সকলেই দেখে থাকি। কিন্তু এদিকে কারো নজর নেই। তিনি বলেন, হিন্দি টিভি চ্যানেল ও নাটক-সিনেমার অবাধ প্রবাহের কারণে বর্তমানের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হিন্দি ভাষার চর্চা আশংকাজনক হারে বাড়ছে।

সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেই বাংলা ভাষা সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত। অথচ সরকারেরই এসব নিয়ন্ত্রণে কোন উদ্যোগ আমরা দেখছি না। স্বাধীনতার চেতনাবাদি বলে যারা গলা ফাটায়, তাদেরকেও এসব নিয়ে ভাবতে ও কথা বলতে আমরা দেখি না।

মুফতী জাকির হোসাইন হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ২১ ফেব্রুয়ারীর দিনেও দেশের বিভিন্ন স্থানে সাধারণ শিক্ষিত কিছু উচ্ছৃঙ্খল যুবককে নানা আয়োজন, অনুষ্ঠান ও পিকাপ ভ্যান সাজিয়ে বিকট আয়াজে হিন্দি ও ইংরেজী গানের পরিবেশনার সাথে সাথে অশ্লীল নৃত্যরত দেখা যায়। এটা খুবই নিন্দনীয় ও হতাশাজনক। ভাষার প্রতি এমন অসম্মান ও অবজ্ঞা মেনে নেওয়া যায় না।

বারিধারা মাদ্রাসার ‘কাসেমী মিলনায়তন’ এ সকাল ৯টায় আলোচনা সভা শুরু হয়ে বেলা দেড়টায় দোয়া-মুনাজাতের মাধ্যমে অনুষ্ঠানটি শেষ হয়।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ