শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


দ্বীনি কাজে পরস্পরকে শ্রদ্ধা ও মহব্বত

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী
আলেম, শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিক

আমাদের আকাবির ও মুরব্বীগণ সবসময় বলেছেন, ‘ফরীক’ হয়ো না, ‘রফীক’ হও। অর্থাৎ বিচ্ছিন্নতা বা গ্রুপিং কাম্য নয়। সবাই যথা সম্ভব মিলেমিশে ঈমান আমলের কাজ করা।

গত একশ বছরের মধ্যে উপমহাদেশে দ্বীনি কাজ করার জন্য একাধিক হক্কানী ও রব্বানী আন্দোলনের জন্ম হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি আন্দোলনের নাম বলা যায়, যেগুলির সঠিক হওয়া সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কারও দ্বিমত নেই।

এক. দেওবন্দের অনুসারী মাদরাসা। দুই. মজলিসে দাওয়াতুল হক। তিন. তাবলিগি জামাত।

এ তিনটি ছাড়াও গ্রহণযোগ্য আরও আন্দোলন আলোচ্য শতাব্দীতে পাওয়া যায়। দারুল উলুম দেওবন্দ যদিও ১৮৬৬ ঈ. সালে প্রতিষ্ঠিত, আর বাংলাদেশে এর চর্চা ও বিকাশ এর বছর চল্লিশেক পরে।

ঢাকায় দেওবন্দী মাদরাসা শুরু করেন হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দীদে মিল্লাত হজরত শাহ আশরাফ আলী থানভী রহ. এর তিন খলিফার হাতে।

এক. মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ. দুই.মাওলানা আব্দুল ওয়াহহাব পীরজি হুজুর রহ. তিন. মাওলানা মোহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর রহ.।

হজরত থানভী রহ. তাঁর তাজদীদী কার্যক্রমে উপমহাদেশকে ব্যপকভাবে আলোকিত করেছেন। তিনি উলামায়ে কেরামের নেতৃত্বে সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্বীনের বুঝ ও শিক্ষা প্রচারের জন্য দাওয়াতুল হক প্রতিষ্ঠা করেন। কেবল নামমাত্র মুসলমানদের মধ্যে ঈমান, ইসলাম, দ্বীন ও শরীয়ত প্রচারের জন্য যুগের শ্রেষ্ঠ দায়ী মাওলানা ইলিয়াস রহ. তাবলিগি জামাতের কাজ শুরু করেন। অল্পদিনের ভেতর এ কাজ বিশ্বব্যপী ছড়িয়ে পড়ে।

মাওলানা ইলিয়াস রহ. ও হাকীমুল উম্মত থানভী রহ. এর মধ্যকার সম্পর্ক এতোই শ্রদ্ধাপূর্ণ ও আন্তরিক ছিল যে, মাওলানা ইলিয়াস রহ. হযরত থানভী রহ. এর ইলমকে মানুষের কাছে পৌঁছাতে চাইতেন।

তিনি বলেন, হজরত মাওলানা থানভী দ্বীনের জন্য অনেক বড় কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন। আমার মনে চায়, ইলম ও শিক্ষা হবে হযরত থানভীর রহ. এর আর এসব উম্মতের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজ হবে তাবলিগের। এতে হযরত থানভীর মূল্যবান ইলম ও ইসলাহী অবদান উম্মতের কাছে পৌঁছে যাবে। (মালফুজাতে মাওলানা ইলিয়াস রহ. পৃষ্ঠা: ৫৮)

তিনি অন্যত্র বলেন, হজরত থানভী রহ. থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য প্রয়োজন তাঁর মহব্বত। তাঁর সাথীগণ ও তাঁর রচনাবলী মুতালা করে উপকৃত হওয়া। তাঁর কিতাবগুলো পড়ার দ্বারা ইলম আসবে, আর আমল আসবে তাঁর সাথীদের দ্বারা। (মাওলানা ইলিয়াস রহ. পত্রাবলী, পৃষ্ঠা: ১৩৭-১৩৮)

মেওয়াত এলাকায় তাবলিগি কাজ শুরুর কয়েকবছর আগেই হযরত থানভী রহ. দাওয়াতুল হকের কাজ শুরু করেন। যে জন্য থানভী রহ. এর ইন্তেকালের পর মাওলানা ইলিয়াস রহ. মেওয়াতের সাথীদের একটি চিঠিতে বললেন, হযরত থানভী রহ. এর রূহে সওয়াব পৌঁছানোর ব্যাপারে খুব ইহতেমাম করবে। সব রকমের নেককাজ করে সওয়াব পাঠাবে। বেশি পরিমাণে কোরআন শরীফ খতম করবে।

হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ. তাঁর জামানার বড় বড় আলেমগণের কাছে বারবার ছুটে গিয়েছেন। দারুল উলুম দেওবন্দে উলামায়ে কেরামের খেদমতে হাজির হয়ে যখন তাবলিগের ছয়টি উসুলের কথা বললেন এবং একটি কাগজে সেসব লিখে পেশ করলেন।

তখন একটি উসুল ছিল ইকরামুল উলামা। অর্থাৎ আলেমগণের সম্মান। তখন দেওবন্দের মুফতী কেফায়াতুল্লাহ সাহেব ইকরামুল উলামার স্থানে লিখে দিলেন ইকরামুল মুসলিমিন। বললেন, এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে পরস্পর মিল শ্রদ্ধা ও মিল-মহব্বত সৃষ্টি হবে। তখন থেকেই এই উসুলটি ইকরামুল মুসলিমিন হয়ে যায়।

একবার একস্থানে মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. এর ইসলাহী জলসা চলছিল। কাছাকাছি স্থানে ছিল মাওলানা ইলিয়াস রহ. এর তাবলিগি জোর বা ইজতিমা। মাওলানা ইলিয়াস রহ. ব্যাপারটি জানতে পেরে বললেন, হযরত মাদানী রহ. এর জলসা আছে তোমরা আগে তা আমাকে বলনি কেন? চলো, সবাই তাঁর ইসলাহী জলসায় শরিক হই।

সেদিন তিনি তাবলিগি জোড় বা ইজতিমা মুলতবি করে হযরত মাদানী রহ. এর ইসলাহী জলসায় শরিক হন।

এই ছিলো বড়দের মিল-মহব্বত। দ্বীনি মাদরাসা, উলামায়ে কেরাম ও তাবলিগি জামাত একে অপরের পরিপূরক। একটিও স্বয়ং সম্পূর্ণ নয়। একটি অন্যটির অমুখাপেক্ষিও নয়।

এখানে বর্তমানে খুব সামান্য হলেও কিছু মানুষ এমন হয়ে গেছেন, যারা তাবলিগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস রহ. এর জীবনী বা তাঁর রচনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তারা বছরের পর বছর তাবলিগ করেন কিন্তু হজরত থানভী রহ. এর নামটিও উচ্চারণ করেন না। তাঁর উপর সওয়াব রেসানী করেন না। তাঁর কোনো কিতাব পড়েন না। এমনকি তাঁর সাথী বা খলিফাগণের আপন লোকজনের সাথে কোনো সম্পর্কও রাখেন না।

শুধু কি তাই! যেখানে উসুল ছিল ইকরামুল উলামা। উলামারা এখানে উদারতার পরিচয় দিয়ে লিখে দিলেন, ইকরামুল মুসলিমিন। সেখানে আলেমদের সম্মান করা যে ঈমানের দাবী সে কাথাটিও অনেকের মনে থাকে না।

অসংখ্য আলেম মনে কষ্ট ও ব্যথা নিয়ে আমকে বলেছেন, তাবলিগের কোনো কোনো সাথী তাদের প্রথম সুযোগেই জিজ্ঞেস করেন, মাওলানা সাহেব, আপনি কি ‘সাল’ লাগিয়েছেন? অনেক সময়ই দেখা যায়, এ প্রশ্নটি থাকে যথেষ্ট অবজ্ঞাসূচক। অথচ, উলামায়ে কেরাম দীনের কাজে দুই চার চিল্লা বা দুই চার সাল নয় বরং ক্ষেত্র বিশেষে পুরা জীবনটাই উৎসর্গ করে থাকেন।

তাছাড়া আলেমগণের সাথে কথাবার্তা ও আচরণ কেমন হবে তা তাবলিগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলনা ইলিয়াস রহ. বলে দিয়ে গেছেন। কোনো আলেম আজ পর্যন্ত অপর কোনো মুসলমানকে এভাবে কষ্ট দিয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন না। তারা কাউকে বলেন না যে, আপনি তো বিশ ত্রিশ বছর ধরে তাবলিগ করছেন, আপনার কি কুরআন শরীফ পড়া সহিহ আছে? আপনি কি কোরআন ও হাদিস থেকে কোনো জ্ঞান লাভ করেছেন?

তাছাড়া নবী করিম সা. এর একান্ত কাজ তিলাওয়াত, তা’লীমে কিতাব ও হিকমাহ এবং তাযকিয়ায়ে নফস ইত্যাদি কাজে আপনি কতদিন লাগিয়েছেন? এসব লাইনে কি আপনি চিল্লা, তিনচিল্লা অথবা সাল লাগিয়েছেন?

আমরা তাবলিগি জামাতের খুব সামান্য সংখ্যক এসব ভাইয়ের কাছে বিনয়ের সাথে এই নিবেদন রাখতে চাই, আপনারা সব কাজে যেমন নম্র ও শান্তভাবে অগ্রসর হন। মানুষকে যেভাবে মন্দকাজ থেকে ফেরানোর ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভাষা ব্যবহার করেন। এমনকি কাউকে সরাসরি নির্দেশও দেন না। প্রয়োজনে এভাবে বলেন, ভাই আমরা কথা না বলি। ভাই আমরা আওয়াজ না করি। আলেমদের ক্ষেত্রেও এমনই দরদ ও মহব্বতপূর্ণ ভাষা ও আচরণ উপস্থাপন করুন।

একজন আলেমকে দাওয়াত দেওয়া কি না, দিলে কখন দেওয়া, কিভাবে দেওয়া ইত্যাদি হজরত মাওলানা ইলিয়্সা রহ. এর জীবন ও শিক্ষা থেকে জেনে নিন। নিজেদের কাজটিকে একমাত্র নবীওয়ালা কাজ বলা বা মনে করা ঠিক নয়। নিজেদের মেহনতটিকেই একমাত্র আল্লাহর রাস্তার কাজ দাবি করাও ঠিক নয়।

নবীওয়ালা কাজ বলতে ইসলামে আরও অনেক কাজ আছে। আল্লাহর রাস্তা বলতে শরীয়তে বিশেষ কিছু জায়গা আছে। একটির জায়গায় আরেকটি বলা কতটুকু ঠিক তা সংশ্লিষ্টরা দয়া করে ভেবে দেখবেন। একজন ব্যক্তি যিনি তার জীবনের ৫০/৬০ বছর মানুষকে কুরআন শিক্ষা দিয়ে, হাদিস শিক্ষা দিয়ে, ইলমে দ্বীন শিক্ষা দিয়ে, তাযকিয়া করে, বৃহৎ অর্থে দাওয়াত ও তাবলিগ করে, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে কাটিয়েছেন তাকে নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যে, জীবনের কিছু সময় আল্লাহর রাস্তায় দেন। নবীওয়ালা কাজে কিছু সময় লাগান। ঈমান আমলের লাইনে কিছু মেহনত করুন।

এ বিষয়গুলো আলেম উলামাদের জন্য যথেষ্ঠ পীড়াদায়ক হয়ে দেখা দেয়। তারা তাবলিগকে ভালোবাসেন বলে মুখফুটে কারো কাছে কিছু বলেন না। কষ্টগুলো এমনকি অনেক ক্ষেত্রে অপমানগুলো মুখবুজে সহ্য করে নেন।

আর তাবলিগের মহান মুরব্বীদের, বানিদের, অতীতের হজরতজীদের মহৎ আচরণের কথা স্মরণ করে সান্ত্বনা লাভ করেন। পাশাপাশি মহান রব্বুল আলামীনের কাছে দোয়া করেন যেন ইসলামের কাজে যারাই যেখানে লেগে আছেন তারা যেন পরস্পরে শ্রদ্ধাশীল হন। মায়া-মহব্বতে ভরপুর হন। একে অপরের ‘ফরিক’ নয় ‘রফীফ’ হন।

মাদানীনগরের ইসলাহি জোড়: আত্মশুদ্ধিকামীদের মিলনমেলা


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ