হুমায়ুন আইয়ুব
সম্পাদক
দাওয়াত ও তাবলিগের সূচনা ভারতের মেওয়াতে। ১৯২০ এর দশকে। আজ বিশ্বময় ছড়িয়ে আছে তাবলিগি চিন্তার কোটি মানুষ। মানুষের হৃদয়রাজ্য দখল করে আছে তাবলিগ। সাগর নদী আর পাহাড়ের ঢেউয়ে কিংবা আফ্রিকার গভীর জঙ্গলেও তাবলিগের সিলেবাস ‘ফাজায়েলে আমাল’ এবং ‘ মুন্তাখাব হাদিসের’ তালিম হয়। পাঁচ উপমহাদেশেই চলে দাওয়াতের এই কাজ।
পৃথিবী জুড়ে লা’ইলাহা ইল্লাল্লাহর দাওয়াত নিয়ে ঘরে ঘরে, জনে জনে কাজ করছে এই তাবলিগ জামাত। মদিনার নবী হজরত মুহাম্মদ সা. এর কলজেছেঁড়া উম্মতের দরদ নিয়ে কাজটি শুরু করেছিলেন হজরতজি মাওলানা ইলিয়াস রহ.। তিনি ছিলেন দারুল উলুম দেওবন্দের চিন্তা-চেতনার আদর্শের সন্তান। হজরতজি মাওলানা ইলিয়াস রহ. এর অন্তরে ছিল উম্মতের মায়ার দগদগে ক্ষত। হজরতজির ভেতর থেকে উম্মতের মায়ায় কলজেপোড়া গন্ধ আসত।
এতিম নবীর পথভোলা উম্মতকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর জন্য সহজ, সরল, মোটা মোটা অথচ দামি কথা বলে মানুষকে দীন ও হেদায়াতের পথে ডেকেছেন তিনি। প্রায় শতবর্ষী তাবলিগের এই পথে এসে আজও লাখ লাখ মানুষ নিজের জান, মাল ও সময় ব্যয় করে দীন শিখছেন। অন্যদেরও উৎসাহিত করছেন হেদায়াতের এই নির্মল মেহনতে শরিক হয়ে।
বিশ্বজোড়া কালেমার মৌমাছিরা প্রতি বছর জড়ো হয় ঢাকায়। টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায়। তুরাগ তীরে কালিমার বাগানের সন্ধানে উড়ে আসে লা’ইলাহা ইল্লাল্লাহর মৌমাছিরা। ফুলে ফুলে খুশবু ছড়ায় লা’ইলাহা ইল্লাল্লাহর।
সম্প্রতি তাবলিগ জামাতের নীতি নির্ধারণী মহলে কিছু মান-অভিমান শুরু হয়েছে। এটাকে সাময়িক সঙ্কট হিসেবে ধরা যেতে পারে। মনে রাখার মতো বিষয় হলো, পৃথিবীর ৫৫টি মুসলিম রাষ্ট্র তো বটেই; ইউরোপ-আমেরিকাসহ পাঁচ উপমহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে তাবলিগের মেহনত। হালে ভারত উপমহাদেশে তাবলিগের স্বর্ণযুগ চলছে। সঙ্কটটাও ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশেই প্রকট।
তবে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের লাল-সবুজের এক টুকরো মানচিত্রে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব ইজতেমা। গরিব অথচ উদার এদেশের মানুষ! অভাবী অথচ সাহসী এদেশের রাষ্ট্রনায়কগণ! অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে তুরাগতীরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্ব ইজতেমা। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করে আসছে যুগ যুগ ধরে।
উজ্জ্বল করছে লাল-সবুজ পতাকার সম্মান। সমুন্নত করছে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা। ইজতেমার এই ঐতিহ্য ও গৌরব আমরা ধরে রাখতে চাই। বুক উঁচু করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এদেশের এই গৌরবগাঁথা স্মরণ রাখতে চায়। এঁকে যেতে চায় নীতি-নৈতিকতাপূর্ণ একটি আদর্শিক বাংলাদেশের ছবি।
এবারও দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্ব ইজতেমা। প্রথম পর্বে রোববার মুনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয়েছে। আগামী ১৯, ২০, ২১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা। চারদিকে এখন আলোচনার বিষয় চলমান সঙ্কট।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার কাকরাইল তাবলিগের মারকাজ। এদেশে তাবলিগের কাজ পরিচালিত হয় এ মারকাজ বা কেন্দ্র্র থেকে।
ইনস্টল করুন হাজারও বয়ান ও কিতাবে অ্যাপ
কাকরাইল মারকাজে তাবলিগের কাজ পরিচালনায় ১১ জনের একটি শুরা কমিটি আছে। সম্প্রতি ৫জন বিজ্ঞ আলেমকেও শুরার উপদেষ্টা মনোনীত করা হয়েছে।
কাকরাইল ও তাবলিগ তার নিজস্ব গতিতেই চলবে। সেভাবে চলতে দেওয়াও উচিত। কোনো ব্যক্তি বা মহলের প্রভাবে তাবলিগের কাজ যেন ব্যহত না হয় সেদিকে সবার সতর্ক দৃষ্টি রাখা সময়ের দাবি। কারও অনৈতিক প্রভাব বা প্রচ্ছন্ন খামখেয়ালিপনায় দাওয়াত ও তাবলিগের এই কাজ বাধাগ্রস্ত হলে কেয়ামতের মাঠে আল্লাহর আদালতে জবাবদিহি করতে হবে।
সরকারের গভীর আন্তরিকতা, ৫ আলেম উপদেষ্টা কমিটির নির্মোহ চিন্তা, কাকরাইলের শুরা সদস্যদের এখলাস ও সব রকমের মোহত্যাগ এবং প্রতিনিধিত্বশীল আলেমদের দায়িত্বশীল ও সুচিন্তিত মতামতেই এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করি। সবার সম্মিলিত চেষ্টা ও আন্তরিকতায় তাবলিগে বইতে পারে শান্তির সুবাতাস। গড়ে উঠতে পারে সম্প্রীতিপূর্ণ উম্মাহর একটি বৃহৎ ঐক্য।
ভুলে গেলে চলবে না, দাওয়াত ইলাল্লাহ কেয়ামত পর্যন্ত চলমান একটি বিষয়। সুতরাং বিশ্ব ইজতেমা ও কাকরাইলের চলমান সংকট স্থায়ী হবে না। সৃষ্ট এ সাময়িক সঙ্কটে হতাশারও কিছু নেই। তাবলিগ জামাত বিশ্বব্যাপী একটি খাঁটি দীনি মেহনত। কোটি কোটি মানুষের জীবন বদলের অন্যতম মাধ্যম। সৃষ্ট জটিলতাগুলো সাময়িক। ধীরে ধীরে সমস্যা কেটে উঠবে। দাওয়াত ও তাবলিগের এই কাজ তার নিজস্ব গতিতেই চলবে বিশ্বময় ইনশা আল্লাহ ।
দুই
এ দেশের সরকার তাবলিগের সংকট সমাধানে খুবই আন্তরিক এবং কোনো অনৈতিক হস্তক্ষেপেরও পক্ষে নয়। বরং সঙ্কট সমাধানে ভরপুর সহযোগিতা করছে। হজরত ওলামায়ে কেরাম, কাকরাইলের মুরুব্বিগণ ও সারাদেশের তাবলিগের সাথীদের মাঝে আন্তরিক এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক চলমান আছে এবং থাকবে। কোনো অপশক্তিই কোনোরকম ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়ে দীনি এই কাজকে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। ওলামায়ে কেরাম ও তাবলিগের সাথীদের মাঝেও দূরত্ব তৈরি করতে পারবে না।
বিশ্ব ইজতেমার পাশাপাশি সারাদেশে অঞ্চলভিত্তিক ইজতেমাও চলছে। তাবলিগের সাথী ও হজরত ওলামায়ে কেরামের কাছে আরও দায়িত্বশীল আচরণ আশা করে ধর্মপ্রাণ মানুষ।
এখলাস ও লিল্লাহিয়াত এবং পরস্পরে জোড় মিল মহব্বতের সঙ্গে কাজ করাই কাম্য। এ বিপর্যয়ে একে অপরকে আপন-আপন ও ভাই-ভাই মনে করে দরদি দিল নিয়ে তাবলিগের কাজ করার অনুরোধ করা ছাড়া আর কী-ই বা বলতে পারি।
তিন
চলমান সংকটের মূল বিষয় দুটি- ক. কাকরাইলের অভ্যন্তরীণ শুরার সদস্যদের দূরত্ব।
খ. বিশ্বের কেন্দ্রীয় মারকাজ দিল্লির নিজামুদ্দিনের মুরুব্বি হজরত মাওলানা সাদ কান্দলভির কিছু বয়ানে আপত্তির অভিযোগ।
বিষয় দুটিকে সামনে রেখে বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপির ধানমণ্ডির বাসায় গত ২৯ অক্টোবর রাতে ত্রিপাক্ষিক একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে কাকরাইলের শুরার সব সদস্য, দেশের শীর্ষ কয়েকজন আলেম এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব, সেতু সচিবসহ সরকারের বেশ কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। দীর্ঘ আলোচনা-পর্যালোচনার পর উপর্যুক্ত দুটি বিষয় সমাধানে দুটি কমিটি গঠন করা হয়।
কাকরাইলের অভ্যন্তরীণ সংকটের সমাধানে ৫ সদস্যের একটি কমিটিও করা হয়।
উপদেষ্টা ৫ জন সদস্য হলেন- কওমি মাদরাসা শিক্ষাবার্ড বেফাকের সিনিয়র সহসভাপতি আল্লামা আশরাফ আলী, যাত্রাবাড়ী জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া মাদরাসার মুহতামিম ও গুলশান আজাদ মসজিদের খতিব মহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমুদুল হাসান, শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ ও জামিয়া ইমদাদিয়া ফরিদাবাদের প্রিন্সিপাল মাওলানা আবদুল কুদ্দুস ও মারকাযুদ দাওয়াহর মাওলানা আবদুল মালেক।
কমিটির সমন্বয়ের যোগাযোগের জিম্মাদার করা হয় আল্লামা মাহমূদুল হাসানকে।
জলঘোলা হওয়ার প্রায় কাছাকাছি সময়ে মাওলানা সাদ কান্ধলভির বক্তব্য প্রত্যাহার নিয়ে ধুম্রজাল তৈরি হয়। মাওলানা মুহাম্মদ সাদ কান্ধলভি তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হজরতজি মাওলানা ইলিয়াস রহ. এর বংশধর। তাবলিগের কেন্দ্রীয় মারকাজ দিল্লি নিজামুদ্দিনের মুরব্বি!
কারও বক্তব্য ছিল- মাওলানা মুহাম্মদ সাদ কান্ধলভি আপত্তিকর বক্তব্য থেকে ফিরে এসেছেন। দেওবন্দও তার মতামত প্রত্যাহার করেছে।
বিপরীত পক্ষ বলছিল- না, মাওলানা সাদ তার আপত্তিকর মতামত প্রত্যাহার করেনি এবং দেওবন্দ তার ওপর সন্তুষ্ট নয়। দেওবন্দের অবস্থান জানার জন্যই মূলত আরও ৫ জনের একটি কমিটি করা হয়।
তারা হলেন- কাকরাইল মারকাজের শুরা সদস্য মাওলানা যুবায়ের আহমদ ও কাকরাইল মারকাজের শুরা সদস্য, সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার মুহাদ্দিস মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক এবং জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মোহাম্মদপুরের প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহফুজুল হক ও মাওলানা জিয়া বিন কাসেম। সপ্তাহব্যাপী তারা ভারত সফর করে এসে প্রতিবেদন পেশ করেছেন।
১৬ নভেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবনের বৈঠকের সূত্র ধরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ি মাদরাসায় ৫ আলেম সদস্যবিশিষ্ট কমিটি এবং কাকরাইলের শুরার সদস্যদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ৫ টি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিদ্ধান্তগুলো হলো-
এক. কাকরাইল মারকাজের সকল বিষয়ে যথারীতি আগের মতোই শুরার বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
দুই. দৈনন্দিন সাধারণ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিষয়ে আগের মতোই মুকিমরাও (কাকরাইলে স্থায়ীভাবে অবস্থানরত) শুরার বৈঠকে উপস্থিত থাকতে পারবেন।
তিন. বিশেষ তিনটি বিষয়ে (ক) কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে পরামর্শ (খ) অর্থনৈতিক বিষয়ক পরামর্শ (গ) সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনা সংক্রান্ত পরামর্শ অথবা এ ধরনের কোনও গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল সাময়িক বিষয়ে পরামর্শের সময় শুরার সদস্যগণ ব্যতীত মুকিম বা অন্য কেউ উপস্থিত থাকতে পারবেন না।
চার. কাকরাইলে আহলে শুরা এই বিষয়ে সর্বাত্মকভাবে একমত হয়ে ৫ জন আলেমকে নিজেদের পৃষ্ঠপোষক ও উপদেষ্টা হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
যখনই প্রয়োজন অনুভূত হবে অথবা উলামায়ে কেরাম প্রয়োজন মনে করবেন, তখন জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ এ উলামা কমিটির সামনে পেশ করবেন এবং তাদের ফয়সালাও মেনে নিবেন বলে জানান শুরার সদস্যবৃন্দ।
মনোনীত ৫ আলেম উপদেষ্ট হলেন, কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের কো-চেয়ারম্যান আল্লামা আশরাফ আলী, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলূম মাদানিয়া যাত্রাবাড়ির মুহতামিম ও গুলশান সেন্ট্রাল (আজাদ) মসজিদের খতিব আল্লামা মাহমুদুল হাসান, কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, আল্লামা আব্দুল কুদ্দুছ, শোলাকিয়া ঈদগাহের খতিব আল্লামা ফরীদ উদ্দিন মাসউদ, মারকাজুদ দাওয়াহর মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক।
পাঁচ. উলামায়ে কেরাম ও আহলে শুরার মধ্যে আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক যথারীতি কায়েম থাকবে। আসা-যাওয়া থাকবে। মহব্বত ও সৌহার্দ্য বজায় এবং মতবিনিময়ের ধারা অব্যহত থাকবে।
এদিকে হজরত মাওলানা সাদ কান্দলভীর কোন কোন বক্তব্যে আপত্তি করেছে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ। বাংলাদেশের শীর্ষ আলেমগণও দেওবন্দের মতামতকে শ্রদ্ধা দেখিয়ে কাকরাইলের মাধ্যমে একাধিকবার এসব আপত্তিকর বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছেন।
মাওলানা সাদ কান্দলভীর বিষয়ে ভারতের দেওবন্দের মতামতসহ প্রতিনিধি দল ফিরে এসেছেন। প্রতিনিধি দল ৬ জানুয়ারি শনিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপিসহ সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা ও শুরার আলেম উপদেষ্টাদের কাছে জমা দিয়েছেন তাদের প্রতিবেদন।
মাওলানা সাদের এবারের ইজতেমায় বাংলাদেশে আসা না-আসা অনেকটাই নির্ভর ছিল প্রতিনিধি দলের প্রতিবেদন ও সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর।
সবশেষে প্রতিবেদন নিয়েও মতপার্থক্য তৈরি হলে অনিশ্চিত হয়ে পরেন মাওলানা সাদের এবারের ইজতেমায় বাংলাদেশে আসা না-আসার বিষয়টি।
তাবলিগে সংকট : সমাধান মাওলানা সাদের হাতে!
সবার মতকে উপেক্ষা করে গত ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে আনা হয় মাওলানা মুহাম্মদ সাদ কান্ধলভিকে!
বাংলাদেশে এসেই তিনি বিমানবন্দরে তুমুল প্রতিবাদ প্রতিরোধ এবং বাধার মুখোমুখি হন। কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে মাওলানা সাদ কান্ধলভিকে কাকরাইল মারকাজে নিয়ে যাওয়া হয়। ইজতেমায় অংশ না নিয়েই তিনি গতকাল শনিবার দিল্লি ফিরে যান।
অবশ্য তিনি কাকরাইল মসজিদে নামাজের ইমামতি, দোয়া মুনাজাত ও বয়ানও করেছেন। আগামী ইজতেমার দিন তারিখও ঠিক করেছেন।
মাওলানা সাদ কান্ধলভি ইজতেমায় অংশ না নেয়া, বিপরীতে ঝড়ের গতিতে প্রতিবাদের মুখে পড়া নিয়ে তর্ক পড়ে করা যাবে। এ সঙ্কট সমাধানের কোনো পদ্ধতি আছে কিনা বিষয়টি নিয়ে ছোট্ট করে কথা বলতে চাই।
প্রথমত কথা হলো সমাধানের বিষয়টি একেবারেই মাওলানা সাদ কান্ধলভির হাতে। তার মতো এত মকবুল ও উঁচু বংশের মানুষকে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ প্রতিরোধ করে কোনো কথা বলা বা বুঝানো সম্ভব নয়। বরং মাওলানা সাদের নিজের আত্মমর্যাদা ও রুচিবোধের পরিচয় ছিল সব রকমের সমালোচনা ও সমালোচনার সুযোগ তৈরি হয় এমন কিছু থেকে বেঁচে থাকা।
সাম্প্রতিক এ ঘটনার উদাহরণ দেশ জাতি ও আলেমদের জন্য চরম হতাশা ও লজ্জার। মোটেও এ জাতীয় প্রতিবাদ প্রতিরোধ চর্চা কাম্য ছিল না। কিন্তু অনেকটা অপারগ হয়েই করতে হয়েছে আলেম ও তাবলিগের সাথীদের।
আমি মনে করি মাওলানা সাদের কাছে প্রকৃত তথ্য গোপন রাখা হয়েছে। তার ভক্ত বা অনুসারী বলে দাবিদারগণ এদেশের তাবলিগের সাথী আলেমদের মধ্যে বিরাজমান অস্থিরতার বিষয়টি পুরোপুরি তার কাছে উপস্থাপন করেননি। বরং কৌশলের আশ্রয় নিয়ে হজরতজি মাওলানা ইলিয়াস রহ. এর খান্দানকে তারা অপমান করেছেন।
সুযোগ সন্ধানী এ অনুসারীরা জজবা ও মহব্বতকে বাস্তবতার আলোকে বিবেচনা করেননি।
এদেশে আলেম উলামা মাদরাসার ছাত্র শিক্ষক এবং তাবলিগের সাথীরাও মন থেকে সেটা চায়নি। বরং গত দিনগুলোতে তার প্রতি বেশ শ্রদ্ধা ভক্তি ও ভালোবাসা দেখিয়ে আসছেন সবাই। বরং দুতিন বছর তার আপত্তিকর বক্তব্য এবং মুরব্বিদের সঙ্গে সমঝোতার প্রসঙ্গটি নিয়ে বারবার অনুরোধ বিনরোধ করা হয়েছে। তিনি বা তার আশপাশ বিষয়টিকে বুঝেননি। বা বুঝেও দুর্বলতার আশ্রয় নিয়েছেন। পেশিশক্তি ও কূটনীতির আশ্রয় নিয়ে এড়িয়ে গেছেন।
সঙ্কটাপন্ন এ করুণ মুহূর্তে মাওলানা সাদকে সরাসরি উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। উদ্যোগগুলোও খুব ছোট ছোট।
১. তিনি নিজেই উদ্যোগী হয়ে তার যেসব উস্তাদ ও মুরব্বি তাবলিগের কেন্দ্রীয় মারকাজ নিজামুদ্দিন থেকে বেরিয়ে গেছেন তাদের সঙ্গে জরুরিভিত্তিতে সাক্ষাৎ করবেন। মত বিনিময় করে তাদের নিজামুদ্দিনে ফিরিয়ে নিয়ে আসাই হবে মাওলানা সাদের সফলতা। এ কাজে তিনি কারও সহযোগিতা না নিয়ে সম্পন্ন করবেন।
তবে গুজরাটের হজরতজি মাওলানা আহমদ লাট, মাওলানা ইবরাহিম দেওলাসহ অন্য মুরব্বিদেরও মানসিকতার দিক থেকে উদারতার পরিচয় দিতে হবে। হজরতজি ইলিয়াস রহ. এর খান্দানের মর্যাদা এবং হজরতজির কাজের প্রতি তাদের গভীর দরদ থাকলেই সহজ সমাধান সম্ভব।
২. মাওলানা সাদ কান্ধলভির উচিত উম্মতের বৃহত্তর সার্থে দারুল উলুম দেওবন্দে যাওয়া, কথা বলা এবং সমাধান করা। তবে দেওবন্দ আমাদের আস্থা বিশ্বাস ও চেতনার বীজতলা। এ উপমহাদেশে দীন ধর্মের কেন্দ্রীয় অভিভাবক দারুল উলুম দেওবন্দ। বলতে বাধা নেই, যে যতবড় তার দায়িত্বও ততবেশি।
দেওবন্দের কাজ থেকে স্পর্শকাতর এ বিষয়ে আরও বেশি দায়িত্বশীল অভিভাবকসুলভ আচরণ প্রত্যাশা করেন ধর্মপ্রাণ মানুষ।
মাওলানা সাদ কান্ধলভির উচিত হবে তিনি দেওবন্দের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে দায়িত্বশীল আলেমদের সঙ্গে বসবেন। তার বিষয়ে যত আপত্তিকর বস্তু রয়েছে কোনো যুক্তিতর্ক ছাড়া প্রত্যাহার করবেন।
দেওবন্দের দায়িত্বশীল ওলামা এবং মাওলানা সাদ কান্ধলভির হাস্যোজ্জ্বল একটি ভোরের প্রত্যাশায় পুরো উম্মত।
৩. সম্প্রতি বাংলাদেশে তাবলিগের শুরার আলেম উপদেষ্টা কমিটি করা হয়েছে। মাওলানা সাদ কান্ধলভি এবার বাংলাদেশে এসে আলেমদের সঙ্গে বৈঠক করতেও আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। পরিস্থিতি বা সময় তাকে সহযোগিতা করতে পারেনি।
মাওলানা সাদ কান্ধলভি কোনো মাধ্যম ছাড়া হজরত ওলামায়ে কেরামের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, মতবিনিময়ের মাধ্যমে বিষয়গুলো সুষ্ঠু সমাধান করবেন। শুরার আলেম উপদেষ্টাগণ সঙ্কটাপন্ন এ পরিস্থিতিকে সামনে রেখে সুষ্ঠু সমাধান করবেন বলে আশা রাখি।
তবে দেশের আধ্যাত্মিক মুরুব্বি আল্লামা শাহ আহমদ শফীসহ আলেম উপদেষ্টা কমিটির উচিত হবে দেশ-বিদেশের তাবলিগের সাথীদের হৃদয়ের আকুতি অনুভব নিয়ে পরামর্শ দেওয়া। তাবলিগের লাখো সাথীর হৃদযন্ত্রের ব্যথা-বেদনা অনুভব করা।
আঞ্চলিকতার প্রভাব, নিজস্ব দর্শন বা মতাদর্শের আলোকে নয়- দাওয়াতের উঁচু এই কাজকে তার নিজ গতিতে চলমান ও বহমান রাখার জন্যই হজরত ওলামায়ে কেরাম চেষ্টা করছেন।
সরকারের আন্তরিকতা ও সবার সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হোক বিশ্ব ইজতেমা। ধবধবে সাদা, নুরানি চেহারায় উজ্জ্বল, লা ইলাহার প্রাণবন্ত ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠুক তুরাগতীর।
homaunayub@yahoo.com
ঝগড়া বিবাদ কমিয়ে সবার মধ্যে ঐক্য ও শান্তি কামনা