মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী
গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
রোহিঙ্গা শব্দটি কী? এ শব্দটি নিয়েই ঝগড়া। পাশাপাশি এমন বেশ কয়কটি শব্দ নিয়েও মুসলমানদের বিবাদ রয়েছে বার্মার বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে। যে জন্য আরাকান এলাকার নাম বৌদ্ধ আর্মিরা করেছে রাখাইন।
রোহিঙ্গা মুসলমানগণ রাখাইন শব্দটি গ্রহণ করেননি। এ রাজ্যের সঙ্গে মুসলমানদের ১৪শ বছরের ইতিহাস নিহিত। তেমনিভাবে ইসলামের ইতিহাসে বোর্মা, বার্মা, বর্মা ইত্যাদি শব্দ আছে, তাই তারা এ শব্দ পরিবর্তন করে নাম রেখেছে মায়েনমার।
কেন? যেন আগের কোনও ইতিহাসে এ শব্দ খুঁজে না পাওয়া যায়। এটাকে বলে “নসল কাশি বা জাতি নির্মূল পরিকল্পনা।” বাড়িঘরে অগ্নি সংযোগ, ধর্ষণ, গুম, খুন, শিশু হত্যা ও নারী নির্যাতনের মাধ্যমে এটি করা হয়। এর শুরু হয় ওই জাতীর শব্দ, সাংস্কৃতি ও ঐতিহ্য মুছে দেওয়ার মাধ্যমে।
বার্মার সেনাবাহিনী ক্ষমতায় এসে রেঙ্গুনকে নাম করণ করেছে নেপিডু। এর প্রধান কারণ হলো, ইতিহাসের পরতে পরতে যত জায়গায় রেঙ্গুন শব্দটি রয়েছে, তত জায়গায় মুসলমানদের নাম রয়েছে। তাদের অবদানের কথা উল্লেখ রয়েছে।
আজকের আধুনিক বার্মার রূপকার অংসান সুচি’র বাবা। তার বাবার রাজনৈতিক প্রধান সঙ্গীদের ৬ জনের ৫ জনই ছিলেন মুসলমান।
চরমপন্থি ও বিপদগামী কিছু সেনাবাহিনী, আজকে যারা ক্ষমতার আসন দখল করে আছে তারা ওই মুসলমান মেধাবী রাজনৈতিকদের হত্যা করে। সুচিকে সেনা শাসকরা ২৫ বছর পর্যন্ত দেশ ছাড়া করে রাখে।
সে দেশের স্থপতি হলেন রোহিঙ্গা মুসলমানগণ। অথচ তারা চায় রোহিঙ্গাদের সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। তাই তারা আরাকানি মুসলমানদের সঙ্গে রোহিঙ্গা শব্দটিও ব্যবহার করতে রাজি নয়।
এখন না বুঝে আমরাও যদি বলি রোহিঙ্গা শব্দ তাদের সঙ্গে আমরা ব্যবহার করবো না। তাদের আমরা অন্যকিছু বলবো, তাহলে এটা দূরদর্শিতার লক্ষণ নয়।
ইদানিং দেখছি , কিছু নিম্নশ্রেণির মানুষ একে অপরকে গালি দেয় রোহিঙ্গা বলে। তাই বলে এটা আমরা কখনই বলতে পারি না যে, রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গা না বলা হোক। অনেক মানুষকে আমরা দেখি একে অপরকে ব্যঙ্গ করে প্রেসিডেন্ট কিংবা নবাব বলে। এর জন্য কি আমরা প্রেসিডেন্টকে প্রেসিডেন্ট ডাকা ছেড়ে দেবো?
অনেককে বলতে শুনি, রোহিঙ্গারা খারাপ, তাদের অনেক দোষ। কিন্তু তারা কি এতই খারাপ যে, তাদেরকে তাদের দেশ থেকে বিতারিত করা হবে?
আমাদের অনেকেই তো খারাপ। এর জন্য কি কেউ আমাদের দেশ থেকে বের করে দিলে আমরা তা মানবো? নাকি মানার প্রশ্ন আসে?
রোহিঙ্গারা আজ বিচ্ছিন্নতায় ভুগছেন। এটা তাদের বিপর্যয়ের কারণ। কিন্তু এতে তাদের কোনও দোষ নেই। কেননা দেশের আর্মিদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে রোহিঙ্গাদের মেধাবী সন্তানরা দেশ ছেড়ে এখন বিভিন্ন দেশে বসবাস করছে।
সৌদিতে তাদের সেকেন্ড নাগরিক মর্যাদা দেওয়া হয়। এছাড়াও বিভিন্ন উন্নত দেশে তারা বসবাস করছে। তাই মেধাবী শূন্য একটি জাতি বিচ্ছিন্নতায় ভুগতেই পারে। এ নিয়ে তাদের সমালোচনা করা ঠিক নয়।
বার্মা থেকে এ বছর এসেছে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা। এর আগে ৭২এ এসেছিল প্রায় ১২ লাখ। আর বিভিন্ন সময় ফাঁকে ফাঁকে এসেছে ১০ লাখের মতো। তাই বলা যায় বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখের মতো রোহিঙ্গা রয়েছে। আর বার্মায় এখনও প্রায় ১০ রোহিঙ্গা রয়েছে।
বার্মার বিভিন্ন রাজ্যে এখনও মসজিদ, মাদরাসা রয়েছে। সেখানে আজান হয়, হাদিসের দরস হয়। কিন্তু আরাকানের মুসলমানরা সেদেশের বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের বিশেষ বিদ্বেষের শিকার। কারণ রোহিঙ্গারা হলেন বার্মার আসল মালিক।
বার্মার একজন রাজা ছিলেন নাম “রোহামি”। তিনি প্রথমে বৌদ্ধ ছিলেন। পরে মুসলমান হন। তার সম্পর্কে ইতিহাসের বইয়ে আছে, রোহামি রাজা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে উপহার হিসেবে ‘আদা’ পাঠিয়েছিলেন। নবীজি তা খেয়েছিলেন এবং সাহাবিদেরও দিয়েছিলেন।
আমি বার্মার লেখকদের লেখা ইতিহাসের আরবি বইয়ে পড়েছি, রোহামি রাজা নৌকা ডুবির শিকার
আরব বণিকদের বার্মায় আশ্রয় দিয়েছিলেন। ওই সময়কার রাজা রোহামির অনুসারী ও বংশধরগণই আজকের রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা শব্দটি, রোশাম-রোশাং-রোশিঙ্গা-রোহিঙ্গা এভাবেই বিবর্তন হয়েছে।
বার্মার বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের মনোভাব হলো, যদি রোহিঙ্গাদেরকে তাদের জনগণ ও নামসহ বিতাড়িত করতে পারি, তাহলে পুরো দেশই আমাদের। মাঝে মাঝে এমন বিপর্যয় আছে বিভিন্ন জাতির ওপর।
আসলে বিশ্ব রাজনীতি খুবই কঠিন ও বাস্তব। আরাকান ভূমি কৌশলগত দিক দিয়ে শ্রীলঙ্কার মতো উর্বর একটি জায়গা। যেখানে মুসলমানগণ শত শত বছর আগে নৌকা ভিড়িয়েছিলেন।
চিন থেকে আরব পর্যন্ত এটি একটি সামুদ্রিক স্টেশন। কেউই এমন একটি উর্বর জায়গার লোভ সামলাতে পারছে না।
আরাকান রাজ্যকে ভিত্তি করে পৃথিবীর শক্তিধর দেশগুলো ইতোমধ্যে বিনিয়োগ করে ফেলেছে। ভারত এখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করবে। চিন এখানে বিশাল সমুদ্র বন্দর করবে। রাশিয়া করবে বিশাল বাণিজ্য কেন্দ্র।
আমেরিকারও অনেক বিনিয়োগ আছে এখানে। তাই তারা নিভৃতে থেকে বার্মার আর্মিদের দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করছে। মুসলমান শূন্য করছে।
আমাদের হাতে একটা দেশ ছিল, কিছু জায়গা ছিল, তাই তাদের আশ্রয় দিতে পেরেছি। এ থেকে সীমানা বন্ধ দেশগুলোর শিক্ষা নেওয়া দরকার। আমরা যদি এমন সঙ্কটে পড়তাম, আমাদের তো যাওয়ারও জায়গা থাকতো না।
প্রবাদে বলে ‘মগের মুল্লুক’। ওই মগের মুল্লুকের বংশধররাই এখন সেনাপ্রধান। তারা কোনও ধরনের যুক্তিসঙ্গত আইন ছাড়াই, একমাত্র পেশীর জোড়ে ক্ষমতা চালাচ্ছে। তারা অং সান সুচিকে একমাত্র বাইরের দেশের নাগরিক বিয়ে করার কারণে ভোট পাওয়ার পরও প্রধানমন্ত্রী হতে দিচ্ছে না। তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বানিয়ে রেখেছে। আর এর পেছনে কারণও আছে।
তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বানিয়েছে, যেন সেনাশাসকদের সঙ্গে বাইরের পৃথিবীর সম্পর্ক ভালো থাকে। কেননা সে অক্সফোর্ড’র ছাত্রী, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী।
আজকে যেসব মুসলমানদের হত্যা করা হচ্ছে, তারা সুচির বাবার সঙ্গের রাজনীতিবিদদের উত্তরসুরি ও বংশধর। এর জন্য অবশ্যই তার খারাপ লাগছে। কিন্তু সে কিছুই বলতে পারছে না। কিছু বললেই তাকে দেশ থেকে বের করে দেয়া হবে।
রোহিঙ্গা বিষয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর শুকরিয়া আদায় করছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে যে উদার হৃদয়ের পরিচয় দিয়েছেন তার কোনও তুলনা হয় না।
তিনি চাইলে তাদের জায়গা নাও দিতে পারতেন। যদি তাদের আসতে না দেওয়া হতো, তাহলে গত ২৪ আগস্ট থেকে আজ পর্যন্ত হয়তো পাঁচ লাখ মানুষ হত্যা, গুম ও নিঃশেষ হয়ে যেতো। আমরা জায়গা দেয়ায় তারা বেঁচে গেছেন।
আলেম ওলামা রোহিঙ্গা সঙ্কটের শুরু থেকেই নিরোলস পরিশ্রম করে আসছেন। তাদের অগ্রণী ভূমিকা প্রশংসার অবশ্যই দাবি রাখে। আমি সরকারকে আহ্বান করবো, সরকার যেন তাদের বিশেষভাবে সম্মাননা প্রদান করে।
আলেম ওলামাদের এ কার্যক্রম তাদের কিন্তু ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। যখন তাদের মাদরাসার ক্লাস পুরোদমে শুরু হবে, তখন তারা তাতে মনোযোগী হবে। তাই সরকার রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ ও ত্রাণ ব্যবস্থার কার্যক্রম সেনাবাহিনীর হাতে হস্তান্তর করাই শ্রেয়। আর সরকার করেছেনও সেটি।
কিন্তু ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে সরকার কেন রোহিঙ্গাদের থেকে আলেম ওলামাদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন? কেনা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ও সম্প্রীতি নষ্ট করছেন?
আপনারা আলেমদের সরিয়ে সেখানে বিভিন্ন এনজিও এবং খ্রিস্টান মিশনারিদের কাজ করতে দিচ্ছেন। এটা কিন্তু ভবিষ্যতকে ভিন্ন পথে নিয়ে যেতে পারে।
মিশনারিগুলো এখন খুব খুশি। তারা এখন শিশু, বিধবা ও সর্বহারাদের বুঝাবেন, উন্নত জীবন কী? যা শরণার্থীদের বিপথে পরিচালিত করার জন্য পুরো বিশ্বে হয়ে থাকে। তাই সরকারকে এখনই সাবধান ও সচেতন হতে হবে।
[গত ২১ ডিসেম্বর আওয়ার ইসলাম আয়োজিত ‘মানবতার নবী হজরত মুহাম্মদ সা. রোহিঙ্গা সঙ্কট: সঙ্কটে বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারে বিশেষ অতিথির আলোচনায় মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভীর বক্তব্য। অনুলিপি করেছেন কাউসার লাবীব]