পলাশ রহমান
ইতালি থেকে
অনেক আগে আমি একবার চরমোনাইর মাহফিলে গিয়েছিলাম। তখন সৈয়দ ফজলুল করীম রহ. বেঁচে ছিলেন। তিনি ছিলেন মুজাহিদ কমিটির আমির। এক বিকেলে তাঁর সাথে আমার দেখা হয়েছিল। আসরের নামাজের পরে হাজার হাজার মানুষ লাইনের দাড়িয়েছিল তাঁর সাথে দেখা করার জন্য।
এপাশ ওপাশ না ভেবে আমিও দাঁড়িয়ে যাই লাইনে। এক সময় আমার সুযোগ আসে। আমি উনার হাতে হাত রাখি। হালকা সোনালি রঙ্গের চশমার ভেতর দিয়ে উনি চোখ তুলে আমার দিকে তাকান। ঠোঁটে ঝুলে ছিল মার্জিত হাসি। এতগুলো বছর পরেও আমার চোখের আয়নায় তাঁর সেই হাসি, শীতল দৃষ্টি এখনো দেখতে পাই।
মাহফিলের উদ্দেশে খুলনা থেকে ছেড়ে যাওয়া মুজাহিদ কমিটির একটা বাসে করে প্রথমে বরিশাল, এরপর লঞ্চেচেপে মাগরিবের আগ দিয়ে আমরা চরমোনাইর মাহফিলে পৌঁছাই। যাদের সাথে গিয়েছিলাম তারা প্রায় সবাই পীর সাহেবের মুরিদ ছিলেন। বহুবার ওখানে গিয়েছেন। কোথা থেকে যেনো হোগলার পাটি, রান্না করার জন্য হাড়ি, তেলের চুলা জোগাড় করে ফেললেন।
আমরা যেখানে অবস্থান নিয়েছিলাম সেখান থেকে ওয়াজের স্টেজ অনেক দূরে ছিল। শুধু আলো ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছিল না। অবশ্য স্টেজের কাছে ধারে অবস্থান নেয়ার মতো কোনো পরিস্থতি ছিল না। আগেই প্রায় সব জায়গা দখল হয়ে গিয়েছিল।
রাতে বড় মাপের একটা মাছ কিনে আনা হলো। রান্না করলেন দু’জন মুজাহিদ সাথী। তরকারির স্বাদ বেশ হয়েছিল। বেশি রাত না জেগে এশার পর আমরা ঘুমাতে গেলাম। জীবনের প্রথম খোলা জায়গায় শুয়ে পড়লাম। পিঠের নিচে হোগলা, তার নিচে মাটি অথবা ঘাসের কার্পেট। উপরে চটের সামিয়ানা।
যাদের সাথে গিয়েছিলাম তারা আমাকে একটা বালিশ এবং দুইটা কাঁথা দিলেন। একটা হোগলার উপরে বিছাতে বললেন, অন্যটা গায়ে।
রাত বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে ঠাণ্ডা। সে কী ভয়াবহ ঠাণ্ডা। সারা রাত আমি একটুও ঘুমাতে পারি না। অনেক কষ্ট হয়। রাতেই নিয়ত বেঁধে ফেলি- সকালে বাড়ি ফিরে যাবো। দরকার হলে কাউকে কিছু না বলে চলে যাবো, তবু এই ঠাণ্ডায় আমি কিছুতেই থাকতে পারবো না।
ফজরের আজানের আগেই আমি অজু করে নামাজের জন্য প্রস্তুত হলাম। রাতেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম, সকালে পীর সাহেবের উদ্বোধনী বয়ান শুনে আমি বাড়ির উদ্দেশে রওনা করবো।
কিন্তু অবাক হওয়ার বিষয় হলো ফজর বাদে পীর সাহেবের বয়ান শোনার পরে আমার আর যেতে ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে তিনটা দিন থেকেই যাই। কিন্তু সারা রাত ঘুমাতে না পারা, ঠাণ্ডার কষ্ট মনে পড়তেই একদণ্ডও দাঁড়াতে ইচ্ছা করছিলো না।
বিরাট দ্বিধায় পড়ে গেলাম। কোনোভাবেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। এলোমেলো হাঁটতে শুরু করলাম। একবার নদীর ঘাট পর্যন্ত গেলাম, আবার ফিরে এলাম, এভাবে বেলা বাড়তে থাকে।
সকাল ১১টার দিকে আচমকা দেখা হয়ে যায় সৈয়দ খলিলুর রহমানের সাথে। তিনি সে সময় ইশা ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। আমার সাথে চেনা জানা ছিল আগে থেকেই। জানতে চাইলেন কোথায় আছি? বললাম, মাঠে, খুলনা থেকে আসা এক গ্রুপের সাথে।
তিনি আমাকে ছাত্র আন্দোলনের অস্থায়ী কার্যালয়ে নিয়ে গেলেন। সেখানে অনেক মানুষ। দুই তিন জনের সাথে পরিচয় হলো। সবাইকে বেশ ব্যস্ত মনে হলো। সারা দেশ থেকে মাহফিলে আসা নেতাকর্মীদের সাথে কেন্দ্রীয় নেতারা বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলছেন। খলিল ভাই আমাকে এক পাশে বসতে দিলেন। নিজেও বসলেন।
খুব আন্তরিকতার সাথে তিনি বললেন, আজ থেকে তুমি এখানেই ঘুমাবে, আমাদের সাথে। আমি একটুও চিন্তা না করে রাজি হয়ে গেলাম। শুধু মনে হচ্ছিল আমি বোধহয় এমনই একটা প্রস্তাবের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
মজার বিষয় হলো আমি কিন্তু একবারও সৈয়দ খলিলুর রহমানকে রাতে না ঘুমানো কথা, ঠাণ্ডায় কষ্ট পাওয়ার কথা বা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা বলিনি। তিনি নিজে থেকেই আমাকে উনাদের অফিসে ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দিলেন।
সকাল সন্ধ্যা অফিসের বারান্দায় বসে পীর সাহেবের বয়ান শুনতাম। মাহফিল যেদিন শেষ হবে, বাদ ফজর পীর সাহেবের আখেরী বয়ান চলছে। আমি ছাত্র আন্দোলনের অফিসের বারান্দায় বসে বয়ান শুনছি। এমন সময় আমার মনে হলে ঘরের মধ্যে ঘুমায়ে, পাকা দালানে বসে ওয়াজ শুনে এখানে থেকে কিছুই অর্জন করা যাবে না। মাহফিল থেকে ভালো কিছু অর্জন করতে হলে মাঠে বসে ওয়াজ শুনতে হবে। মাঠেই ঘুমাতে হবে।
২
তিন দিনের মাহফিলে পীর সাহেব সৈয়দ ফজলুল করীমের রহ. ছয়টি বয়ান শুনেছিলাম। যাদুকরী বয়ান। কি যেনো একটা আধ্যাত্মিক মায়া ছিল তাঁর বয়ানে। এছাড়াও অন্যান্য অনেক আলেমের বয়ান শুনেছিলাম।
তাদের মধ্যে সব চেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলাম সৈয়দ ফয়জুল করীমের একটা বয়ান শুনে। তিনি নভমণ্ডল নিয়ে বয়ান করেছিলেন। খুবই জ্ঞানগর্ভ বয়ান।
মাহফিলের সাধারণ কার্যক্রমের বাইরে মূল স্টেজে ওলামা সম্মেলন এবং ছাত্র সম্মেলন হতে দেখেছিলাম। ছাত্র সম্মেলনের আগে মিছিল হতে দেখেছি। ছাত্ররা দল বেঁধে লাখ লাখ মানুষের মাঝ থেকে সরু পথ ধরে মিছিল করে স্টেজের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। রাজনৈতিক শ্লোগান দিয়েছিলেন। সত্যি বলতে কি বিষয়টা আমার একদম ভালো লাগেনি, পছন্দ হয়নি।
বার বার মনে হয়েছে মিছিল করা, সম্মেলনে গলার রগ ফুলিয়ে রাজনৈতিক বক্তৃতা করা ওই পরিবেশের সাথে খুবই বেমানান। এগুলো মাহফিলের আধ্যাত্মিকতা নষ্ট করে। চরমোনাই মাহফিল থেকে যে অর্জনের জন্য মানুষ ওখানে ছুটে যায় তা বিঘ্নিত করে।
আমি জানি না এখনো এগুলো হয় কি না, যদি হয় বিষয়টা নিয়ে মুজাহিদ কমিটির নতুন করে ভাবা দরকার। প্রয়োজনে জরিপ করা দরকার মাহফিলে অংশগ্রহণকারীরা বিষয়টি কী ভাবে দেখেন? এসব মিছিল সম্মেলন থেকে কী অর্জন হয়? মানুষ কতোটা প্রভাবিত হয়, ইত্যাদি।
যেমন চরমোনাই মাহফিলের অর্জন খুব সহজেই বোঝা যায়। মানুষের আধ্যাত্মিকতা, ধর্মপায়ণতা, আমল দেখলে বোঝা যায় সেখানে আল্লাহর রহমত আছে। কিন্তু এত বছর ধরে ছাত্র সম্মেলন, ওলামা সম্মেলন বা মিছিল করে কী অর্জন হয়েছে? মানুষ এগুলো কী ভাবে নিয়েছে? একজন নতুন মানুষ কীভাবে নিচ্ছে? পুরাতনরা কীভাবে দেখছে? কার কী অর্জন হচ্ছে, বিষয়গুলো জরিপের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা দরকার।
আমি মনে করি চরমোনাই মাহফিলের আধ্যাত্মিকতা ধরে রাখার জন্য ওখানে মিছিল না করাই ভালো। মূলস্টেজে গলার রগ ফুলিয়ে রাজনৈতিক বক্তৃতা না করাই ভালো। বরং ছোট ছোটভাবে ক্যাম্পিং করা, দাওয়াতি কাজ করা, প্রশিক্ষণ দেয়া বেশি জরুরি। এতে হয়তো পীর সাহেবের রাজনৈতিক অঙ্গনের জন্য বেশি অর্জন হবে।
মুলস্টেজে যদি ওলামা সম্মেলন, ছাত্র সম্মেলন করতেই হয় তবে তার ধরণ বদলে ফেলা দরকার। সাধারণ সম্মেলনগুলোর মতো চিৎকার করে মেঠো বক্তৃতা না করে বরং গবেষণামূলক কথা বলা দরকার। আস্তে ধীরে শাস্ত মেজাজে মানুষের মনজগতে চিন্তার খোরাক ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা উচিত।
আমি যখন চরমোনাইর মাহফিলে গিয়েছিলাম তখন দেশি মিডিয়ায় মাহফিলের খবর খুব একটা দেখা যেতো না। এখনো যে খুব বেশি দেখা যায় তা নয়। তবে আগের তুলনায় কিছুটা খবর হতে দেখা যায়। আমি মনে করি দেশি মিডিয়ার পাশাপাশি মুজাহিদ কমিটির উচিৎ বিদেশি মিডিয়াগুলোকেও মাহফিলে দাওয়াত করা।
নিজেদের খরচে হলেও প্রতি মাহফিলে অন্তত একটি করে বিদেশি মিডিয়া রাখার চেষ্টা করা।
৩
চরমোনাইর মাহফিলে যখন বয়ান হয়, জিকির হয়, অনেক ভক্ত মুরিদকে উন্মাদের মতো আচারণ করতে দেখা যায়। তারা ছুটা-ছুটি, লাফা-লাফি করেন, বাঁশ বেয়ে উপরে উঠতে চেষ্টা করেন, ইত্যাদি। এই বিষয়গুলোর আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা কী বা শরীয়তের ব্যাখ্যা কী তা আমি জানি না।
তবে অনেক মানুষকে সমালোচনা করতে দেখেছি, কিন্তু তাদের প্রায় সব সমালোচনা বিদ্বেষমূলক। শরীয়তের ভাষায় যৌক্তিক সমালোচনা এখনো আমার চোখে পড়েনি। বয়ানের সময় যখন খুব বেশি লাফা-লাফি হয় তখন স্টেজ থেকে ধমক দিতে দেখেছি। চোখ পাকিয়ে বকা দিতে দেখেছি, যা আমার কাছে ভালো লাগেনি।
আমি মনে করি যারা লাফা-লাফি করেন তারা চরমোনাই তরিকার প্রশ্রয়েই করেন। তাদের প্রতি শীতল প্রশ্রয় না থাকলে তারা অমনটা করতে পারতেন না।
যেমন বাংলাদেশে অনেক কথিত পীরের দরবারে কবর পুঁজা, কবরে মানত করা, পীর কে সেজদা করাসহ অনেক শরীয়ত বিরোধী কাজ করতে দেখা যায়, যার লেশমাত্রও চরমোনাইর মাহফিলে দেখা যায় না।
একইভাবে বয়ানের সময় ভক্তদের লাফা-লাফি যদি শরীয়তের সাথে সাংঘর্ষিক হয় তবে তা কঠোরভাবে বন্ধ করে দেয়া উচিৎ। তরিকার প্রশ্রয় না পেলে কেউ অমনটা করতে সাহস করবে বলে আমার মনে হয় না। আর যদি শরীয়তের সাথে কোনো সংঘর্ষ না থাকে, বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ যোগ্য না হয় তবে তাদের বকা দেয়া, তাদের সাথে চোখ রাঙ্গিয়ে কথা বলা, রাগ দেখানো বন্ধ করা উচিৎ।
তারা যদি সত্যিই আধ্যাত্মিকতার মধ্যে হারিয়ে গিয়ে থাকেন তবে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সফট মোলায়েম কোনো পদ্ধতি খুঁজে বের করা দরকার। নিচু স্বরে বোঝানো দরকার। ওয়াজের মাঝখানে বক্তার রেগে যাওয়া, চোখ পাকিয়ে ধমক দেয়া, খুবই বেমানান, দৃষ্টিকটু মনে হয়।
আমার কাছে মনে হয়েছে চরমোনাইর মুরিদ যারা আছেন বা মাহফিলের বিভিন্ন দায়িত্বে যারা আছেন তাদের মধ্যে বিনয়ের অভাব আছে। আচার ব্যবহারে, দায়িত্ব পালনে বিনয়ের বিরাট অভাব আমার চোখে পড়েছে।
আমি মনে করি তাদের আরো অনেক বেশি বিনয়ী হওয়া দরকার। এর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দরকার। এবং তা শুরু করা দরকার একদম গোড়া থেকে। এক্ষেত্রে তারা তাবগিল জামায়াতকে অনুসরণ করতে পারে।
৪
দেশে থাকতে মরহুম পীর সাহেব সৈয়দ ফজলুল করীম রহ. কে বহুবার দেখেছি। অনেক রাজনৈতিক এবং আধ্যাত্মিক বক্তব্য শুনেছি। বরাবরই তাঁকে একজন ভালো মানুষ বলে মনে হয়েছে। তাঁর চোখে মুখে, কথায়, এক ভয়ানক যাদু ছিল। আধ্যাত্মিকতায় তাঁর আসন যে কতো উঁচুতে ছিল তা খুব সহজেই বোঝা যেতো।
রাজনীতিতেও তিনি ছিলেন বেশ প্রজ্ঞাবান মানুষ। তার মধ্যে দারুণ এক স্মার্টনেস ছিল। রাজনীতির স্টেজে দাঁড়িয়ে কথা বলার মধ্যে অন্যরকম একটা আভিজাত্য ছিল। যা বর্তমানের নেতাদের মধ্যে কম দেখা যায়।
শুনেছি তাঁর মৃত্যুর পরে একটি ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়েছে। সৈয়দ ফজলুল করীম রহ. ফাউন্ডেশন। জানি না এই ফাউন্ডেশনের কাজ কী? তবে আমি মনে করি তাঁকে ঘিরে একটা গবেষণা কেন্দ্র তৈরি হওয়া দরকার। তাঁর রাজনৈতিক এবং আধ্যাত্মিক প্রতিটি কর্ম নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার।
বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক শিক্ষাবৃত্তি চালু করা দরকার। বিশেষ করে তাঁর জীবনী, রাজনৈতিক এবং আধ্যাত্মিক কর্মপদ্ধতি, কর্মপরিকল্পনা ও দর্শন বাংলা, ইংরেজি এবং আরবি ভাষায় প্রকাশ করা দরকার।
শুধু ছাপা অক্ষরের বই নয়, ইবুক তৈরি করা দরকার। বিষয় ভিত্তিক অ্যাপ তৈরি করে অনলাইন জগতে সবার জন্য উন্মুক্ত করা দরকার। দেশ বিদেশের সচেতন মহলে তাঁকে এবং তার দর্শন তুলে ধরা দরকার। বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটি এবং ইসলামি আন্দোলন বিষয়টি যৌথভাবে ভাবতে পারে।
লেখক: প্রডিউসার, রেডিও বেইস ইতালি