আতাউর রহমান খসরু
বার্তা সম্পাদক
দৃশ্য-১
আম্মু আমি একটু ব্যস্ত আছি। পরে তোমাকে ফোন দিবো।
তোর বাবা বলেছে…
রুমে ফিরে তোমাকে ফোন দিবো।
আচ্ছা! দিস মনে করে।
আর বলিস না আম্মু ফোন দিয়েছিল। চল যাই…
রাফি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাড়ি বগুড়া শহরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকে সে। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ায় তাকে নিয়ে বাড়তি উৎকণ্ঠায় থাকেন তার মা তাহেরা বেগম। প্রতিদিন দুই-তিন বার ফোন না দিলে তিনি স্বস্তি পান না।
কিন্তু রাফির কাছে বিষয়টা বেশ বিরক্তির। বন্ধুরা মায়ের ফোন নিয়ে হাস্য-রসে অনেক কথা বলে। ঠাট্টা করে বাবুও ডাকে তাকে। কারণ, তাদের মায়েরা সপ্তাহান্তে একবার দেন আবার কারো মা তাও দেন না। তারাও বিনা প্রয়োজনে মনে করে না বাবা-মাকে।
এ চিত্রটা শুধু রাফির না। এটি তরুণ প্রজন্মের সাধারণ চিত্র। প্রযুক্তিনির্ভর তরুণরা এখন পরিবার ও সমাজ বিমুখ। প্রযুক্তি পৃথিবীর ভৌগলিক দূরত্ব কমিয়ে দিলেও হৃদয়ের দূরত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছে দিন দিন। এখন এক ছাদের নিচে বাস করেও দিব্যি গুছিয়ে নেয়া যায় নিজের জীবন নিজের মতো করে। তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ সুযোগ করে দিচ্ছে পরিবারের বাইরে বিশ্বব্যাপী বন্ধুপরিধি গড়ে তোলার।
আধুনিক প্রযুক্তি এভাবে তেপান্তরের অপারের মানুষ কাছে টানছে আর দেয়ালের ওপাশের মানুষকে দূরে ঠেলছে।
দৃশ্য-২
জায়েদ! ঘুমের সময় এখানে কী?
উস্তাদজি আম্মুর সাথে কথা বলবো।
কাল না বাসায় কথা বললে?
জি! উস্তাদজি। দরকার …
আজ আর হবে না। প্রতিদিন এতো কি কথা! যাও ঘুমাও। বড় হুজুর বলেছেন, ছাত্ররা সপ্তাহে একবারের বেশি বাসায় কথা বলতে পারবে না।
[জায়েদ মাথা নিচু করে চলে গেলো। কিন্তু তার আর ঘুম আসলো না। গভীর রাত পর্যন্ত মাকে মনে করে কাঁদলো।]
জায়েদ দেশের একটি স্বনামধন্য মাদরাসার ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। তার মাদরাসায় হোস্টেলে থাকার অভিজ্ঞতা নেই। এ মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার পূর্বে সে বাড়ির পাশে একটি প্রতিষ্ঠানের অনাবাসিক ছাত্র ছিলো। পরিবারে সবার ছোট বলে মা তাকে গালে তুলে খাইয়ে দিতো, ঘুমের সময় গায়ে কাঁথা দিয়ে মশারি টানিয়ে দিতো, গোসলের পর কাপড় ধুয়ে দিতো। কিন্তু এখন সব কাজ তাকেই করতে হচ্ছে।
জায়েদের মাদরাসায় ফোন ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। নির্ধারিত শিক্ষকের মাধ্যমেই কেবল তারা পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। তাও সপ্তাহে একবার।
জায়েদের মাদরাসার সিনিয়র ছাত্ররা বিকেলে বাইরে যাওয়ার সুযোগ পায়। মাদরাসার সামনের ফোন-ফ্যাক্সের দোকান থেকে তারা পরিবারের সাথে কথা বলে। কিন্তু অতিরুক্ত ভিড়ের কারণে সবসময় হয়ে ওঠে না। আবার সবাই যে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে আগ্রহী তাও নয়। তাদের অনেকেই হয়তো প্রতিদিন বের হয় কিন্তু পরিবারের সাথে কথার বলার প্রয়োজনবোধ করে না।
উপরের দুটি দৃশ্যের কোনোটিই আমাদের জন্য কাম্য নয়। বরং প্রয়োজন সম্পর্কের ভারসাম্য। একদিকে যেমন লক্ষ্য রাখতে হবে প্রযুক্তি সন্তানকে পরিবার ও সমাজ থেকে যেনো বিচ্ছিন্ন করে না ফেলে। অন্যদিকে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে পরস্পরের দূরত্ব ঘোঁচাতে। প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে নিঃসন্দেহে তা হবে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য আশির্বাদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম এ কথাই বলেছেন। তার মতে, প্রযুক্তি আসলে নিরপেক্ষ। প্রযুক্তির তো কোনো দোষ নেই। বিষয়টি হলো এর অপব্যবহার। প্রযুক্তি আসলে কোন শ্রেণীর হাতে যাচ্ছে এটাই এখানে বিবেচ্য বিষয়।
শিশুদের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রযুক্তি শিশুদের মেধাবিকাশে সহায়তা করলেও, মানসিক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। এটি অনেক ক্ষেত্রে সমাজ জীবনে একাকিত্ব তৈরি করে ফেলছে এবং সঠিক সামাজিকীকরণে সহায়ক হচ্ছে না। [দৈনিক যুগান্তর, ২২ এপ্রিল ২০১৬]
প্রযুক্তির প্রতি আসক্তিকে বলা হয় ডিজিটাল কোকেন। এ কোকেন তরুণ প্রজন্মকে বাস্তবভিত্তিক সম্পর্ক থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। ফলে তারা আপনজন আত্মীয়-স্বজন থেকে বিমুখ হয়ে এমন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে তার কোনো বাস্তব ভিত্তি ও ভবিষ্যত নেই। নষ্ট করছে জীবনের মহামূল্যবান সময়।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক মনোকিচিৎসক ডা. তাজুল ইসলামের মতে যে কোনো সম্পর্কের ভিত্তি হতে হবে বাস্তবতা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে প্রযুক্তি আসক্তি আমাদের এটি থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। তাই নিজের অজান্তেই আমরা অনেক অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। এছাড়া অধিক প্রযুক্তি আসক্তি মেধাবিকাশ, ক্যারিয়ার গঠন এবং পরিশ্রম কম করায় শারীরিক সমস্যারও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। [দৈনিক যুগান্তর, ২২ এপ্রিল ২০১৬]
কিন্তু শিশু-কিশোর ও তরুণদের প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি বাড়ছে কেনো? যা তাকে পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। বিবিসি বাংলা তার এক প্রতিবেদনে এর কারণ অনুসন্ধান করে। তাতে দেখা যায়, শিশুকে যথাযথ সময় না দেয়ার কারণেই শিশু পরিবার বিমুখ প্রযুক্তি নির্ভর জীবন বেছে নিচ্ছে।
প্রতিবেদনের ভাষ্য মতে, শহরের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারে বাবা-মা উভয়ে কর্মজীবী। ফলে শিশু তার বাবা ও মা কাউকে কাছে পায় না। সে একাকী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যায়। একাকী জীবনে তার সঙ্গী হয় আধুনিক প্রযুক্তি। বাবা-মাও বাইরে যাওয়ার চেয়ে কম্পিউটার, গেমস ও ইউটিউবে বাচ্চার সময় কাটানোকে নিরাপদ মনে করেন। শৈশবের এই একাকিত্বই পরবর্তী জীবনে তাকে পরিবার বিমুখ করে রাখে। [বিবিসি বাংলা, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬]
ঢাকার একটি বেসরকারি মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন মাওলানা আতিকুল ইসলাম। তার মাদরাসায় শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। তবে প্রতিদিন আসরের পর থেকে মাগরিবের পূর্ব পযন্ত মাদরাসার পক্ষ থেকে ফোন করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম মাদরাসায় মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ কেনো? তিনি বলেন, আমরা মনে করি, মোবাইল ফোন শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় মারাত্মক রকমের ব্যঘাত ঘটায়। কারণ বর্তমান সময়ের স্মার্ট ফোনে এতো বেশি সুযোগ সুবিধা রয়েছে যে কোনো ছেলের হাতে মোবাইল ফোন থাকার অর্থ হলো পুরো দুনিয়া তার পকেটে থাকা।
মোবাইল ফোন পকেটে রেখে পড়ায় মনোযোগী হওয়া খুবই কঠিন। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের বয়স ও বুদ্ধি অপরিণত। তাই তারা মোবাইল ফোনের ইতিবাচক ব্যবহারের চেয়ে নেতিবাচক ব্যবহার বেশি করে।
তবে তার মতে শিশুদের বয়স অনুপাতে তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা করা উচিৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। পরিবারের সাথে যোগাযোগ রক্ষা না করলে পরিবারের প্রতি মায়া-মমতা-টান ও আনুগত্য লোপ পায়।
বয়স অনুপাতের ব্যাখ্যা দাবি করলে তিনি বলেন, যে শিশুটার বয়স ৫-৭। সে হয়তো নার্সারি থেকে ক্লাস টুতে পড়ে। তার তো মায়ের কাছেই থাকার কথা ছিলো। তার জন্য প্রতিদিন বাসায় কথা বলার সুযোগ করে দেয়া প্রয়োজন। প্রতিদিন সম্ভব না হলে অন্তত একদিন পর একদিন কথা যেনো সে বলতে পারে। এ বয়সের বড় যারা তাদেরও উচিৎ সপ্তাহে অন্তত দুয়েকদিন পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখা।
মাওলানা আতিকুল ইসলাম স্বীকার করেন, ইচ্ছে থাকার পরও তার ঘোষিত রুটিন অনুযায়ী যোগাযোগের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় না। কারণ, সপ্তাহে একদিন বা দুইদিনের বাধ্যবাধকতা না থাকলে সবাইকে পরিবারের সাথে যোগাযোগ করার সুযোগ দেয়া যাবে না।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন মুহাম্মদ মাকসুদুর রহমান। তিনি এখন আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সের খুলনা আলিয়া শাখার হাদিস বিভাগের প্রভাষক। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম মা-মায়ের সঙ্গে প্রতিদিন তার কথা হয় কিনা? তিনি বলেন, প্রতিদিন না হলেও দুই থেকে তিনদিন পরপর পরিবারের সাথে তার কথা হয়।
তবে তিনি স্বীকার করেন তার সহকর্মী, সহপাঠী ও শিক্ষার্থীদের অনেকেরই পরিবারের সাথে যোগাযোগ নিয়মিত নয়। তার মতে এর কারণ একপক্ষীয় নয়। পরিবার ও সন্তান উভয় নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। যোগাযোগের প্রয়োজনটা কেউ-ই বোধ করেন না। এছাড়াও তিনি ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব, উপস্থিত সম্পর্ককে অধিক গুরুত্বপ্রদান ও অনৈতিক সম্পর্কে আসক্তিকে পরিবার থেকে বিমুখ হওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা। বিশেষত বাবা-মায়ের খোঁজ-খবর নেয়ার ব্যাপারে ইসলামের বিধান কি? ইসলাম সম্পর্ক রক্ষার বিষয়টি দ্বিপাক্ষিক হিসেবেই উল্লেখ করেছে। বাবা-মা ও সন্তান উভয়ের দায়িত্ব পারস্পারিক যোগাযোগ রক্ষা করা। সন্তান বুঝমান ও বড় হওয়া পযন্ত তার সার্বিক খোঁজ-খবর নেয়া পিতা-মাতার দায়িত্ব আর সন্তান বড় হলে তার দায়িত্ব পিতা-মাতার খোঁজ খবর রাখা।
এজন্য আল্লাহ তায়ালা দোয়া শিখিয়েছেন, ‘হে প্রভু! আমার পিতা-মাতা শৈববে যেমন আমার উপর অনুগ্রহ করেছেন আপনি এখন তাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন।’ [সুরা ইসরা, আয়াত : ২৪]
কিন্তু বাবা-মা বা সন্তান যদি কেউ তার দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে? তাহলে রাসুল সা. এর নির্দেশনা হলো, ‘যে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তার সাথে তুমি সম্পর্ক স্থাপন কর।’ [মুসনাদে আহমদ]
জীবন সাজাতে অনন্য অ্যাপ ইসলামী যিন্দেগী ইনস্টল করুন আপনার মোবাইল ফোনে
অর্থাৎ একপক্ষ যদি যোগাযোগ রক্ষা না করে তবে অপরপক্ষের দায়িত্ব হলো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা এবং খোঁজ-খবর নেয়া।
আরবি ভাষার বিখ্যাত ইসলামিক ওয়েব সাইট ‘ইসলাম ওয়েব’ এক ফতোয়ায় বলেছে, মোবাইল ফোনের যোগাযোগ আত্মীয়তা রক্ষার অন্তর্ভূক্ত হবে তবে তা দ্বিতীয় স্তরের যোগাযোগ বলে গণ্য হবে। তাই বলা যায়, পারিবারিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ রক্ষায় প্রযুক্তি অবশ্যই আদর্শ মাধ্যম নয়।
হাদিস শরিফের বর্ণনা থেকে জানা যায়, রাসুল সা. কোনো মাধ্যম ছাড়াই তার কন্যাদের খোঁজ নিতেন, স্বশরীরে তাদের বাড়ি যেতেন। রাসুল সা. এর ছেলে ইবরাহিমকে মদিনার উপকণ্ঠে দুধপান করাতে দেয়া হয়। রাসুল সা. তাকে নিয়মিত দেখতে যেতেন। মুহাদ্দিসগণের মতে তা ছিলো সপ্তাহে এক থেকে দুইবার।
এ হাদিসের শিক্ষা হলো, সপ্তাহে অন্তত দুয়েকবার মা-বাবার সঙ্গে দেখা করা উচিৎ। আর সেটা সম্ভব না হলে ফোনে তাদের সাথে কথা বলা আবশ্যক।
এ বিষয়ক একটি চমৎকার হাদিস শায়খ আলবানি রহ. তার সহিতে অন্তর্ভূক্ত করেছেন। হাদিসটি হলো, ‘তোমাদের সম্পর্ককে সতেজ কর; তা সালামের বিনিময়ে হলেও।’
অর্থাৎ দূর থেকে সালাম বিনিময় করে হলেও তোমাদের পারস্পারিক সম্পর্কটা ঝালাই করে নাও। আধুনিক যুগে তার অর্থ প্রযুক্তির ব্যবহার নিলে হয়তো ভুল হবে না। আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।
এটিও পড়ুন: বাংলাদেশের ৬ ভাই : যে বাগানে ফুটেছে জোড়া ফুল