বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৫ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ৯ শাওয়াল ১৪৪৫


লাগাতার ‘স্মার্ট’ নেশা ডাকছে মানসিক ব্যাধি!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আওয়ার ইসলাম: মুখ ভার। চোয়াল ঝুলে গিয়েছে। চোখে জল। বিজ্ঞাপনে ওই সদ্য-তরুণীকে দেখেছেন সকলেই। জেনেছেন তার ‘যন্ত্রণা’র কারণও। ফেসবুকে নিজের ছবি পোস্ট করার পরে এক ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু একটাও ‘লাইক’ পড়েনি। ‘কমেন্ট’ তো দূর অস্ত্।

কিংবা বাস্তবের সেই কিশোর। স্মার্টফোনে ক্রমাগত বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাট করে করে তার ডান হাতের স্নায়ু
বিকল। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষায় বসতে পারেনি। গভীর অবসাদ থেকে বেরোতে ১৩ বছর বয়সেই তাকে একাধিক ওষুধ খেতে হচ্ছে।

অথবা জামশেদপুরের বছর আঠেরোর তরুণী। রাতে মোবাইল ফোনে ফেসবুক, হোয়াট্‌সঅ্যাপ করার সময় নেট-প্যাক শেষ হলে যাঁর ‘প্যানিক অ্যাটাক’ হয়ে যায়। বুক ধড়ফড় করে। সকালে উঠে ইন্টারনেট রিচার্জ না করা পর্যন্ত ঘুমও হয় না!

ভারতের অন্যতম বড় মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্র রাঁচির রিনপাস-এর (রাঁচি ইনস্টিটিউট অফ নিউরো সাইকিয়াট্রি অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্স) বহির্বিভাগে এখন এমনই সমস্যা নিয়ে হাজির হচ্ছেন অনেকে। হাসপাতালের চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকতে পারছিলেন না বছর তিরিশের যুবক। চোখ-মুখে উত্তেজনা। চিকিৎসক জিজ্ঞাসা করলেন, কী সমস্যা হচ্ছে? উত্তর এল— ‘টাচস্ক্রিন ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারছি না। কি-প্যাডে স্বচ্ছন্দ ছিলাম। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ চলছিল ঠিকঠাক। নতুন ফোন কেনার পর কিছুই হচ্ছে না। ভীষণ অসহায় লাগছে!’

চিকিৎসা পরিভাষায় এই রোগের নাম ‘ভার্চুয়াল অ্যাডিকশন’। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, প্রতি দিনই এমনই সমস্যার সুরাহা চাইতে রোগীর লম্বা লাইন পড়ছে হাসপাতালে। অবস্থা এমনই যে তাঁরা এ জন্য পৃথক চেম্বার খোলার কথাও ভাবছেন। হাসপাতালের শিক্ষক-চিকিৎসক আমূল রঞ্জন বলেন, “রিনপাসে চিকিৎসকের সংখ্যা কম।

এখনই নতুন কোনও চেম্বার খোলা উপায় নেই। তবে পরিস্থিতি যে দিকে এগোচ্ছে, তাতে আগামী দিনে তেমন ব্যবস্থা করতেই হবে।’’ তিনি জানান, এখন প্রতি দিন ৮-১০ জন রিনপাসে আসছেন, যাঁরা ওই সমস্যায় আক্রান্ত।

রাঁচির অধ্যাপক আমুল রঞ্জন বলেন, “কিছু দিন আগে রাঁচি মহিলা কলেজে ১০০ জন ছাত্রীকে নিয়ে একটা সমীক্ষা করেছিলাম। দেখা গেল, ৩৫ জন স্মার্টফোন ব্যবহারে আসক্ত।” রিনপাসে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিতে এম-ফিল করছেন পুষ্পিতা সেন। তিনি বলেন, “স্মার্টফোন অ্যাডিকশন স্কেল নামে বিশেষ ধরনের যন্ত্র আমাদের কাছে রয়েছে। সেটা দিয়ে কার, কতটা স্মার্টফোনের নেশা রয়েছে তা বোঝা যায়।’’

তিনি জানান, ওই যন্ত্রে কারও সূচক ৩৩-এর বেশি ওঠা মানেই তিনি ভীষণ ভাবে স্মার্টফোনে আসক্ত। রাঁচি মহিলা কলেজের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যে ৩৫ জন ছাত্রীর সূচক ৩৩-এর বেশি উঠেছে, তাঁরা কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে মুখোমুখি বেশি কথা বলেন না। অথচ হোয়াট্‌সঅ্যাপে রাত জেগে গল্পগুজব করেন।

কিন্তু কলকাতাও কি খুব দূরে আছে? মনোবিদরা জানাচ্ছেন, এই শহরে তাঁদের চেম্বারে তিন-চার বছরের বাচ্চারাও আসছে। স্মার্টফোনে আসক্তি কেড়ে নিচ্ছে যাদের স্বাভাবিক শৈশব।

একটা স্মার্টফোন মানে একটা জাদু-বাক্স। যা মুহূর্তে সামনে এনে দেয় গোটা পৃথিবীকে। এখন তারই বশ হয়ে পড়েছে সব বয়সের মানুষ। এই স্মার্টফোন সবচেয়ে বেশি গ্রাস করছে শিশু-কিশোরদের। রাস্তায়, অফিসে, বাড়িতে, কলেজে, সিনেমা হলে, বাজারে— সর্বত্র সকলের হাতের আঙুল সচল। চোখ মোবাইল ফোনের পর্দায়।

মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল জানালেন, তাঁর চেম্বারে যে মা-বাবারা সন্তানের এই সমস্যা নিয়ে আসছেন, বহু ক্ষেত্রে তাঁরা নিজেরাও এই নেশায় আসক্ত। এক বাবার কথা শোনালেন তিনি। জেগে থাকা অবস্থায় যিনি বাড়িতে ঘণ্টা পাঁচেক থাকেন। সেই পাঁচ ঘণ্টার চার ঘণ্টাই কাটে ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে। কিংবা সেই গৃহবধূ মা, যিনি সন্তানকে ভাত খাওয়াতে খাওয়াতেও অন্য হাতে মেসেজ টাইপ করেন। আর যুক্তি দেন, ‘‘আমার জীবনে তো আর কোনও বিনোদন নেই। বাইরের জগৎ থেকে কি পুরোই বিচ্ছিন্ন থাকব নাকি?’’ এঁরা কী শেখাচ্ছেন সন্তানকে?

মনোবিদ এবং সমাজতত্ত্ববিদদের মতে, বাচ্চাদের চুপ করাতে একেবারে শৈশবেই তাদের হাতে মোবাইল বা ট্যাব ধরিয়ে দেন বাবা-মায়েরা। এতে তাঁরা নিজেদের সময়টা নিজেদের মতো করে কাটাতে পারেন ঠিকই, কিন্তু না বুঝে কত বড় সর্বনাশের বীজ পুঁতে দিচ্ছেন, তা বুঝতেও পারেন না।

শিশুরোগ চিকিৎসক জয়তী সেনগুপ্ত সতর্ক করলেন, ‘‘অতিরিক্ত স্মার্টফোন, ট্যাব ব্যবহার খেলাধুলোর অভ্যাস কমায়। ফলে ওবেসিটি বাড়ে। মানুষের সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হতে হতে তৈরি হয় লোকজনের মাঝখানে নিজেকে গুটিয়ে রাখার মানসিক সমস্যাও।’’

মনোবিদ জ্যোতির্ময় সমাজদারের কথায়, ‘‘স্মার্টফোনে চ্যাট করতে গিয়ে যে কত রকমের ‘ইমোশনাল’ সমস্যা তৈরি হচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। রাত ন’টা থেকে ভোর চারটে পর্যন্ত চ্যাট করছে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা। শরীর ভেঙে পড়ছে। সম্পর্কের নানা ওঠা-পড়া থেকে গভীর অবসাদ তৈরি হচ্ছে। তার পরে তাদের গন্তব্য হচ্ছে আমাদের চেম্বার।’’

আড়াই বছরের মেয়ে সেলফি তুলছে ফোনে। ১৭-১৮ বছরের ছেলেমেয়েরা বেড়াতে গিয়ে ইন্টারনেট কানেকশন না পেলে অস্থির হয়ে উঠছে। বহু অভিভাবকই এখন গর্ব করে বলে বেড়ান সে সব কথা। সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক রুচিরা ঘোষ মনে করেন, ‘‘স্মার্টফোন ডেকে আনতে পারে আরও নানা বিপদ। ইন্টারনেট পর্নোগ্রাফি ছড়িয়ে যাচ্ছে স্মার্টফোনের হাত ধরেই।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাবা-মায়েরা এই সব প্রযুক্তি ততটা বোঝেন না বলে তাঁদের চোখে ধুলো দেওয়াটাও সহজ।’’ এ ক্ষেত্রে বাবা-মায়েদেরও এই সব বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকা জরুরি বলে রুচিরাদেবীর অভিমত। অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির দায়িত্ব রয়েছে স্কুলেরও। ‘‘সন্তানের জীবনে অতিরিক্ত নাক না গলিয়েও নজরদারি সম্ভব’’— বললেন তিনি।

একটা সময়ে এই আসক্তি ছিল শুধু শহুরে সমস্যা। এখন কিন্তু তা শহরতলি, এমনকী গ্রামেও ছড়িয়েছে। আর এতেই রীতিমতো ভয় পাচ্ছেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। মনে করছেন, ‘‘এটা এক ধরনের ‘লাইফস্টাইল ক্রাইসিস’, যা থাবা বসাচ্ছে বিভিন্ন বয়সে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘অনেকে মনে করেন, বই পড়ার অভ্যাস কমে যাওয়ায় এটা হচ্ছে। কিন্তু আমি তা মনে করি না। পৃথিবীতে বহু মানুষ বই না পড়েও দিব্যি সুস্থ ভাবে বেঁচে আছে। কিন্তু আমরা পারছি না। অথচ যে সব দেশ অনেক আগে এই প্রযুক্তি পেয়েছে, তারা এই আসক্তিটা কাটিয়ে উঠেছে।’’

না মেনে উপায় নেই, জীবনের বহু ক্ষেত্রেই স্মার্টফোন এখন বড় সহায়। কিন্তু তাকে কতটা ব্যবহার করা হবে, আর কতটা তার দ্বারা ব্যবহৃত হতে হবে, সেই রাশটা অনেক সময়েই নিজের হাতে থাকে না। আসক্ত হতে হতে নিজের জীবনের লাগামটা চলে যায় প্রযুক্তির হাতে। সেটা কতটা মেনে নেওয়া যায়? তরুণ অভিনেতা ঋদ্ধি সেন নিজে ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে থাকলেও কোনওটাতেই বেশিক্ষণ সময় কাটাতে চান না। তাঁর কথায়, ‘‘কলকাতায় উড়ালপুল ভেঙে পড়ার পরেও যেখানে অনেকে ফেসবুকে পাউট করা ছবি পোস্ট করেন, সেই মাধ্যমটায় আমি অন্তত খুব বেশি স্বচ্ছন্দ নই।’’

কবি শ্রীজাত বললেন, ‘‘আমার কাছে এটা একটা কাজের জায়গা। আবার, আমি ২৫ দিন এর থেকে বাইরেও চলে যেতে পারি। সমস্যা হবে না। কিন্তু এই নিয়ন্ত্রণ অনেকেরই থাকে না। এখনকার ছেলেমেয়েদের উপরে বাড়ির নজরদারিতে কোথাও একটা বড় গলদ থেকে গেছে।

যদি ছেলে বা মেয়ে সারাক্ষণ ট্যাব হাতে বসে থাকে, তা হলে তাতে গর্বের কিছু নেই. এই বোধটা বাবা-মায়ের মধ্যে আসাটা জরুরি।’’ শ্রীজাত-র অভিজ্ঞতা, ‘‘কাঞ্জনজঙ্ঘা দেখতে দেখতেও অনেকে সমানে ফেসবুক করে যায়। তার কাছে ওই মুহূর্তে কাঞ্চনজঙ্ঘা গুরুত্বপূর্ণ নয়, সে যে কাঞ্চনজঙ্ঘার সামনে বসে আছে তা লোককে জানানোটা জরুরি।’’

শীর্ষেন্দুবাবুর প্রশ্ন, ‘‘সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং যদি করতেই হয়, তা হলে রাস্তাঘাটে মানুষের সঙ্গে মেশো, এই কথাটা সন্তানকে বলা এবং নিজের জীবনে মানার দায়িত্ব তো বাবা-মায়েরই। কিন্তু তা করেন ক’জন?’’

করেন না। আর তাই গোটা পরিবার জুড়েই একটা সমান্তরাল অস্তিত্ব তৈরি করে স্মার্টফোন। আমিত্বের আবরণ বড় হয়ে উঠে গৌণ হয়ে যায় প্রত্যেকের আসল ‘আমি’-টা।

আনন্দবাজার পত্র্রিকা/এইচজে


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ