শাহনূর শাহীন
সাব এডিটর
মাওলানা অলিউর রহমান। একজন শহীদ বুদ্ধিজীবি। ৭১-এর শহীদ বুদ্ধিজীবিদের অন্যতম। কিন্তু দূর্ভাগ্য হলেও সত্য, বঙ্গবন্ধুর স্বীকৃতির পরও শহীদ বুদ্ধিজীবিদের তালিকায় মাওলানা অলিউর রহমানের নাম নেই।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে দীর্ঘ ৯ মাসের ক্লান্তিতে বিপর্যস্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সম্ভাব্য সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে মেধা শূন্য করার লক্ষ্যে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নির্মমভাবে হত্যা করে।সারাদেশ থেকে বাছাই করে শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আইনজীবি ও প্রকৌশলীদের ধরে এনে হত্যা করা হয়।
খুনিদের মূল লক্ষ্য ছিল লড়াকু বাঙালি জাতি স্বাধীনতা অর্জন করলেও যেন বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পঙ্গু, দুর্বল ও দিকনির্দেশনাহীন হয়ে পড়ে। মেধা ও নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়লে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে পৃথিবীতে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না-এমন নীল-নকশা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই হায়েনারা বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল এই দিনে।
একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বরে হত্যাযজ্ঞের শিকার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সংখ্যা এখনো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বাংলাপিডিয়ায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের যে সংখ্যা দেওয়া হয়েছে সে অনুযায়ী একাত্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ শিক্ষাবিদ, ১৩ সাংবাদিক, ৪৯ চিকিত্সক, ৪২ আইনজীবী এবং ১৬ শিল্পী, সাহিত্যিক ও প্রকৌশলী।
এদের মধ্যে ড. জি সি দেব, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, ড. গোলাম মোর্তজা, ড. মোহাম্মদ শফি, শহীদুল্লাহ কায়সার সহ অনেকের নাম থাকলেও শহীদ বুদ্ধিজীবি তালিকায় নাম নেই মাওলানা অলিউর রহমানের।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর মধ্য রাতে দেশের সূর্য সন্তানদের হত্যা করে বিভিন্ন বধ্যভুমিতে গণকবর দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান, রায়েরবাজার বধ্যভূমি এখনো সেই দুঃসহ স্মৃতি বুকে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। লালবাগের রায়ের বাজার বধ্যভুমিতে অন্যান্য শহীদ বুদ্ধিজীবিদের পাশাপাশি সেদিন মাওলানা অলিউর রহমানের লাশটিও পাওয়া যায়।
সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসার প্রাক্তন শিক্ষক মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তী চিন্তাশীল দার্শনিক শহীদ বুদ্ধিজীবী মাওলানা অলিউর রহমান ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একান্ত ঘনিষ্ঠ সহচর। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু যখন বাঙালির মুক্তি ও ন্যায্য হিস্যার দাবিতে ৬দফা পেশ করেন তখন অনেকেই এটাকে ইসলাম বিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করে।
সে সময় বঙ্গবন্ধু সিলেটেরই আরেক তরুণ মাওলানা উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদীকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করেন ৬ দফা ইসলাম বিরোধী কিনা। তখন মাওলানা জালালাবাদী বলেন, ৬ দফার মাধ্যমে আপনি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তির দাবি তুলেছেন এটাতো ইসলামের পরিপন্থী নয়ই বরং সহায়ক।
কেননা ইসলাম ন্যায়ের ধর্ম। কাউকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে শোষণ করার পক্ষে ইসলাম নেই। সুতরাং ৬দফা ইসলাম বিরোধী নয়।
এরপর ৬দফা দাবি যে, ইসলাম বিরোধী নয় তা ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও জনমত গঠনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ও পরামর্শে মাওলানা জালালাবাদীর উদ্যোগে ‘আওয়ামী ওলামা পার্টি’ গঠন করা হয়। মাওলানা অলিউর রহমান ছিলেন তার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
এছাড়াও মাওলানা জালালাবাদীর নেতৃত্বে ‘ইসলামী বিপ্লবী পরিষদ’ নামে আরেকটি সংগঠন করা করা। দুই সংগঠনের যৌথ তৎপরতায় ৬দফার সমর্থনে ‘শরীয়তের দৃষ্টিতে ৬দফা কর্মসূচি’ নামে বই লিখে হাজার হাজার কপি করে তা সর্বসাধারণের মাঝে বিলি করা হয়। যা তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যাপক সাড়া ফেলে।
আরো লেখা হয় ‘৬ দফা ইসলামবিরোধী নহে’, ‘যুক্তির কষ্টি পাথরে ৬ দফা’ ইত্যাদি। জানা যায়, এই সবগুলো বই-ই লিখেন মাওলানা অলিউর রহমান। তিনি শুধুমাত্র একজন মাওলানা বা মাদরাসা শিক্ষক কিংবা লেখখ সাহিত্যিকই ছিলেন না। তিনি একজন স্বনামধন্য হোমিও ডাক্তারও ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টাও ছিলেন এই মাওলান অলিউর রহমান।
৬ দফা সমর্থন, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ঐতিহাসিক অবদান ও জনমত গঠনকে মেনে নিতে পারেনি হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা। ফলে ১৪ ডিসেম্বরে অন্যান্য শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিকদের সাথে মাওলানা অলিউর রহমানকেও প্রাণ দিতে হয়েছিলো।
ভাষা আন্দোলনের স্থপতি প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম তার স্মৃতিচারণে এই মাওলানার মূল্যায়ন করে বলেছেন, ‘কোনো কোনো আলেম যে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে এতো আধুনিক জ্ঞান ও চিন্তা চেতনার অধিকারী হতে পারেন এবং এত বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল বাংলা ভাষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতা দিতে পারেন তা মাওলানা অলিউর রহমানের বক্তৃতা শোনার আগে আমি কোনোদিন কল্পনাও করতে পারিনি।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীকার আন্দোলনের এক মহান নেতা হিসেবে এই মাওলানার ঐতিহাসিক অবদান তাকে অমর করে রেখেছে দেশ ও জাতির কাছে।’
স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে একজন চিন্তাশীল লেখক, গবেষক ও দার্শনিক আলেম হিসেবে মাওলানা অলিউর রহমানের ছিলো অসামান্য অবদান। তার আত্মত্যাগ ছিলো অনস্বীকার্য, অতুলনীয়।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু প্রণিত শহীদ বুদ্ধিজীবি তালিকায় মাওলানা অলিউর রহমানের নাম থাকলেও পরবর্তীতে কোন অদৃশ্য কারণে কার ইশারায় তালিকা থেকে তার নাম বাদ পড়ে যায় তা আজো অজানা।
তবে কি শুধু মাওলানা হওয়াতেই এই অবহেলা? নাকি অন্য কোনো কারণ আছে? থাকলে সেটা কী? শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে এই প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে আজো অপেক্ষমান মাওলানা অলিউর রহমানের পরিবার, স্বজনরা।
(তথ্যসুত্র: মাওলানা জালালাবাদী রচিত ‘মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মাওলানা অলিউর রহমান: জীবন ও সাহিত্য’, ‘আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে’ উইকিপিডিয়া বাংলা, স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল পত্র এবং ইন্টারনেট।)
৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ওলামায়ে কেরামের অবদান নিয়ে বিজয়ের মাসে আওয়ার ইসলামের ধারাবাহিক আয়োজন ‘মুক্তিযুদ্ধে আলেম সমাজের ভুমিকা’য় মুক্তিযুদ্ধের অজানা অধ্যায় জানতে চোখ রাখুন আমাদের পরবর্তী আয়োজনে।
পড়ুন আগের দুটি পর্ব
মুক্তিযুদ্ধে হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর ভূমিকা কী ছিলো?
৭১-এর দুই আলেম বীর সহোদর ’জালালাবাদী’র গল্প