বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪ ।। ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


কেউ কি এই আদর্শ গ্রহণ করবে?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক :  বড়রা থাকা অবস্থায় ছোটরা হাদীস কিংবা মাসআলা বয়ান করবে না-এটি একটি সর্বজনবিদিত ইলমী আদব। তাহলে বড়দের বিদ্যমান থাকা অবস্থায় ছোটরা যদি নিজেদের আলাদা মসনদ তৈরি করে তাহলে তা কেমন হবে? অথচ এটাই এখন বেশি দৃষ্টিগোচর হচ্ছে।

আমাদের অনুসরণীয় পূর্বসূরীদের মধ্যে এ রীতি প্রচলিত ছিল না। তারা দাওয়াত- তালীম, দরস-তাদরীস এবং এধরনের (ইফাদামূলক) কাজকর্ম তখনই শুরু করতেন যখন বড়রা তাদেরকে শুরু করার আদেশ দিতেন। এ বিষয়ে ইতোপূর্বে সংক্ষিপ্ত আকারে লিখেছি।

খতীব বাগদাদী প্রণীত ‘আলজামি লিআখলাকির রাবী ওয়া আদাবিস সামি’ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রসিদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ কিতাব। কিতাবটি বেশ কিছু দিন আগেই ড. মাহমুদ তহহান এর তাহকীকের পর প্রকাশিত হয়েছে। এ কিতাবের প্রথম খন্ডে কয়েকটি অধ্যায় রয়েছে, যার শিরোনামগুলো হচ্ছে-

  • ـ من كره الرواية ببلد فيه من المحدثين من هو أسن منه.
  • ـ من كره التحديث بحضرة من هو أسن أو أعلم منه.
  • ـ ما قيل في طلب الرئاسة قبل وقتها وذم المثابر عليها وهو غير مستحقها.

এই অধ্যায়গুলোতে এমন অনেকগুলো ঘটনা রয়েছে যেগুলো পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে। এর মধ্যে ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীন (১৫৮-২৩৩ হিজরী) রাহ. এর একটি ঘটনা রয়েছে।

তিনি বলেছেন- إذا حدثت ببلدة فيها مثل أبي مسهر، فيجب للحيتي أن تحلق.

অর্থাৎ যে শহরে আবু মুসহির আবদুল আ’লা আদদিমাশকী (১৪০-২১৮ হিজরী)-এর মতো মুহাদ্দিস রয়েছে, সেখানে যদি আমি হাদীস বর্ণনা করি তাহলে আমার দাড়ি মুন্ডিয়ে দেওয়া উচিত।

ইমাম ইবনে মায়ীন রহ. এর এ কথাটি বর্ণনা করেছেন মুহাদ্দিস আহমদ ইবনে আবুল হাওয়ারী। তিনি তা বর্ণনা করার পর বলেন, ‘আমি যদি ওই শহরে হাদীস বয়ান করি যে শহরে আবুল ওয়ালীদ হিশাম ইবনে আম্মার রয়েছেন তাহলে আমার দাড়ি মুন্ডিয়ে দেওয়া উচিত।’ আলজামি ১/৩১৯; ফাতহুল মুগীছ ৩/২৪১

জরহ-তাদীলের কোনো ইমামের কাছে তালিবে ইলমরা দরখাস্ত করেছিল যে, ‘জুয়াফা’ সম্পর্কে একটি কিতাব রচনা করুন। তিনি বললেন, ‘ইমাম উকায়লী রাহ.-কে আমার লজ্জা হয়। তিনি ‘আযযুয়াফাউল কাবীর’ লিখেছেন। তার এ কিতাব বিদ্যমান থাকা অবস্থায় আমি এ বিষয়ে কীভাবে লিখি?’

ইমাম দারাকুতনী (৩০৬-৩৮৫ হিজরী) এর কাছে মুহাদ্দিস হামযা আসসাহমী দরখাস্ত করলেন যে, আপনি ‘যুয়াফা’ সম্পর্কে কিতাব লিখুন। তিনি বললেন, তোমাদের কাছে কি ইমাম ইবনে আদী এর কিতাব ‘আল কামিল ফী যুয়াফাইর রিজাল’ নেই? প্রস্তাবকারী বললেন, জ্বী হাঁ, আছে।

দারাকুতনী রহ. বললেন, তাহলে সেটাই যথেষ্ট।’ মোটকথা, সালাফে সালেহীনের সাধারণ রীতি এই ছিল যে, তারা উস্তাদগণের অনুমতি ছাড়া কর্মের ময়দানে পা রাখতেন না। যে কাজের জন্য যিনি যোগ্য সে কাজ তার জন্যই ছেড়ে দিতেন অন্যরা সেখানে ঝামেলা সৃষ্টি করতেন না।

যে বিষয়ে কোনো কাজ হয়েছে কিংবা পূর্ব থেকে করা আছে সে বিষয়ে কিছু করার আগে চিন্তা করতেন যে, এ প্রসঙ্গে নতুন করে কিছু করার প্রয়োজন আছে কি না এবং আমার এ কাজের মাধ্যমে বিশেষ কোনো শূন্যতা পূরণ হবে কি না, না শুধু নামের তালিকা দীর্ঘ হবে।

আজকাল ইলমের অঙ্গন থেকে এ আদব তিরোহিত হচ্ছে। সালাফের মধ্যে অনুসৃত কিংবা সালাফ থেকে বর্ণিত রীতি-নীতির পরিবর্তে ইলমের অঙ্গনে এখন স্বয়ংসম্পূর্ণতার প্রবণতা ব্যাপক হচ্ছে। বড়দের ছায়ায় কাজ করা অনেকের কাছেই আজ আর পছন্দনীয় নয়। তাদের ধারণা- ‘এতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রত্যেককে নিজের পায়ে দাঁড়ানো প্রয়োজন এবং নিজের দোকান আলাদা খোলা প্রয়োজন!’

আমার ওই ভাইদের এটা জানা নেই যে, অনেক দ্বীনী কাজ, বিশেষত ইলম ও তাহকীকের অঙ্গনে দীর্ঘ ও নির্ভরযোগ্য কাজ সম্মিলিত প্রয়াস ছাড়া সাধারণত সম্ভব হয় না। আর সম্মিলিত কাজের পন্থাই এই যে, অনেক প্রতিভাশালী একত্রে কাজ করবে এবং নিজেদের মধ্যে একজনকে আমীর নির্বাচন করবে। হতে পারে তিনি তাদের সকলের উস্তাদ, কিংবা কোনো বিশেষ বিষয়ে তার অগ্রগণ্যতা রয়েছে। তার অধীনে সবাই কাজ করবে। এই পদ্ধতিই সালাফের যুগ থেকে প্রচলিত।

প্রত্যেক প্রতিভাশালী স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া, প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন কেন্দ্র স্থাপন করা এবং স্বতন্ত্রভাবে নিজ নিজ কর্মের সূচনা করা এটা সালাফের যুগে ছিল না। যুক্তি-বিবেচনাও বলে যে, এই পদ্ধতি সঠিক নয়। আর অভিজ্ঞতায়ও দেখা যায় যে, এতে শক্তি ও যোগ্যতার অপচয় হয়। আয়োজন ও ব্যবস্থাপনার পেছনেই অধিকাংশ সময় কেটে যায়। আর তেমন উল্লেখযোগ্য ফলাফলও প্রকাশ হতে দেখা যায় না। ইল্লা মাশাআল্লাহ।

বর্তমান সময়ের দুঃখজনক বাস্তবতা শুধু এটুকুই নয় যে, প্রত্যেক প্রতিভা কর্মের স্বতন্ত্র অঙ্গন প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী; বরং ব্যাধি আরো গভীরতর। এখন তো যোগ্য-অযোগ্য সকলেই নিজেকে যোগ্য ভাবতে আরম্ভ করেছে। আরবী প্রবাদ- تزببت قبل أن تحصرم

এর একেবারে বাস্তব দৃষ্টান্ত! সম্মিলিত পরিশ্রম সার্থক হওয়ার জন্য এবং নির্ভরযোগ্যতার মানদন্ডে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য যে মূলনীতি উল্লেখ করা হয়েছে তা সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকেই অনুসৃত ছিল। আমি এখানে শুধু আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের দৃষ্টান্ত পেশ করব।

চার মুজতাহিদ ইমামের প্রত্যেকেরই বিশিষ্ট সঙ্গীরা ‘মুজতাহিদে মুতলাক’ ছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকেরই স্বতন্ত্র ‘মাদরাসাতুল ফিকহ’ পত্তন করার মতো যোগ্যতা ছিল। কিন্তু তারা তাদের রঈসের জীবদ্দশায় তার অধীনেই কাজ করে গেছেন।

ইমাম আবু হানীফা রহ. তার নিজের ঘটনা শুনিয়েছেন যে, আমি দশ বছর পর্যন্ত হাম্মাদ ইবনে আবু সুলায়মান-এর সাহচর্য গ্রহণ করেছি। এক সময় চিন্তা এল, আমি আলাদা মজলিস প্রতিষ্ঠা করি না কেন? একদিন সন্ধ্যায় এ উদ্দেশ্যে মসজিদেও গিয়েছিলাম, কিন্তু মনকে মানাতে পারলাম না। উস্তাদের মজলিসেই ফিরে আসলাম। এদিকে ঘটনাক্রমে বসরায় তার এক আত্মীয় ইন্তেকাল করেন। তিনি আমাকে তার স্থলাভিষিক্ত করে বসরা চলে যান।

তার প্রস্থানের পর মজলিসে নতুন নতুন প্রশ্ন আসতে লাগল, যেগুলোর উত্তর আমি হাম্মাদ রাহ. এর কাছ থেকে ইতোপূর্বে শুনিনি। আমি উত্তর দিতাম এবং সেগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখতাম। দুই মাস পর হাম্মাদ ফিরে এলেন। আমি উত্তরগুলো তাঁকে দেখালাম। প্রায় ষাটটি উত্তর ছিল। তিনি বিশটি উত্তরে দ্বিমত প্রকাশ করলেন।

‘এঘটনার পর আমি সংকল্পবদ্ধ হয়ে গেলাম যে, মৃত্যু পর্যন্ত তার সাহচর্যেই থাকব।’

ইমাম ছাহেব রাহ. উস্তাদের মৃত্যু পর্যন্ত ( ১২০ হিজরী) তার সোহবতে ছিলেন। এভাবে সর্বমোট আঠারো বৎসর তিনি উস্তাদের সোহবত গ্রহণ করেন।-তারীখু বাগদাদ-১৩/১৩৩; তাহযীবুল কামাল। ইমাম আবু ইউসুফ রাহ.-এর ঘটনাও অত্যন্ত প্রসিদ্ধ।

একবার তিনিও সময়ের আগেই মজলিস কায়েম করেছিলেন। ইমাম ছাহেব এক ব্যক্তিকে প্রশ্নকারী বানিয়ে পাঠালেন। ইমাম ছাহেবের শেখানো পদ্ধতিতে তিনি আবু ইউসুফ রাহ.কে প্রশ্ন করেন এবং তাঁর জওয়াব অশুদ্ধ বলে মত প্রকাশ করেন। এতে আবু ইউসুফ রাহ. ইমাম ছাহেবের মজলিসে উপস্থিত হন। ইমাম ছাহেব তাকে লক্ষ করে বলেন -  تزببت قبل أن تحصرم

‘সবেমাত্র আঙ্গুর হওয়া শুরু হল আর তাতেই কিসমিস বনে গেল!’ আরো বললেন -

من ظن أنه يستغني عن التعلم فليبك على نفسه.

‘যে মনে করে, তার আর শেখার প্রয়োজন নেই সে যেন নিজের জন্য ক্রন্দন করে।’-তারীখু বাগদাদ-৩/৩৪৯, আল আশবাহ ওয়াননাযাইর ইবনে নুজাইম, আদাবুল ইখতিলাফ শায়খ মুহাম্মদ আউয়ামা পৃ: ৫৭-৫৯।

শেষে আবু ইউসুফ রহ.ও ইমাম আবু হানীফা রহ. এর ইন্তেকাল পর্যন্ত তাঁর সাহচর্যে অবস্থান করে তার তত্ত্বাবধানে ফিকহে ইসলামীর তাহকীক ও তাদবীনের কাজে মগ্ন থেকেছেন।

সালাফে সালিহীনের এই কর্মনীতির সুফল হল, এতে একদিকে যেমন প্রয়োজনীয় কাজ অধিক পরিমাণে হয় এবং পূর্ণতা ও বিশুদ্ধতার সঙ্গে হওয়ার নিশ্চয়তা থাকে অন্যদিকে উস্তাদ ও মুরববীর প্রতি নাশোকরী করা থেকেও বেঁচে থাকা যায়। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে শিক্ষা গ্রহণ করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

লেখক :  মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আমিনুত তালিম , মারকাযুদ দাওয়া আল-ইসলামিয়া, ঢাকা
মাসিক আল-কাউসার


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ