বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১১ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫


হুসাইন আহমদ মাদানি রহ. কে গালি দেয়ায় খাদেমকে হজরত থানভি রহ. এর ৩ শাস্তি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

নিহার মামদুহ

৪৭ সালের কথা। পুরো ভারতবর্ষ তখন দেশ ভাগের উত্তেজনায় কাঁপছে। ভয়, শঙ্কা ও স্বাধীনতার মিশ্র প্রতিক্রিয়া সবার মনে। তখন মাদরাজে মুসলিম লীগের পক্ষে উলামাদের বিশাল জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হলো।

এক মাওলানা বক্তৃতায় উঠেই বলতে শুরু করলেন, ‘ইহুদিদের দালাল মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানিকে প্রত্যাখ্যান করুন, মাদরাজ থেকে কংগ্রেসের এই পা চাটা গোলামকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হোক, মহাত্মা গান্ধির দরবারি … এর ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে দৌড়ঝাঁপ আর সহ্য করা হবে না। এরপর বক্তা হজরত মাদানি রহ. কে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করলেন।

সভার সভাপতি ছিলেন থানভি রহ. এর অন্যতম খলিফা মাওলানা নুরুল হক মাদরাজি। তিনি দাঁড়িয়ে তার মাইক কেড়ে নিলেন এবং কড়া ভাষায় এর তীব্র পতিবাদ করলেন।

ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে উন্মাদ তরুণ আলেমরা তখন নুরুল হক মাদরাজির উপর ক্ষেপে গিয়ে স্লোগান দিতে থাকে দালাল দালাল বলে। তারা বলতে থাকে ‘কাফের মাদানির দালালরা হুশিয়ার সাবধান! খেলাফত প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সহ্য করা হবে না! লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান! পাকিস্তান জিন্দাবাদ!! আরও কতো কি।

তখন মাওলানা নুরুল হক মাদরাজি মাইকে ঘোষণা দিলেন, ‘যে রাজনীতিতে আওলাদে রাসুল হজরত হুসাইন আহমদ মাদানির বিরুদ্ধে কথা বলতে হয়, আমি সেই রাজনীতি থেকে ইস্তফা দিলাম।’
তিনি মনের দুঃখ ও ক্ষোভ নিয়ে থানভি রহ. এর দরবারে রওয়ানা হলেন।

গভীর রাত। থানভীর খানকার বারান্দায় এসে বসলেন। এ সময় বাইরে বেরিয়ে এলেন হজরত থানভি রহ. দরবারের একজন খাদেম সুলায়মান। সুলায়মান মাওলানা নুরুল হক মাদরাজির খোঁজ-খবর নিলেন। নিজের রুমে নিয়ে গেলেন। মাওলানা নুরুল হক তাকে মাদরাজের সভায় মাওলানা মাদানিকে গালাগালি ও কটুক্তির কথা বললেন।

শুনে খাদেম সুলায়মান বলতে লাগলো, ‘ওহ তু ভি মোনাফেক হু, মাদানি তো কংগেসি কা দালাল হু। সে হিন্দুদের পা চাটা গোলাম, ইহুদি কি চর হায় ইত্যাদি ইত্যাদি।

সাথে কিছু আলেমের দলিল ভিত্তিক কিছু ফতোয়া দেখালো। যাতে বলা হয়েছে কি কি কথার কারণে তার উপর কুফরি ফতোয়া দেয়া হয়েছে। মাওলানা নুরুল হক মাদরাজি যে কষ্টের আগুন বুকে নিয়ে এসেছিলেন, খাদেম সুলায়মানের মাদানিকে গালি দেয়াতে তা আরও বেড়ে গেলো।

তিনি বললেন, ভাই মাদানি কী অনেক বড় আলেম নন? সুলায়মান উত্তর দিল, এলেম তো শয়তানেরও ছিল? মাদরাজি বললেন, তিনি কি দেওবন্দের বড় আলেম নন? তিনি কি শায়খুল হিন্দের খলিফা নন? তিনি কি একজন বুজুর্গ নন?

সুলায়মান উত্তর দিল, এক সময় শয়তানও বড় বুজুর্গ ছিলো? বললো হজরত! আপনি তার পক্ষে কথা বললে, আপনাকেও বাতিল বলবেন সকল আহলে হক উলামায়ে কেরাম। দালালের পক্ষে কথা বলবেন না হজরত। পাকিস্তানে খেলাফত প্রতিষ্ঠা নিয়ে হক বাতিলের লড়াই চলছে।

রাগে ক্ষোভে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। সারা রাত মানসিক যন্ত্রণায় কাটানোর পর মসজিদে ফজর পড়লেন। ফজরের পর হযরত থানভি রহ. মসজিদে বয়ান রাখলেন।

বয়ানে তিনি একটি ঘটনা বর্ণনা করলেন, ‘এক লোক আমার কাছে চিঠি লিখেছে খানকায়ে মাদানিতে বড় বড় দোষ ক্রুটিও মার্জনীয়। কিন্তু আপনার খানকাতে সামান্য দোষ ক্রুটি হলেই ধরে ফেলেন কেন? আমি উত্তরে বলেছি, মাদানির খানকা সাগরের মতো, আর আমার খানকা কূপের (কোয়া) মতো। সাগরে হাতি পড়ে মারা গেলেও পানি নাপাক হয় না, কিন্তু কূপে বিড়াল পরে মারা গেলেও পানি নাপাক হয়ে যায়।’

থানভির এই কথা শুনেই মাওলানা নুরুল হক মাদরাজি দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি বললেন, এসব আপনার মনের কথা না মুখের কথা। তার কথা শোনার পর বয়ান শেষ করে সবাইকে বিদায় দিলেন আর মাদরাজিকে মসজিদে বসালেন।

থানভি বললেন, তুমি কি থানভিকে কখনো মুনাফিকি করতে দেখেছো? মাওলানা মাদরাজি ঘটনা খুলে বললেন। মাদরাজের সভায় মাদানিকে গালিগালাজ,তার প্রতিবাদ, ইস্তফার ঘোষণা। রাতে খানকায় খাদেম সুলায়মানের সব কথা খুলে বললেন।

থানবি রহ. ডেকে খাদেম সুলায়মানকে আনলেন, নুরুল হক মাদরাজিকে সুলায়মান কি বলেছে তা পুনরায় তার সামনে বলতে বললেন। তিনি বললেন।

হজরত আশরাফ আলি থানভি রহ. জিজ্ঞেস করলেন, ঘটনাকি সত্য, তুমি কি মাদানি সম্পর্কে এসব বলেছে। সুলায়মান বললেন, হা বলেছি। থানভি রহ. দুজন লোককে ডেকে এনে বললেন, ‘তাকে (সুলায়মান) কানে ধরে পুরো থানাভবনে এলাকা চক্কর দেয়াবে। তারপর সোজা গাড়িতে তুলে দিবে।’
আর তার উপর ৩টি ফরমান জারি করলেন, ১. কখনো আমাকে সালাম করবে না, ২. কখনো মাফ চাইতে সামনে আসবে না, ৩. কাউকে দিয়ে কোন সুপারিশ করাবে না।

আর শাগরিদদের থানভি রহ. বলে দিলেন, তোমরা মুসলিম লীগের সমর্থক সবাইকে জানিয়ে দাও, যে রাজনীতিতে মাওলানা মাদানিকে গালিগালাজ করা হবে, আক্রমণ করে কথা হবে, হজরত মাদানির গিবত, তহমত দেয়া হবে আমি সে রাজনীতিতে নেই। এসব বন্ধ হলে তারা আমাকে পাশে পাবে।
থানভি রহ. এর এ ঘোষণায় আলেমদের মধ্য মুখোমুখী অবস্থান নিয়ে যে বিরোধ চলছিলো তা সহসা থেমে গেলো।

সৌজন্য : মুফতি মুহাম্মদ সালমান


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ