বিশ্বব্যাপী শান্তিপূর্ণভাবে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের মাধ্যম হিসেবে বর্তমান দাওয়াত ও তাবলিগ একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। ভারতবর্ষের কৃতি সন্তান হজরতজি ইলিয়াস কান্ধলভি রহ. উদ্ভাবিত এ কাজ এখন চলছে পৃথিবীর প্রায় সব দেশে।
পৃথিবীময় বিস্তৃত এ জামাতে সম্প্রতি সৃষ্টি হয়েছে কিছু উত্তেজনা। তাবলিগ জামাতের প্রধান মারকাজ দিল্লির নিজামুদ্দিনের আমির মাওলানা সাদ কান্ধলভির কিছু বক্তব্যকে এ উত্তেজনার কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
দিল্লির এ উত্তেজনার প্রভাব পড়ছে পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত দাওয়াত ও তাবলিগের সর্ববৃহৎ জমায়েত ইজতেমা সামনে রেখে উত্তেজনার পারদ আবারও চড়ছে।
কিন্তু দাওয়াত ও তাবলিগের উর্বর ভূমি খ্যাত বাংলাদেশে তাবলিগি কার্যক্রম যেনো ক্ষতিগ্রস্থ না হয় তাই বাংলাদেশের আলেম সমাজ ইতিমধ্যে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।
জামিয়া মাদানিয়া যাত্রাবাড়ীর প্রিন্সিপাল, গুলশান আজাদ মসজিদের খতিব ও মজলিসে দাওয়াতুল হকের আমির আল্লামা মাহমুদুল হাসান তাবলিগ জামাতের সংকট নিরসণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত।
তিনি তাবলিগ জামাতের সংকট নিরসনের লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তৃক গঠিত কমিটির সদস্য এবং তাবলিগ জামাতের একজন মনোনীত উপদেষ্টা। এছাড়াও তিনি যোগাযোগ ও সমন্বয়ের যিম্মাদার হিসেবে কাজ করছেন।
সম্প্রতি তাবলিগ জামাতের উত্তেজনা নিয়ে আওয়ার ইসলামের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। কথোপকথনে তার সঙ্গে ছিলেন আওয়ার ইসলাম সম্পাদক মাওলানা হুমায়ুন আইয়ুব।
আওয়ার ইসলাম : দাওয়াত ও তাবলিগ জামাতের আজকের সংকট তৈরির পেছনে কারণ কি?
আল্লামা মাহমুদুল হাসান : তাবলিগ বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত একটি জামাত। বহু মত ও পথের মানুষ এখানে একত্র হয়েছে। তাই কিছু সমস্যা, কিছু মতের পার্থক্য এখানে তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। এতো বিশাল মানুষের জামাতে সামান্য কিছু সমস্যা হতেই পারে।
জামাত বড়, সমস্যাও বড়। তবে উলামায়ে কেরামের নেতৃত্ব ও তাদের সুপরামর্শ নিয়ে চলবে ততো দিন তাবলিগ হক্কানিয়্যাতের উপর টিকে থাকবে। আর যখন উলামায়ে কেরামকে পাশ কাটিয়ে চলবে এবং সাধারণ মানুষের নেতৃত্বে মেনে নিবে তখন তাবলিগ পথে পথে হোঁচট খাবে।
যেসব জায়গায় উলামায়ে কেরামের থাকা প্রয়োজন সেখানে সেখানে উলামায়ে কেরাম থাকলে সমস্যা হতো না।
আওয়ার ইসলাম : চলমান সংকটময় মুহূর্তে উলামায়ে কেরামের করণীয় কি?
আল্লামা মাহমুদুল হাসান : উলামায়ে কেরামের করণীয় হলো কারো ডাকের অপেক্ষা না করে তাবলিগে অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং তাকে আপন করে নেয়া। আপন আপন মনে, ভাই ভাই মনে করে এ কাজে সময় দেয়া।
মনে করেন, আপনি যদি কোনো ফ্যাক্টরির মালিক হন এবং তাতে কাউকে ম্যানেজার নিয়োগ দেন। এখন ম্যানেজার সমস্যা তৈরি করলে আপনার কি উচিৎ হবে তা ছেড়ে চলে আসা? প্রয়োজনে আপনি ম্যানেজার পরিবর্তন করবেন কিন্তু আপনার সম্পদ আপনাকে রক্ষা করতে হবে।
তাবলিগের কাজ উলামায়ে কেরামের। উলামায়ে কেরাম এ সম্পদ তৈরি করেছেন। এখন কে কি করলো তাই ভেবে তাবলিগের কাজ ছেড়ে আসা উচিৎ হবে না। বরং দরদি দিল নিয়ে আলেমদের এগিয়ে আসতে হবে।
আওয়ার ইসলাম : আপনি তাবলিগ জামাতের আলেম উপদেষ্টা মনোনীত হয়েছেন। আগামী বিশ্ব ইজতেমা যেনো সুষ্ঠু ও সুন্দর হয় সে লক্ষ্যে কাজ করছেন। তাবলিগ জামাতের সংকট নিরসনে এবং বিশ্ব ইজতেমার জন্য সুন্দর পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে কি কি পদক্ষেপ নিয়েছেন?
আল্লামা মাহমুদুল হাসান : আমি আশাবাদী, সুন্দর, সুষ্ঠু ও নিরাপদভাবে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে। হজরত উলামায়ে কেরাম, শুরা সদস্যবৃন্দ ও সরকার সে লক্ষ্যে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাবেন। এ পর্যন্ত সব কাজ ও উদ্যোগ আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। আশা করি, ইজতেমায় কোনো বিশৃংখলা হবে না।
উদ্যোগগুলোর মধ্যে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হলো, গত ২৯ অক্টোবর মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় বেঠক। সেখানে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ দেশের শীর্ষ আলেমগণ, তাবলিগ জামাতের মুরব্বি ও সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিলেন।
সে বৈঠকে দুটি কমিটি হয়। একটি কমিটি কাকরাইলের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো দেখবে এবং একটি কমিটি মাওলানা সাদ কান্ধলভির রুজুনামার বিষয়টি জেনে আসবে।
মাওলানা সাদ-এর বিষয়টি নিয়ে আমাদের প্রতিনিধি দল এখন ভারত সফরে রয়েছেন। তাদের সঙ্গে আমাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। তারা ইতিমধ্যে দেওবন্দ ও নিজামুদ্দিন সফর শেষ করেছেন। আজ গুজরাট সফর শেষ করে কয়েক দিনের মধ্যে দেশে ফিরবেন। দেশে ফিরে তারা সরেজমিন প্রতিবেদন পেশ করবেন। আশা করছি, তাদের সফরের মাধ্যমে সমাধানের পথ খুলবে।
আওয়ার ইসলাম : তাদের প্রতিবেদন পেশ করার পর সিন্ধান্ত হবে কিভাবে?
আল্লামা মাহমুদুল হাসান : তাদের পাঠানোর সিদ্ধান্ত যেভাবে হয়েছিলো সেভাবেই হবে। তাদের দেয়া প্রতিবেদনের উপর সিদ্ধান্তও সেভাবে হবে। অর্থাৎ মাননীয় স্বরাষ্টমন্ত্রীর উপস্থিতিতে যেভাবে উলামায়ে কেরাম ও তাবলিগের মুরব্বি সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ঠিক সেভাবেই সকলে মিলে আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে একটি যথাযথ সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে বলেই আমি মনে করি।
আওয়ার ইসলাম : দেশের ৬৪ জেলায় তাবলিগি ইজতেমা হচ্ছে। ৬৪ জেলার ইজতেমাগুলো সুন্দরভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু কোথাও কোথাও কোনো কোনো বিষয়ে আপত্তি এসেছে। অভিযোগ করে পত্র দিয়েছে।
আল্লামা মাহমুদুল হাসান : যথা নিয়মে শুরার পরামর্শে ইজতেমা পরিচালিত হবে। যেভাবে এ পর্যন্ত হয়ে আসছে। তবে উপদেষ্টা কমিটিকে কোনো আপত্তির কথা কেউ লিখিত আকারে জানান নি। লিখিত আকারে জানালে আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো এবং ব্যবস্থা নিবো।
আমি মনে করি, তাবলিগের কাজ উলামায়ে কেরামের কাজ। উলামায়ে কেরাম ও তাবলিগি মুরব্বিদের মাঝে আরও আন্তরিকতা থাকা প্রয়োজন। বিশেষত উলামায়ে কেরাম দরদে দিল হিসেবে কাজ করবেন এবং বুজুর্গানে দীনের এ আমানাত ‘দাওয়াত ও তাবলিগ’ যেনো কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সে ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখবেন।
আওয়ার ইসলাম : বাংলাদেশ থেকে একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে রয়েছেন। তাদের সফরের বিষয়টি স্পষ্ট করুন?
আল্লামা মাহমুদুল হাসান : আমাদের অব্যাহত প্রচেষ্টার ফলে ভারতে আলেম ও তাবলিগি মুরব্বিদের একটি সমন্বিত প্রতিনিধি দল সেখানে গিয়েছেন। তারা তাদের কার্যক্রম অনেকটা সফলভাবেই সমাপ্ত করছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি।
তারা এসে প্রতিবেদন জমা দেয়ার আগ পর্যন্ত এসব বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও পরামর্শ অব্যাহত আছে।
উম্মতের এ বিশাল দীনি মেহনতের জন্য সবার আন্তরিক দোয়া কামনা করছি।
আওয়ার ইসলাম : মাওলানা সাদ-এর ব্যাপারে আপনার বা আপনাদের বক্তব্য কী?
আল্লামা মাহমুদুল হাসান : মাওলানা সাদ-এর বিষয়টি সমাধান করার জন্যই ভারতে আমাদের প্রতিনিধি দল গিয়েছেন। তাদের ফিরে আসা এবং প্রতিবেদন দেয়ার আগ পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করা উচিৎ হবে না। আমার বা আমাদের ব্যক্তিগত মতামত দেয়ার সুযোগ নেই।
আওয়ার ইসলাম : মাওলানা সাদ কি এবার ইজতেমায় অংশ নিবেন?
আল্লামা মাহমুদুল হাসান : এখনি কিছু বলা যাচ্ছে না। এটা নির্ভর করছে প্রতিনিধি দলের প্রতিবেদনের উপর । স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অংশগ্রহণসহ উলামা উপদেষ্টা কমিটি এ পর্যন্ত যে কাজগুলো করেছে, লিখিত আকারে প্রতিনিধিদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।
আওয়ার ইসলাম : কাকরাইলের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানের জন্য আপনাদের উপদেষ্টা মনোনীত করা হয়েছে। আপনারা উপদেষ্টা হওয়ার পর ভেতরের কি কি দ্বন্ধ পেয়েছেন এবং তা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছেন?
আল্লামা মাহমুদুল হাসান : তাবলিগ জামাতের সমস্যার সমাধানের জন্য ২৯ অক্টোবর মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় বৈঠক হয়। সেখানে অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানের জন্য জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। আলেম ও তাবলিগি মুরব্বিদের সমন্বয়ে গঠিত সে কমিটি গত ১৬ নভেম্বর ঢাকার যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় বৈঠক করেন। সেখানে অভ্যন্তরীণ শৃংখলা রক্ষার জন্য ৫টি সিদ্ধান্ত হয়। তাহলো,
এক. কাকরাইল মারকাজের সকল বিষয়ে যথারীতি আগের মতোই শুরার বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
দুই. দৈনন্দিন সাধারণ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিষয়ে আগের মতোই মুকিমরাও (কাকরাইলে স্থায়ীভাবে অবস্থানরত) শুরার বৈঠকে উপস্থিত থাকতে পারবেন।
তিন. বিশেষ তিনটিবিষয়ে (ক) কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে পরামর্শ (খ) অর্থনৈতিক বিষয়ক পরামর্শ (গ) সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনা সংক্রান্ত পরামর্শ অথবা এ ধরনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল সাময়িক বিষয়ে পরামর্শের সময় শুরার সদস্যগণ ব্যতীত মুকিম বা অন্য কেউ উপস্থিত থাকতে পারবেন না।
চার. আজকের এই সভায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, কাকরাইলে আহলে শুরা এই বিষয়ে সর্বাত্মকভাবে একমত হয়েছেন, তারা নিচে উল্লেখিত ৫জন আলেমকে নিজেদের পৃষ্ঠপোষক ও উপদেষ্টা হিসেবে গ্রহণ করেবেন।
যখনই প্রয়োজন অনুভূত হবে অথবা উলামায়ে কেরাম প্রয়োজন মনে করবেন, তখন জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সমূহ এ উলামা কমিটির সামনে পেশ করবেন এবং তাদের ফয়সালাও মেনে নিবেন।
মনোনীত ৫ আলেম হলেন, কওমি মাদরাসা সমূহের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রকারী সংস্থা আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশের কো-চেয়ারম্যান আল্লামা আশরাফআলী, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলূমমাদানিয়া যাত্রাবাড়িরমুহতামিম ও গুলশান সেন্ট্রাল (আজাদ) মসজিদের খতিব আল্লামা মাহমূদুল হাসান, কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফা কের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, আল্লামা আব্দুল কুদ্দুছ, শোলাকিয়া ঈদগাহের খতিব আল্লামা ফরীদ উদ্দিন মাসউদ, মারকাজুদ দাওয়াহ বাংলাদেশের আমীনুত তালীম, মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক।
পাঁচ. উলামায়ে কেরাম ও আহলেশুরার মধ্যে আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক যথারীতি কায়েম থাকবে। আসা-যাওয়া থাকবে। মহব্বত ও সৌহার্দ্য বজায় এবং মতবিনিময়ের ধারা অব্যহত থাকবে।
আওয়ার ইসলাম : সবচেয়ে এ সংকট উত্তরণে আপনি কতোটা আশাবাদী?
আল্লামা মাহমুদুল হাসান : আমরা আশা করছি, উলামায়ে কেরামের নেতৃত্বে ও তত্ত্বাবধানে তাবলিগের কাজ আরও বেগবান হবে। বিশেষ করে আমাদের আমাদের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক রাহবার আল্লামা আহমদ শফী-এর দিক নির্দেশনায় উপদেষ্টা কমিটি কাজ করছেন। তাবলিগের কোনো সমস্যা-সঙ্কটই স্থায়ী হবে না।