মাওলানা মামুনুল হক
লেখক, গবেষক ও মুহাদ্দিস
পৌনে শতাব্দীকাল দৃঢ় কদমে পথ চলা তাবলীগ জামাতে শুনছি বিভেদের সূর৷ ষোল কোটি মুমিনের প্রাণস্পন্দন হেফাজতে ইসলামের ঘরে জ্বলছে তুষের আগুন৷ ক'দিন আগে মাওলানা জাফরুল্লাহ খানের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করেছে ব্রাকেটবন্দী নতুন খেলাফত আন্দোলন৷
এর আগে ভেঙ্গেছে নেযামে ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিস৷ সর্বশেষ ভাঙ্গনের আগুনে জ্বলছে শতবর্ষী সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম৷ জমিয়তের ভাঙ্গন এখন টক অব দ্যা কওমি মহল! চলছে নানা রকম বিশ্লেষণ৷
এই ভাঙ্গনে কে কতটুকু দায়ী, কার কতটুকু হাত রয়েছে এর পিছনে- নানা বিষয় উঠে আসছে আলোচনায়৷ অনেকে আবার বিষাদের সূরে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতেও ভুল করছেন না৷ প্রতিদ্বন্দির দুঃসময় বলে কথা!
বাংলাদেশের জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ভেঙ্গে গেলে দ্বীন ও মিল্লাতের বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে, আর ঐক্যবদ্ধ থাকলে দেশে ইসলামি হুকুমত কায়েম হয়ে যাবে, এমনটা মনে করার যুক্তিসঙ্গ কোনো কারণ নাই৷ শুধু জমিয়ত নয়, বরং বাংলাদেশের কওমি মহলভিত্তিক কোনো রাজনৈতিক দলেরই দেশের রাজনীতিতে তেমন ভাইটাল অবস্থান নাই৷
তবে হ্যাঁ, গোটা কওমি মহল সম্মিলিতভাবে একটা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে৷ তাদের আছে সমাজ ও রাজনীতিতে জোয়ার তৈরি করার মত প্রভাব৷ তাই ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দ বিশেষভাবে জমিয়তের নেতৃবৃন্দের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ, আপনারা এমন কিছু করবেন না, যা ইসলামি রাজনীতিকে বাংলাদেশের মানুষের সামনে আরো বেশি হাস্যকর বিষয়ে পরিণত করে৷ ক্ষুদ্র দলীয় বিরোধ যেন আমাদের বৃহত্তর শক্তিকে হেয়প্রতিপন্ন না করে৷
মতপার্থক্য মানুষের স্বভাবজাত বিষয়৷ মতপার্তক্য তৈরি করতে বাড়তি কোনো শ্রম দিতে হয় না৷ কিন্তু মতৈক্য তৈরি করতে অনেক চেষ্টা-তদ্বির করতে হয়৷ আর মতপার্থক্য যেন বিরোধ-সংঘাতের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়, সে জন্য তো রীতিমত করতে হয় সাধনা৷ গড়তে হয় ঐক্যের মজবুত বুনিয়াদ৷
দুঃখজনকভাবে আমরা ঐক্যের জপনাটা যত বেশি জপি, ঐক্যের জন্য আমাদের কর্মপরিকল্পনা ততটাই দুর্বল৷ এই যে এখন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বিভক্ত হয়ে পড়ছে, এরপর হয়ত এক পক্ষ অপর পক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগের স্তুপ জমা করবে আর প্রচার করবে, পরিবেশটা আরো নষ্ট হবে, এটা রোধ করার কোনো আয়োজন কি আমাদের আছে?
ইতিপূর্বেও মজলিস, আন্দোলন কিংবা ঐক্যজোটের ভাঙ্গনের সময় এমনই হয়েছিল৷
আমার মনে হয়, ওলামায়ে কেরামের এমন একটা নির্দলীয় কিংবা সর্বদলীয় প্লাটফর্ম গড়া দরকার, যারা দলগুলোকে জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে৷ বিভেদের সময়গুলোতে দুতিয়ালি করবে৷ সংশ্লিষ্টদের ন্যূনতম একটা সমঝোতার মধ্যে রাখার ব্যবস্থা করবে৷
এক সময় সর্বোচ্চ উলামা পরিষদ নামে জাতীয় সকল বিষয়ের একটা অভিভাবকপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল৷ কিন্তু সেটিও কোনো দীর্ঘ বুনিয়াদের ভিত্তি পায়নি৷ আবারও এমন একটি সর্বদলীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা অসম্ভব কিছু বলে মনে হয় না৷ যে কোনো দুর্যোগ কিংবা বিভেদের সময় তারা সালিশি ভূমিকা পালন করবে৷
মুরব্বী ওলামায়ে কেরাম উদ্যোগ না নিলে নওজোয়ান তবকার ওলামাগণও পারেন এমন একটি জরুরি পদক্ষেপ নিতে৷ এই লক্ষ্যে জরুরি কিছু উসুল আর শত্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামোর উপর একটি ওলামা কমিটি গঠন করা যেতে পারে, যাদের কাজ হবে-
ক. বিভেদ ও বিভক্তির ক্ষেত্রসমূহে সমঝোতার উদ্যোগ নেয়া ৷
খ. জাতীয় ও জরুরি প্রেক্ষিতে ঐক্যের পরিবেশ তৈরি করা৷
গ. ন্যূনতম জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করা৷
আমাদের যে সংগঠনগুলো এই মুহূর্তে বিভেদ-বিভক্তির বেড়াজালে ঘুরপাক খাচ্ছে, তাদের নেতা-কর্মীদের জন্য যেমন এই জাতীয় একটা উদ্যোগ প্রয়োজন, তেমনি যে সংগঠনগুলো এই মুহূর্তে ভালো অবস্থানে আছে, তাদের জন্যও বিষয়টি সমানভাবে প্রয়োজন৷ কোনো একটি সংগঠনও শক্তিশালী বুনিয়াদের উপর উঠতে পারেনি৷
সামান্য মতবিরোধেই বিশাল বিশাল সংগঠনকে তাসের ঘরের মত লুটিয়ে পড়তে দেখা যায়৷ কাজেই বিশাল সংগঠন দেখে কারোরই আত্মতৃপ্তিতে ভোগার সুযোগ নেই৷
এখন থেকে একটি সর্বদলীয় ওলামা কমিটি গঠনের কাজ শুরু করা গেলে পাঁচ দশবছর পর হলেও এর এক বিরাট প্রভাব তৈরি হবে ইনশাআল্লাহ!