শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


মাওলানা আকরাম খাঁ; একজন আলেম সাংবাদিকের জীবনকথা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

রকিব মুহাম্মাদ
আওয়ার ইসলাম

উনিশ শতকের শেষ ভাগের কথা। উপমহাদেশে ইংরেজদের রাজত্ব চলছিল তখন। মুসলমানদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। একদিকে ইংরেজ রাজ-শক্তি, অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের অত্যাচার-নিপীড়ন, শোষণ-বঞ্চনায় বাঙ্গালী মুসলিম সমাজের দুরবস্থা চরমে গিয়ে পৌঁছেছে। উত্তরোণের পথ কোথায়?  তবে কি এভাবেই শেষ হয়ে যাবে মুসলিমদের জীবন? সকলের মনে একই প্রশ্ন দানা বেঁধেছে তখন।

সেই সময় বাংলার চব্বিশ পরগণা জেলার বশিরহাট মহকুমায় একজন যুবক এসব নিয়ে ভাবতেন।যুবকের ক্লান্ত দুটো চোখ কী যেন খুঁজে বেড়ায় আকাশের দিগন্তরেখায়। তার হৃদয়ে রুধিরাক্ত হয় এসব দেখে। পরিবর্তনের হাল ধরতে চান তিনি। মুসলিমদের গৌরবগাঁথা ইতিহাস ফিরিয়ে দেওয়ার দৃঢ় সংকল্প করেন।

বলা হচ্ছিল মাওলানা আকরাম খাঁ-এর কথা। একজন বাঙালি আলেম সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক এবং ইসলামী পণ্ডিতের কথা। যিনি  কলমের মাধ্যমে মুসলিমদের অমর গর্বগাঁথা ইতিহাস ফিরিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন।

১৮৬৮ সাল। সে সময় বোদ্ধা এই আলেম আরেকজন আলেম মাওলানা হাজী আবদুল বারী খাঁ গাজী রহ. এর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। অবিভক্ত বাংলার চব্বিশ পরগণা জেলার বশিরহাট মহকুমায় বেড়ে উঠতে থাকেন। সেই সাথে তার মনে দানা বেধে থাকা স্বপ্নরাও বেড়ে ওঠে তিল তিল করে।

চোখের পাতায় এইসব স্বপ্ন নিয়ে ১৯০০ সালে তিনি কলকাতার এক আলিয়া মাদরাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে এফ.এম. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। মাদরাসার সিলেবাস অনুযায়ী আরবি-ফারসি-উর্দু ভাষা শেখার সুযোগ থাকলেও বাংলা ভাষা শেখার কোন সুযোগ ছিল না। তাই ছাত্র-জীবনে তিনি ইংরেজী-বাংলা শেখার সুযোগ না পেলেও পরবর্তীতে নিজ চেষ্টায় বাংলা, সংস্কৃতি ও ইংরেজী ভাষা রপ্ত করেন। আরবি-ফারসি-উর্দু ভাষায়ও তিনি বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন।

চাকরি-বাকরি ব্যবসা-বাণিজ্য, জমিদারী-জোতদারী সবই ছিল তখন হিন্দুদের হাতে।  সামাজিক ক্ষেত্রেও মুসলমানরা ছিল চরমভাবে উপেক্ষিত-অবহেলিত বাঙালি মুসলমানদের নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় চরমে পৌঁছে গেছে তখন। না আছে শিক্ষা না আছে সঠিক দীক্ষা।

এ অবস্থার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ উপায় অনুসন্ধান করতে লাগলেন। এজন্য তিনি প্রথমেই চিন্তা করলেন লেখালেখি ও সাংবাদিকতার মাধ্যমে মুসলিম সমাজকে জাগাতে হবে।

তাঁর পেশাগত ও রাজনৈতিক জীবন খুব অল্প বয়সেই শুরু হয়। সাংবাদিক হিসেবে তিনি প্রথম কাজ করেন আহল-ই-হাদিস ও মোহাম্মদী আখবার পত্রিকায়।

তারপর, মাওলানা আকরাম খাঁ কলকাতার  চামড়া ব্যবসায়ী ‘আলতাফী প্রেস’ এর মালিক হাজী আলতাফ এর কাছে যান। তাকে বললেন, ‘আমি একটি পত্রিকা করতে চাই।’ তিনি মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁকে সহযোগিতা করলেন। তাঁর সহযোগিতায় ‘আলতাফী প্রেস’ থেকে ১৯১০ সালে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ প্রথমে ‘সাপ্তাহিক মোহাম্মদী’ পত্রিকা প্রকাশ করেন।

‘বলকান’ যুদ্ধ চলছিল সেই সময়।  মুসলমান ও  ইংরেজদের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। মুসলমানদের প্রতিটি কথা, বলকান যুদ্ধের কথা ‘সাপ্তাহিক মোহাম্মদী’ পত্রিকায় বিশেষভাবে তুলে ধরার কারণে পত্রিকাটি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করে। কিন্তু ইংরেজ সরকার এ পত্রিকাটি সহ্য করতে পারেনি। তাই সরকারের আদেশে তা অচিরেই বন্ধ হয়ে যায়।

‘সাপ্তাহিক মোহাম্মদী’ পত্রিকা সরকারের আদেশে বন্ধ হয়ে গেল। তিনি থেমে থাকলেন না,  ১৯১৭ সালে এখান থেকেই মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ‘আল ইসলাম’ নামে আর একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন।

১৯২২ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনের সময় মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ‘মোহাম্মদী’ নামে আরেকটি  পত্রিকা বের করলেন। কিন্তু সরকার অল্প দিনের মধ্যেই এ পত্রিকাটিও বন্ধ করে দিল।

তারপর ১৯৩৭ সালে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর পরিচালনায় এবং সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দীনের সম্পাদনায় ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকা প্রকাশ হতে শুরু করল। এই সেই  ‘দৈনিক আজাদ’। বাঙালি মুসলমানের প্রথম দৈনিক পত্রিকা।

এ পত্রিকার মাধ্যমে বাঙালী মুসলমানের রাজনৈতিক আন্দোলন, সামাজিক জাগরণ, সাহিত্য-সংস্কৃতি চিন্তার প্রতিফলন ঘটে। স্বাধীনতা আন্দোলনেও দৈনিক আজাদের ভূমিকা ছিল জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ।

এভাবে ‘সাপ্তাহিক মোহাম্মদী’, ‘আল ইসলাম’, ‘মাসিক মোহাম্মদী’ ও ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার মাধ্যমে মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ মুসলিম বাংলার সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক গৌরবময় অবদান রেখে গেছেন।

প্রথমোক্ত দু’টি পত্রিকা স্বল্পায়ু হলেও পরবর্তী দু’টি পত্রিকা দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাঙালী মুসলিম সমাজের ব্যাপক ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে।

এছাড়া, তার সম্পাদিত আরো দু’টি স্বল্পায়ু পত্রিকা প্রকাশিত হয়। প্রথমটির নাম ‘সেবক’ ও দ্বিতীয়টির নাম উর্দু দৈনিক ‘জামানা’।

সাংবাদিকতার মহান পেশায় নিয়োজিত হয়ে তিনি অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর লেখনি যেমন ছিল ক্ষুরধার তেমনি তিনি ছিলেন নির্ভীক। বিভিন্ন সম্পাদকীয় ও উপ-সম্পাদকীয় লেখার মাধ্যমে তিনি দেশ ও জাতিকে সঠিক দিক-নির্দেশনা দান করেছেন। তিনি নিজে যেমন লিখেছেন, তেমনি অন্যদেরও লিখতে উৎসাহ ও প্রেরণা যুগিয়েছেন।

মাওলানা আকরাম খাঁ এর হাত ধরে মুসলিম যুবকেরা সাহিত্যচর্চা , সাংবাদিকায় হাতেখড়ি করেন। মুসসলিম সমাজে নতুন জাগরণের উত্থান হয়।

বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রবীন সাংবাদিকগণ প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে তাঁদের পেশাগত দক্ষতা অর্জনের জন্য মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর কাছে বহুলাংশে ঋণী। তাঁদের অগ্রপথিক হিসাবে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর কৃতিত্ব ঐতিহাসিক তাৎপর্যমণ্ডিত। তাই তাঁকে যথার্থই মুসলিম বাংলার ‘সাংবাদিকতার জনক’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়।

দরকারি অ্যাপটি ইনস্টল করতে ক্লিক করুন

সাংবাদিকতার মতোই রাজনীতির ময়দানেও একজন উজ্জল নক্ষত্রের নাম মাওলানা আকরাম খাঁ। সাহিত্যও রয়েছে বিশেষ অবদান।  রচনা করেছেন রাসুল সা. কে নিয়ে সিরাত গ্রন্থ ‘মোস্তফা চরিত্র’।

বাংলা ভাষায় রচিত সীরাত গ্রন্থসমূহের মধ্যে এ গ্রন্থটি নানা কারণে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছে তবে দু’একটি ক্ষেত্রে বিতর্কমূলক বিষয় স্থান লাভ করায় অনেকে এ গ্রন্থটির কঠোর সমালোচনা করেন। তাঁর রচিত ‘তফসিরুল কোরআন’ সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য।

এছাড়াও,  ‘মোসলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস’ নামক অনবদ্য এক গ্রন্থ রচনা করেও সুনাম কুড়িয়েছেন ব্যাপক।

মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁকে মুসলিম বাংলার ‘সাংবাদিকতার জনক’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি বাংলা গদ্য-সাহিত্যের একজন কালজয়ী অমর প্রতিভা।

এমন ব্যক্তির আবির্ভাব যে কোন দেশের জন্যই অত্যন্ত গৌরবের। তিনি তাঁর কর্মপ্রচেষ্টার দ্বারা দেশ ও জাতির মর্যাদা বৃদ্ধি করে গেছেন। আমরা তাকে এবং তার অবদান কোনদিন ভুলব না।

তথ্যসূত্র

মাওলানা মুহাম্মাদ আকরাম খাঁ বাংলা সাংবাদিকতার পথিকৃৎ (বই)
সাহিত্য ত্রৈমাসিক “প্রেক্ষণ”, মাওলানা আকরম খাঁ স্মরণ, জুলাই-সেপ্টেম্বর-২০০৫
উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ