শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী ছদর সাহেব হুযুর রহ. এর জীবন ও কর্ম

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

তাহসীন আফযাল

পৃথিবীর বুকে প্রতিনিয়ত আগমন ঘটে অসংখ্য মানুষের। কালের পরিক্রমায় বেশিরভাগই হারিয়ে যায় অতীতের গহ্বরে। চলে যায় বিস্মৃতির আড়ালে। আবার কিছু মানব চির দিন রয়ে যায় মানুষের হৃদয়ে; তাদের কর্মের মাধ্যমে।

পাপাচ্ছন্ন পৃথিবীতে যারা তুলে ধরেছেন ইসলামের আলো। অসত্য আর মিথ্যার আঁধারে, মরু আলোকমালার ক্রান্তি লগ্নে, যারা আঁকড়ে ধরেছিলেন সত্যের সবুজ পতাকা, তাদেরই একজন আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী ছদর সাহেব হুযুর ( রহ)।

জন্মলগ্ন : বিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্ন। নিখিল ভারত জুড়ে চলছে বৃটিশ-শাসন এবং শোষণ। সাম্রাজ্যবাদীদের অত্যাচারে অতীষ্ঠ জনজীবন। পোপ আর গীর্জার আধিপত্যে কোণঠাসা ইসলাম। সংঘঠিত হচ্ছে ফরায়েজি আন্দোলন ও সৈয়দ আহমদের শিখ -বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনসহ নানা সংগ্রাম।

জন্ম : গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়া থানার গওহর ডাঙ্গা গ্রামে ক্ষণজন্মা এই মহা পুরুষ বাংলা ১৩০২ সনের ২ ফাল্গুন (ইংরেজি ১৮৯৬) শুক্রবার সুবহে সাদিকের ক্ষণে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতার নাম মুন্সী মোহাম্মাদ আব্দুল্লাহ এবং মায়ের নাম আমিনা।

প্রায় তিনশ বছর পূর্বে তার পূর্ব পুরুষ ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলায় আগমন করেন। তার পিতা মুন্সী আবদুল্লাহ সিপাহী বিপ্লব এবং দাদা চেরাগ আলী ছিলেন সৈয়দ আহমদের শিখ- বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী।

শিক্ষা জীবন : চার বছর বয়সে মায়ের হাতে শিক্ষা জীবনের সূচনা হয় বালক শামছুল হকের। মায়ের নিকটে তিনি আলিফ, বা ও কালিমা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। একটু বড় হয়ে পাটগাতীর পূর্ণ চন্দ্র বাবু এবং মুন্সি আজিজুল হকের পাঠশালা থেকে যথাক্রমে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণী শেষ করেন। ১৯১৩ সালে বরিশালের সুটিয়াকাঠি স্কুলে চতুর্থ, এবং '১৪ সালে ভাগুটিয়া স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষা সমাপ্ত করেন। '১৫ সনে যশোর নওয়াপাড়ার বাঘরিয়া স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীর পাঠ গ্রহণ করেন।

ছোট বেলা থেকেই তার হৃদয়ে আরবি শিক্ষার প্রতি ছিলো তীব্র আকাঙ্ক্ষা। তাই স্কুলে পড়ার পাশাপাশি ভগ্নিপতি আরশাদ মুন্সীর নিকটে কায়দা, আমপারা এবং বিভিন্ন দোয়া -দরুদ মুখস্থ করেন।

আরো অধিক উন্নত শিক্ষার জন্য কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। অষ্টম শ্রেণীতে পুরো দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদক এবং বৃত্তি হিসেবে বিশ টাকা লাভ করেন। একসময় তিনি প্রখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন কিন্তু তার মন পড়ে আছে আরবি শিক্ষার প্রতি।

দ্বীনি ইলম অর্জনে ব্যাকুল একটি তরুণ। হৃদয়ের মাঝে অস্থিরতা সারাক্ষণ। কি করে একনিষ্ঠভাবে ইলমে নববী আহরণ করা যায়। প্রাণের আকুতি প্রকাশের কোন জায়গা তার নেই। এরমাঝেই মাওলানা আশরাফ আলী থানবীর (রহ) সঙ্গে দেখা হয় তার। এবং এই আকাঙ্ক্ষা আরো শতগুণ বেড়ে যায় তরুণ শামছুল হকের।

রাতের আঁধারে গভীর জঙ্গলে গিয়ে, কোরআন শরীফ বুকে জড়িয়ে কাঁদেন আর বলেন হে মাওলা, তুমি কি আমাকে তোমার কালামের জ্ঞান থেকে বঞ্চিত রাখবে?

হুযুরের পিতা কোনভাবেই আরবি শিক্ষার বিপক্ষে ছিলেন না। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড বৃটিশ বিরোধী। তিনি ভাবতেন, ইংরেজের সাথে লড়তে হলে ইংরেজি জ্ঞান আবশ্যক। কিন্তু যুবক শামছুল হক মনে করতেন ধর্মীয় শিক্ষা পেলে মানুষ এমনিতেই সাম্রাজ্যবাদীরের বিরোধী হয়ে উঠবে।

কোনভাবেই আরবি শেখার অনুমতি না পেয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, ফাইনাল পরীক্ষায় এক ঘন্টার বেশি লিখবেন না। রেজাল্ট খারাপ হলে বাবা হয়তো ছেলের অমনোযোগিতার কথা ভেবে আরবি পড়ার অনুমতি দিবেন। কিন্তু আল্লাহ হয়তো তার প্রিয়র এমন আগমন চান নি।

পরীক্ষা শেষে দেখা গেল, তিনি এক ঘন্টা করে লিখেও ৫ টি বিষয়ে লেটারসহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছেন।

১৯২০ সালে, ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন তীব্র মাত্রায় পৌঁছলে সমস্ত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

এই সুযোগে পিতাকে পত্রের মাধ্যমে জানিয়ে তিনি থানভী রহ এর নিকটে চলে আসেন। থানবীর (রহ) পরামর্শে চার বছর মাযাহিরুল উলুম সাহারানপুরে এবং দুই বছর দারুল উলুম দেওবন্দে কোরআন-হাদীসের উচ্চতর শিক্ষা অর্জন করেন। আজন্ম ইলম-পিপাসার্ত হৃদয় সিঞ্চিত করেন সময়ের শ্রেষ্ঠ মানুষদের নিকট থেকে।

ইলমে নববী আহরণের পাশাপাশি চলে আধ্যাত্মিক উন্নয়ন। প্রতি বৃহস্পতিবার দীর্ঘ ৩৫ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে আত্মশুদ্ধির লক্ষ্যে হাযির হতেন দরবারে থানবীতে।

কর্মজীবন : দেওবন্দে উচ্চ শিক্ষা সমাপ্ত করার পরই তাকে হায়দ্রাবাদের চীফ জাস্টিস হবার প্রস্তাব করা হয়। আমি এখানে থেকে গেলে আমার দেশের মানুষের কী হবে? এই কথা বলে ১৯২৮ সনে তিনি স্বদেশে ফিরে আসেন। জামেয়া ইউনুছিয়া বি বাড়ীয়ায় ছদরুল মোদাররীছীন হিসেবে যোগদান করেন।

তার স্বপ্ন ছিলো, বাংলার প্রতিটি গ্রামে একটি করে মক্তব এবং বড় শহরগুলোতে কমপক্ষে একটি করে দাওরায়ে হাদীস মাদরাসা হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৫ সালে বাগেরহাটের গজালিয়ায়, ' ৩৬ সালে ঢাকায় আশরাফুল উলুম বড় কাটারা '৩৭ সালে খাদেমুল ইসলাম গওহর ডাঙ্গা '৫০ সালে লালবাগ জামেয়া কোরআনীয়া, '৫৬ সালে ফরিরাবাদ ইমদাদুল উলুম মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন।

লেখালিখি : বৃটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে লিখেছেন 'বৃটিশ শাসনের বিষফল'। পাদ্রীদের মুখোশ উন্মোচনে লিখেন 'পাদ্রীদের গোমর ফাঁক ' 'আল্লাহর প্রেরিত ইঞ্জিল কোথায়? ' প্রায় ষোল হাজার পৃষ্ঠাব্যাপী বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম তাফছীর 'হক্কানী তফছীর 'তার শ্রেষ্ঠ উপহার। এছাড়াও তিনি লিখেছেন 'আদর্শ মুসলিম পরিবার ' 'শত্রু থেকে হুশিয়ার থাক ' তওবানামা' 'জীবনের পণ' মসজিদ ও জীবন্ত মসজিদসহ প্রায় দু শতাধিক কিতাব। বাংলার ঘরে ঘরে থাকা বেহেস্তী জেওরের প্রথম অনুবাদ হয় তার হাত ধরেই।

সংগঠক: খৃস্টান মিশনারীদের অপতৎপরতা রুখতে গঠন করেন 'আঞ্জুমানে তাবলীগুল কোরআন '।ব্যক্তি সংশোধন এবং সামাজিক উন্নয়নের লক্ষে ১৯৪০ সালে গঠন করেন 'খাদেমুল ইসলাম জামায়াত '। তার হাত ধরেই বাংলাদেশে চালু বর্তমানের তাবলীগ জামায়াত।

অন্যায়ের প্রতিবাদ: সামরিক শাসক আইয়ুব খান 'মুসলিম পারিবারিক আইন ' চালু করতে চাইলে, তিনি আইয়ুব খানের সামনে দাঁড়িয়ে বজ্রকণ্ঠে বলেছিলেন, এদেশে মুসলিম পারিবারিক আইন নামে কোরআন বিরোধী আইন চালু হতে পারে না।

সদর সাহেব উপাধী লাভ: সৌদি আরবে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ আলিমদের নিয়ে হজ্জের ওপরে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। ছদর সাহেব হুযুরের তাত্ত্বিক এবং তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা শুনে তৎকালীন বাদশা বলে ওঠেন, ' আনতা ছদরুল ওলামা, আনতা ছদরুল ওলামা '।

ইন্তেকাল: ১৯৬৯ সনের ২১ জানুয়ারি ক্ষণজন্মা এই মহা পুরুষ ৭৩ বছর বয়সে মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দেন। তার অসিয়ত অনুযায়ী গওহর ডাঙ্গা মাদরাসার হেফয বিভাগের পাশে তাকে দাফন করা হয়।

 

 লেখক:  বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ