বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


হাইআতুল উলয়ার গঠনতন্ত্র চূড়ান্ত করতে ফের সংশয়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আতাউর রহমান খসরু
আওয়ার ইসলাম

সম্মিলিত কওমি শিক্ষাবোর্ড আল-হাইআতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়্যা বাংলাদেশের গঠনতন্ত্র নিয়ে যেনো জটিলতা দূর হচ্ছেই না। দফায় দফায় বৈঠক করেও এক হতে হতে ফের ভাঙছে ঐক্য।

সর্বশেষ গত ৬ ডিসেম্বর মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার অনুষ্ঠিত হাইআতুল উলয়ার বৈঠকে বিষয়টি চূড়ান্ত হবে বলে আশার করা হয়েছিল।

গঠনতন্ত্র প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় এ পর্যন্ত বেশ কিছু বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। গত ২ অক্টোবর ঢাকায় হাইআতুল উলয়ার বৈঠকে যে গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয় তার কিছু বিষয় নিয়ে আপত্তি জানায় বেফাক ব্যতীত অন্য ৫ বোর্ড।

তাদের দাবিগুলোর মধ্যে ছিলো, হাইআতুল উলয়াকে বিশ্ববিদ্যালয় না করে অথরিটি করা, পাঁচ বোর্ড থেকে একজন কো-চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া, চেয়ারম্যান তার নিজস্ব ক্ষমতা বলে যে ১৫ সদস্য কো-অপ্ট করবেন সেখানে ৫ বোর্ড থেকে ২ জন করে ১০জন প্রতিনিধি রাখা, হাইআতুল উলয়ার বৈঠকের কোরাম পূরণে দুই-তৃতীয়াংশ বোর্ডের সদস্য উপস্থিত থাকা ইত্যাদি।

৫ বোর্ডের দাবির প্রেক্ষিতে গত ১৫ নভেম্বর হাইআতুল উলয়ার উচ্চতর একটি উপ-কমিটি একটি আইনী খসড়া চূড়ান্ত করেন এবং তা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) তে উপস্থাপনও করেন।

এ আইনী খসড়ায় ৫ বোর্ড থেকে ১০ জনকে কো-অপ্ট করার বিষয়টি ব্যতীত বাকি বিষয়গুলো অন্তর্ভূক্ত করা হয়। তাতে সম্মতি প্রকাশ করেন ৬ বোর্ডের প্রতিনিধগণ।

আর ১০ জনকে কো-অপ্ট করার বিষয়টি নোট আকারে উপস্থাপন করা হয়  আইনী খসড়ায়।

কিন্তু ৬ ডিসেম্বর হাটহাজারীতে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ বৈঠকে অন্তর্ভূক্ত করা বিষয়গুলো বাদ দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। আল্লামা আহমদ শফী এ আইনী খসড়াকে চূড়ান্ত বলে স্বাক্ষর করেছেন।

এখন বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আপত্তি আছে বলে জানাচ্ছেন বেফাক ব্যতীত অন্য ৫ বোর্ডের প্রতিনিধিরা।

তারা বলছেন, হাটহাজারীর বৈঠকে সব বিষয় পর্যালোচনার জন্য উপস্থাপন করা হয় নি। বরং দুটি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তাহলো, হাইআতুল উলয়া বিশ্ববিদ্যালয় না হয়ে অথরিটি হবে এবং আপাতত দ্বিতীয় কো-চেয়ারম্যানের কোনো প্রয়োজন নেই। এ দুটি ব্যাপারে তাদের কোনো আপত্তিও নেই।

কিন্তু অন্য বিষয়গুলো তথা কো-অপ্টে বোর্ডের সদস্যদের অন্তর্ভূক্ত করা এবং হাইআতুল উলয়ার বৈঠকে কোরাম পূরণের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ বোর্ডের উপস্থিতির বিষয়ে তারা তাদের দাবি অব্যাহত রাখবেন বলে জানান।

তবে কোনো বিরোধিতা নয়; বরং পারস্পারিক আলোচনার মাধ্যমেই তাদের প্রত্যাশা পূরণ হবে বলে জানান ৫ বোর্ডের প্রতিনিধিগণ।

বৈঠক সূত্রে জানা যায়,  আল্লামা আহমদ শফী কোনো ভোটাভুটিতে না যেয়ে ৫ বোর্ডের দাবির প্রেক্ষিতে হাইআতুল উলয়াকে অথরিটি করার বিষয়ে মত দেন। নতুবা সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় করার মতটিই প্রাধান্য পেতো। বিপরীতে কো-চেয়ারম্যানের দাবি থেকে সরে আসে ৫ বোর্ডের প্রতিনিধিগণ।

বাকি বিষয়গুলো হাইআতুল উলয়ার চেয়ারম্যান শায়খুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফী পূর্বের অবস্থায় থাকবে বলে সিদ্ধান্ত দেন।

আল্লামা আহমদ শফীর বক্তব্যের ‘পূর্বের অবস্থা’-এর ব্যাখ্যা নিয়ে ৫ বোর্ড ও বেফাকের মধ্যে মতভিন্নতা দেখা যাচ্ছে।

বেফাক বলছে, ‘পূর্বের অবস্থা’ হলো প্রথম গঠনতন্ত্র (২ অক্টোবর) আর ৫ বোর্ডে দাবি হুজুরের বক্তব্যের দ্বারা উদ্দেশ্য আইনী খসড়া (১৫ নভেম্বর’১৭) বুঝেছেন তারা।

বেফাকের সহ-সভাপতি ও মাখজানুল উলুম খিলগাঁও-এর প্রিন্সিপাল আল্লামা নুরুল ইসলাম জিহাদী আল্লামা আহমদ শফীর এ বক্তব্যের ব্যাখ্যা এভাবে তুলে ধরেন, ‘প্রথম যে গঠনতন্ত্র হয় (২ অক্টোবর’১৭) সেটা হাইআতুল উলয়া ৩২ সদস্যের কমিটি অনুমোদিত। ৫ বোর্ডের দাবির প্রেক্ষিতে যা কিছু অন্তর্ভূক্ত করা হয় তা ছিলো প্রস্তাব মাত্র। কেননা তা সংযোজন করেছিলো উপ-কমিটি। উপ-কমিটি গঠনতন্ত্র চূড়ান্ত করার ক্ষমতা রাখেন না।

আযাদ দ্বীনী এদারায়ে তা’লীম বাংলাদেশ-এর প্রতিনিধি মাওলানা এনামুল হক বলেন, ‘হুজুর (আল্লামা আহমদ শফী) যে পূর্বের অবস্থায় থাকবে বলেছেন তা দ্বারা কী উদ্দেশ্য স্পষ্ট নয়। তবে আইনী খসড়াই হওয়া বাঞ্ছনীয়। কেননা বিষয়গুলো ৬ বোর্ডের প্রতিনিধিগণ মিলে চূড়ান্ত করেছিলেন।’

নিজেদের দাবি ও অবস্থানের ব্যাপারে বলেন, ‘আমরা আমাদের দাবির ব্যাপারে অটল আছি। কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থে তার বিরোধিতা করবো না। যেনো আমাদের জন্য স্বীকৃতি চূড়ান্ত করার কাজ বাধাগ্রস্থ না হয়।’

তানযীমুল মাদারিসিদ দ্বীনিয়া বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মুফতি আরশাদ রাহমানীও নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে  এমনটি বলেন। তিনি আওয়ার ইসলামে প্রকাশিত হাইআতুল উলয়ার সদস্য ও বেফাকের সহসভাপতি মাওলানা নূরুল আমীনের বক্তব্য কোট করে বলেন, ‘পূর্বের অবস্থায়’ থাকবে দ্বারা শুধু আমরাই যে (১৫ নভেম্বর গৃহীত) আইনী খসড়া বুঝেছিলাম তা নয়। তার বক্তব্যেও বিষয়টি স্পষ্ট।’

৬ ডিসেম্বর বৈঠক শেষে মাওলানা নুরুল আমীন মোবাইলে আওয়ার ইসলামকে বলেছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনে দেয়া আইনী খসড়ার কিছু বিষয়ে আলোচনা উঠলেও আজকের বৈঠকে কোনো পরিবর্তন আসেনি। পূর্বের সিদ্ধান্তকে সবাই মেনে নিয়েছেন।’

মুফতি আরশাদ রাহমানীর ভাষ্যে, ‘দুটি বিষয় ছাড়া বাকি কোনো বিষয়ে সেখানে আলোচনা ও পর্যালোচনা হয় নি। যে দুটি বিষয়ে আলোচনা হয় তার মধ্যে হাইআতুল উলয়াকে বিশ্ববিদ্যালয় না করাটাই ছিলো আমাদের মূল দাবি। এ দাবি পূরণ হওয়ায় আমরা কো-চেয়ারম্যানের বিষয়টি ছেড়ে দিয়েছি।’

বাকি বিষয়গুলো ক্রমান্বয়ে সমাধান হবে বলে তিনি আশা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘স্বীকৃতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ৫ সদস্যের একটি উপ-কমিটি কাজ করছে। সেখানে ৫ বোর্ড থেকে দুজন প্রতিনিধি আছেন। আমরা আশা করছি, এই দুই জনের মাধ্যমে দাবিগুলো উপস্থাপন এবং তা ক্রমন্বয়ে পূরণ করা সম্ভব হবে।

উপ-কমিটির ৫ জন সদস্য হলেন, মুফতী মোহাম্মদ ওয়াক্কাস, মাওলানা আবদুল কুদ্দুস, মুফতি নুরুল আমীন, মুফতি রুহুল আমীন ও মুফতী মোহাম্মদ আলী।

৬ তারিখ বৈঠকের পূর্বে মুফতী মোহাম্মদ আলী আওয়ার ইসলামকে নিজেদের দাবির পক্ষে অটল থাকবেন বলে জানিয়েছিলেন। আজ যোগাযোগ করা হলে ৫ বোর্ড তাদের দাবির ব্যাপারে অটল আছেন বলেই তিনি দাবি করেন করেন।

তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় না হওয়া আমাদের মূল দাবি ছিলো। তা আদায় হয়ে যাওয়ায় অন্য বিষয়গুলোর ব্যাপারে নমনীয়তা প্রদর্শন করা হচ্ছে। আমরা চাচ্ছি, মূল স্বীকৃতি আইনী রূপ লাভ করুক।’

নিজেদের দাবি আদায়ের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমরা বিষয়গুলো এখন ইউজিসির হাতে ছেড়ে দিয়েছি। গতকাল (১২ ডিসেম্বর) ইউজিসির সঙ্গে আমাদের বৈঠকে নতুন উত্থাপিত আইনি খসড়ার ব্যাপারে আমাদের আপত্তির কথা জানিয়েছি। তারা বলেছেন, বিষয়টি তারা দেখবেন।’

৬ ডিসেম্বর হাটহাজারীর বৈঠকে সব বিষয়ে আলোচনা না হওয়া এবং আল্লামা আহমদ শফীর বক্তব্যের ব্যাখ্যা বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুস বিস্তারিত কথা বলতে রাজি হন নি। তিনি বলেন, ৫ বোর্ডের দাবি সংক্রান্ত বক্তব্য লিখিত আকারে যদি আমাদের হাতে আসে বা মিডিয়ায় আসে তখন আমরা বিস্তারিত উত্তর দিবো।

অনুরোধের পর তিনি বলেন যে, ‘৯ সদস্যের উপকমিটি যে আইনী খসড়া তৈরি করে এবং ইউজিসির কাছে উত্থাপন করে সে ব্যাপারে আমাদের আপত্তি ছিলো। আপত্তির কথা ইউজিসিতে জানানো হলে তারা বলেন, আপনাদের গঠনতন্ত্রের ব্যাপারে আমরা কোনো হস্তক্ষেপ করবো না। আপনার মিটিংয়ে তা পাশ করিয়ে আনুন।হাটহাজারীর বৈঠক হয়েছে ৯ সদস্যের উপ-কমিটির প্রস্তাবগুলো আলোচনা ও সিদ্ধান্তের জন্য। সেখানে যথা নিয়মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘একটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া দরকার। তাহলো, ৯ সদস্যের উপ-কমিটি আর ৩২ সদস্যের মূল কমিটি এক নয়। উপ-কমিটি প্রস্তাব পেশ করতে পারে। কোনো কিছু অন্তর্ভূক্ত করতে পারে না। সুতরাং ৯ সদস্যের উপ-কমিটির সদস্যরা যে বিষয়গুলো সংযোজন করেছিলেন তা কখনোই গঠনতন্ত্রের অংশ ছিলো না।। তাই হুজুরের বক্তব্য ‘পূর্বের অবস্থায়’ থাকবে দ্বারা গঠনতন্ত্র উদ্দেশ্য ‘আইনি খসড়া’ নয়।

সব বিষয়ে আলোচনা না হওয়ার ব্যাপারে মাওলানা আবদুল কুদ্দুস বলেন, ‘হাটহাজারীর বৈঠকে আমরা (বেফাক) বলতে গেলে কোনো কথায় বলি নি। কথা তারাই (৫ বোর্ড) বলেছে। সেখানে তারাই আলোচনা করতে আগ্রহ দেখায় নি। তারা সব বিষয় মেনে নিয়েছে এমন ভাব দেখাচ্ছিলো।’

উল্লেখ্য, গত ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনা কওমি শিক্ষা সনদের মান ঘোষণা করেন। এরপর ১৩ এপ্রিল শিক্ষামন্ত্রণালয় সনদের মান ও তা বাস্তবায়নের জন্য ৩২ সদস্যের একটি কমিটি ঘোষণা করে। গেজেটে দারুল উলুম দেওবন্দের অষ্টমূলনীতিকে প্রাধান্য দিয়ে আইনী প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়।

সেমতে সরকার স্বীকৃত আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশে একটি খসড়া গঠনতন্ত্র তৈরি করে।

তবে ৬ তারিখের বৈঠকের পর কওমি শিক্ষার্থীরা মনে করছেন এটি নিয়ে আর কোনো পক্ষ বিরোধে না জরিয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হোক। কারণ বেশি পেচাতে গেলে একসময় তা বিরোধে পরিণত হবে।

তাদের মতে, ৫ বোর্ড মনে করছে কমিটির শীর্ষ পদে বেফাক প্রাধান্য পেয়েছে, এ কারণে তারা কো চেয়ারম্যান ২ এর দাবি করেছি। সেটি আল্লামা আহমদ শফী আপাতত প্রয়োজন মনে না করায় তাদেরও মেনে নেয়া উচিত। কেননা তাদের দাবি অনুযায়ী বেফাকও ইউনিভার্সিটি দাবি থেকে সরে  এসেছে।

হাইআতুল উলয়ার বৈঠক সম্পন্ন; সিদ্ধান্ত এলো যেসব বিষয়ে

দেশের প্রথম উভচর যান তৈরি হচ্ছে আলেম বিজ্ঞানীর হাতে


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ